—প্রতীকী ছবি।
আচার্য শান্তরক্ষিত, তিব্বতের ‘শিবাছো’, ‘শান্তিজীব’ বা ‘বোধিসত্ত্ব’। বর্তমানে কার্যত বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম। তবে তাঁকে নিয়ে ফের চর্চার নানা কারণ থাকতেই পারে। প্রথমত, ভারত, তিব্বত, চিন সম্পর্কটিকে বৌদ্ধ ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে ও তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের চলনটি ধারণা করতে সাহায্য করেএই জীবন। দ্বিতীয়ত, বাঙালি তথা ভারতীয়মনীষার উচ্চতা সম্পর্কে গর্ব করলে শান্তরক্ষিতের উপস্থিতি অনিবার্য।
প্রথম প্রতিপাদ্যটি নিয়ে শুরু করা যায়। তিব্বতের প্রথম বৌদ্ধবিহার সামিয়ে-তে (পুরো নাম, ‘সামিয়ে মিনজুর লহুনগি ডুবপেই চুগলগখাং বা অচিন্ত্য নিরাভোগ সিদ্ধবিহার’) তর্কসভা বসেছে। বিহারটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শান্তরক্ষিত। তিব্বতিদের কাছে তিনি ‘খেনচেন’ বা মহান অধ্যক্ষ। তর্কসভার পৃষ্ঠপোষক তিব্বতের রাজা ত্রি-স্রং-দেউ-ৎসান। যুযুধান ভারত ও চিনের পণ্ডিতেরা। চৈনিক পণ্ডিতদের নেতৃত্বে হেসাং মোহেইয়েন। উল্টো দিকের নেতৃত্বে নালন্দার পণ্ডিত, শান্তরক্ষিতেরশিষ্য কমলশীল।
লড়াই চৈনিক মহাযান মতের একটি শাখার সঙ্গে ভারতীয় যোগাচার-মাধ্যমিক মতের। দু’বছরের তর্কে শান্তরক্ষিতের বিশ্বাস ও দার্শনিক প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন কমলশীল। এই তর্কসভা তিব্বতে ভারতীয় মতের বৌদ্ধ-দর্শন বিস্তারে জরুরি ভূমিকা নেয়। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী চৈনিক লোকজন কমলশীলকে খুন করেন। এই ঘটনাপ্রবাহ যেন বলতে চায়, ভারত-চিন বর্তমান দ্বন্দ্বের ইতিহাস সুপ্রাচীন। আর সেখানে ভারতীয়েরা জিতেছে মূলত জ্ঞান দিয়ে। বিষয়টির নেপথ্যে ছিল শান্তরক্ষিতের মস্তিষ্ক। তাঁরই পরামর্শে তিব্বতের রাজা কমলশীলকে আমন্ত্রণ জানান। তবে কমলশীল তিব্বতে আসার আগেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় শান্তরক্ষিতের। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের আগে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের বিস্তারে প্রধানতম ভূমিকা এই শান্তরক্ষিতেরই।
তিব্বতের প্রাচীন ধর্মমত ‘পোন’। ষষ্ঠ শতকের তিব্বতি রাজা স্রোংচেন-স্গেম-পো, তাঁর দুই রানির সৌজন্যে ছবিটা বদলাতে থাকে। চিন ও নেপালের মেয়ে, দুই রানিই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। শুরু হল পোন-বৌদ্ধ সংঘাত। রাজা ত্রি-স্রং-দেউ-ৎসানের সময়ে সংঘাত চরমে উঠল। প্রধানমন্ত্রী মা-শাং বৌদ্ধ-বিরোধী নানা কাজকর্ম করতে থাকলেন। রাজারই মন্ত্রী সাল-নাং ওরফে জ্ঞানেন্দ্র আবার বৌদ্ধ অনুরাগী। নেপালে নালন্দার আচার্য, সর্বাস্তিবাদী পণ্ডিত আচার্য জ্ঞানগর্ভের কাছে দীক্ষিত শান্তরক্ষিতের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। জ্ঞানেন্দ্রের তদবিরে রাজা শান্তরক্ষিতকে তিব্বতে ডাকলেন। নানা মারপ্যাঁচে খুন হলেন প্রধানমন্ত্রী। শান্তরক্ষিত পা দিলেন তিব্বতে। এ প্রসঙ্গে কিংবদন্তিও প্রচলিত: এক খামারবাড়ির মালিকের তিন ছেলে ছিল। তাঁরা ঠিক করেন, পরের কোনও জন্মে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করবেন। এই তিন ছেলেই পরবর্তী জন্মে শান্তরক্ষিত, ত্রি-স্রং-দেউ-ৎসান ও জ্ঞানেন্দ্র।
কিন্তু লাসায় শান্তরক্ষিত আসার কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হল দুর্ভিক্ষ, মড়ক। বৌদ্ধ-বিরোধীরা প্রচার চালালেন, এর জন্য শান্তরক্ষিত, তাঁর প্রচারিত বৌদ্ধধর্মই দায়ী। তিব্বত ছাড়তে হল শান্তরক্ষিতকে। কিন্তু রাজাকে পরামর্শ দিলেন, সাধক পদ্মসম্ভবকে ডাকতে হবে। পদ্মসম্ভবই ভারতীয় বৌদ্ধমতের পথটি পরিষ্কার করলেন। আজও তিব্বতের ঘরে-ঘরে পূজিত পদ্মসম্ভবকে নিয়ে রয়েছে নানা তিব্বতি কিংবদন্তি। কথিত, তিনি পোনধর্মের দেব-দানবদের বশীভূত করে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করলেন। ভগিনীপতির ব্যবস্থার পরে তিব্বতেফের পা রাখলেন শান্তরক্ষিত। থাকলেন টানা ১৫ বছর, আমৃত্যু।
তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের বিস্তারে শান্তরক্ষিতের ভূমিকা প্রধানত চারটি। এক, ওদন্তপুরী মহাবিহারের আদলে সামিয়ে বিহার প্রতিষ্ঠা ও মাস্টারমশাই হিসাবে ভারত থেকে ১২ জন পণ্ডিতকে আনার ব্যবস্থা করলেন তিনি। দুই, তিব্বতে আশ্রমভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন তিনিই। তিন, সাত জন তরুণ তিব্বতি বৌদ্ধভিক্ষু তৈরি করলেন। চার, তিব্বতি জনতাকে বৌদ্ধ-দর্শনের নানা মূল তত্ত্ব, যেমন দ্বাদশনিদান, অষ্টাদশ ধাতু, দশকুশল প্রভৃতি বিষয়ে সহজসরল ভাবে শিক্ষা দিলেন। পাঁচ, শান্তরক্ষিত বুঝলেন, জনতার মন পেতে হলে, তার ভাষাই হবে অবলম্বন। তাই তৈরি করলেন শান্তিগর্ভ, বিশুদ্ধসিংহ, বিমলমিত্র-সহ নানা জনকে নিয়ে অনুবাদক দল। এই অনুবাদক দলটিই সংস্কৃত থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বইপত্র তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করে। বস্তুত, এই ভাষার ব্যাপারটি বহু পরে হয়তো টের পান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তাই কি তিনি বলছেন, “এশিয়ার মধ্যযুগে বৌদ্ধধর্মকে তিব্বত চীন মঙ্গোলিয়া গ্রহণ করেছিল, কিন্তু গ্রহণ করেছিল নিজের ভাষাতেই।” (বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ)
তিব্বত জয় করা শান্তরক্ষিতের শিকড় কিন্তু বঙ্গভূমিতেই। এ প্রসঙ্গেই আসে আমাদের দ্বিতীয় প্রতিপাদ্য, অর্থাৎ বাঙালি হিসাবে তাঁকে নিয়ে গর্ব করার অধিকারবোধটির কথা।
একমাত্র, রাহুল সাংকৃত্যায়ন শান্তরক্ষিতের জন্মস্থান ভাগলপুর কি না, সে প্রশ্ন তুলছেন। যদিও, শরৎচন্দ্র দাশ সম্পাদিত তিব্বতীয় ইতিহাসবিদ সুমপার বই ও নানা সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, শান্তরক্ষিত ‘সাহোরের’ রাজপুত্র। অতীশ ও শান্তরক্ষিত একই রাজবংশের সন্তান। একই কথা জানাচ্ছেন অতীশের শিষ্য ব্রোম-স্টোন পা-ও। অলকা চট্টোপাধ্যায় প্রমাণ করেছেন, অতীশ বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের বাসিন্দা। সুতরাং, শান্তরক্ষিতও সেখানকারই। পাশাপাশি, সুমপা জানাচ্ছেন, গোপাল থেকে ধর্মপালের রাজ্যকাল পর্যন্ত শান্তরক্ষিতের জীবৎকাল। অর্থাৎ তাঁর সময় ৭৫০ থেকে ৮০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
এই বাঙালিকে নিয়ে গর্ব করার আর একটি কারণ তাঁর দার্শনিক সত্তা। দর্শনের ইতিহাসেঅত্যন্ত জরুরি বই শান্তরক্ষিতের তত্ত্বসংগ্রহ। এখানে তিনি ‘স্বাতন্ত্রিক যোগাচার’ পথে যাবতীয় ভিন্ন দার্শনিক মতামতগুলিকে কার্যত ছিন্নভিন্ন করেছেন। এ ছাড়াও মধ্যমকঅলঙ্কারকারিকা, বাদন্যায় বৃত্তিবিপঞ্চিতার্থ প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই। শান্তরক্ষিত তাঁর মাধ্যমিকবাদটি তৈরি করেছেন ‘প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্র’ ও নাগার্জুনের শূন্যবাদ অবলম্বনে। তাঁর প্রধান দার্শনিক অবদানগুলির অন্যতম, মহাযান মতের যোগাচারবাদ ও মাধ্যমিকবাদের মধ্যে সেতুবন্ধন করা।
এমন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে শরৎচন্দ্র দাশ, অলকা চট্টোপাধ্যায় বা হাল আমলের রায়হান রাইন ছাড়া বাঙালি বড় কেউ একটা গভীর চর্চা করেননি। তাই বাঙালি বিস্মৃতিপ্রবণ, এই আপ্তবাক্যই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করে যান আচার্য শান্তরক্ষিত!