সাড়ে ছয় দশকের লেখকজীবন। ১৯৪০-এ, মাত্র সতেরো বছর বয়সে, গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ, কয়েক বছরের মধ্যেই খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র পঁয়তাল্লিশ, ছোটগল্প দেড়শোরও কম! এ ছাড়া কিছু প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা। বাংলা ভাষার যে সব কথাসাহিত্যিকের লেখকজীবন অর্ধশতাব্দীর বেশি, তাঁদের মধ্যে আর কেউ এত কম লিখেছেন কি না বলা শক্ত। তাই তাঁর সম্বন্ধে সারস্বত সমাজে একটি কথা প্রচলিত ছিল, ‘না লিখে লেখক’!
শুধু এ দিক থেকেই তিনি ব্যতিক্রমী নন। তিনিই সম্ভবত বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক, যিনি ‘ঘোষণা’ করে লেখা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তখনও তিনি সুস্থ, দেশ বা আনন্দবাজার পত্রিকা-র পুজোসংখ্যায় তাঁর উপন্যাস পড়ার জন্য তখনও পাঠক মুখিয়ে। তথাপি ২০০৫-এ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রমাপদ চৌধুরী জানিয়ে দিলেন, অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সারা জীবন, আর লিখবেন না। আজকের পৃথিবী তিনি জানেন না, তাই সেই পৃথিবী সম্পর্কে কিছু বলার নেই তাঁর। তাঁর সিদ্ধান্তে অনুরাগী পাঠক যতটা আহত হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি হয়তো বিস্মিত হয়েছিলেন। বাংলা ভাষার লেখকরা ‘রিটায়ার’ করেন নাকি?
আসলে তিনি বিশ্বাস করতেন, সাহিত্যসৃষ্টিতে ‘পরিমাণ’-এর থেকে ‘মান’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কতটা লিখলাম তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ— কী লিখলাম, সেই লেখা রসোত্তীর্ণ হল কি না। বেশি লিখলে, বা একটা সময়ের পর কলম তুলে না রাখলে যে স্বাভাবিক নিয়মেই লেখার মান পড়ে যেতে পারে, সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি— তাঁর নিজের কথায়, “থামতে জানাটাও একটা আর্ট।” এই তীব্র সচেতনতার সম্ভাব্য কারণ, তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম সম্পাদকও। আনন্দবাজার পত্রিকা-র ‘রবিবাসরীয়’ ও পুজোসংখ্যা দীর্ঘ দিন প্রকাশিত তাঁর সম্পাদনায়। তাঁর হাত ধরেই উঠে এসেছেন বহু লেখক। গত বছর ২৮ ডিসেম্বর শতবর্ষে পদার্পণ করেছেন এই সাহিত্যিক-সম্পাদক।
রমাপদ চৌধুরীর লেখার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা জানেন, তাঁর অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের উপজীব্য শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির ব্যক্তিগত ও সমাজজীবন। যে মধ্যবিত্ত “নিজের মানসিকতা সম্পর্কে সচেতন নয় অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্যায়-অবিচার নিয়ে সোচ্চার”, “নিজে অসহায় কিন্তু আরও অসহায়দের প্রতি তাঁর সমবেদনা কম”, সেই মধ্যবিত্তকে চিরে দেখেছেন ‘দিনকাল’, ‘বসবার ঘর’, ‘ফ্রীজ’, ‘জাল’, ‘আমি, আমার স্বামী ও একটি নুলিয়া’, ‘ডাইনিং টেবিল’-এর মতো ছোটগল্পে; খারিজ, বীজ, লজ্জা, বাড়ি বদলে যায়, ছাদ, বাহিরি, দাগ-এর মতো উপন্যাসে। মধ্যবিত্তের চরিত্রের নানা অন্ধকার দিক লেখায় তুলে ধরেছেন স্পষ্ট, নির্মম ভাবে।
মধ্যবিত্ত বাঙালিজীবন যদি তাঁর লেখার একটি ‘থিম’ হয়, আর একটি ‘থিম’ অবশ্যই গত শতকের চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের ভারত— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা ও দেশভাগে বিধ্বস্ত, যেখানে ক্রমে উত্থান হচ্ছে পুঁজিবাদের। তাঁর প্রথম জীবনের এই লেখাগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়, সাহিত্যের ছাত্র হলেও ইতিহাস অর্থনীতি নৃতত্ত্বে তাঁর বৈদগ্ধ ছিল প্রশ্নাতীত, পেশাদার গবেষকের সমতুল। না হলে কী ভাবে তিনি লিখলেন ‘ভারতবর্ষ’-তে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পালামৌ অঞ্চলের একটি গ্রামের, পুঁজিবাদের হাতছানিতে ধীরে ধীরে ‘ভিখারি’ হয়ে ওঠার মর্মান্তিক কাহিনি, ‘গত যুদ্ধের ইতিহাস’-এ দরিদ্র মেয়ের জীবনের করুণ আখ্যানের মধ্য দিয়ে সময়ের ইতিহাস, বনপলাশীর পদাবলী-তে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের আখ্যান যখন বাংলার গ্রাম অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়ছে, সরকারের গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনা সেই ভাঙন রোধে ব্যর্থ হচ্ছে?
এর বাইরেও নানা বিচিত্র বিষয় তাঁর লেখায়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য কালখণ্ডের ভিত্তিতে লিখেছেন লালবাঈ, কলকাতায় ঘটে যাওয়া এক ট্র্যাজিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে অভিমন্যু, সত্তরের দশকের যুব-জীবনযাত্রা নিয়ে এখনই, জনজাতি মানুষের যাপন নিয়ে রেবেকা সোরেনের কবর, ঝুমরা বিবির মেলা। নিখাদ প্রেমের গল্পও লিখেছেন একাধিক— ‘সতী ঠাকরুণের চিতা’, ‘তিতির কান্নার মাঠ’, ‘রাঙ্গাপিসিমা’। তুলনায় তাঁর প্রবন্ধ ও অন্য গদ্যলেখাগুলি কম আলোচিত। অথচ, ‘কোন বই আবিষ্কার, কোনটি কালহরণের সঙ্গী’-র মতো প্রবন্ধ, ভারতের মন্দির-বিষয়ক রচনা বা অনবদ্য স্মৃতিকথা হারানো খাতা পড়লে বোঝা যায়, সেখানেও তিনি অপ্রতিম। রমাপদ চৌধুরীর লেখনশৈলী পূর্বসূরিদের প্রভাবমুক্ত, ঋজু। অহেতুক কাব্যময়তা, আবেগের আতিশয্য নেই। মনে হয়, তিনি যখন লিখতেন, তাঁর সম্পাদক ও লেখক দুই সত্তাই সমান সক্রিয় থাকত। তাই সৃষ্টি করতে পারতেন অত্যন্ত উঁচু দরের সাহিত্য, যতটুকু না লিখলেই নয় ঠিক ততটুকুই লিখে।
গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের বহু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিককে আজকের বাঙালি পাঠক বিলকুল ভুলে গিয়েছে। রমাপদ চৌধুরীকে মনে না রাখলে আত্মবিস্মৃত বাঙালির নীচে নামার পথই প্রশস্ততর হবে।