গান শেখানোর সময়ে বলতেন, গান-কে ফিরে-ফিরে পড়তে
Suchitra Mitra

তাঁর গানে মনের বৈভব

১৯৪৮-এ কলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুব-সম্মিলনের শেষ পর্বে ডিকসন লেনের ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কমিউনিস্ট বিরোধী দুষ্কৃতীর গুলি থেকে অতিথিদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দেন দুই সংস্কৃতিকর্মী।

Advertisement

রুশতী সেন

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৫৫
Share:

সুচিত্রা মিত্র। —ফাইল চিত্র।

সে  কালের গ্রামোফোনে ৭৮ গতির রেকর্ডে সুচিত্রা মিত্রের গলায় ‘মেঘের কোলে কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি’ বা ‘আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে’ কত ছবিই না এঁকে চলত আমার নাবালক চোখের সামনে! তখন থেকেই শুনি, ১৯৪৯-এ বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুচিত্রার গাওয়া ‘সার্থক জনম আমার’ গানটি নিয়ে আবেগ-আপ্লুত স্মৃতিচারণ। ১৯৪৮-এ কলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুব-সম্মিলনের শেষ পর্বে ডিকসন লেনের ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কমিউনিস্ট বিরোধী দুষ্কৃতীর গুলি থেকে অতিথিদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দেন দুই সংস্কৃতিকর্মী। ছাত্রদের প্রতিবাদ সমাবেশে সশস্ত্র আক্রমণের সম্ভাবনা সত্ত্বেও খোলা মাঠে টেবিলের উপরে দাঁড়ানো বেপরোয়া সুচিত্রার উদাত্ত গলায় ‘সার্থক জনম আমার’, ১৯৪৬-এ কলকাতার বিধ্বংসী দাঙ্গার পর লেখক-শিল্পীদের দাঙ্গা-বিরোধী পথযাত্রায় ট্রাকের উপর থেকে সুচিত্রার উচ্চারণ ‘সার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালোবেসে’, এই সব গল্প বলার মানুষ আজ আর তেমন নেই। ১৯৪৭-এর শেষে পশ্চিমবঙ্গে জারি হয়েছিল বিনা বিচারে আটকের ফরমান। প্রদেশবাসীর প্রতিবাদ ব্যর্থ করতে কলকাতায় এলেন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার পটেল; সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গবাসীর আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তৃতা যে দিন, সেই দিনই আকাশবাণীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান সুচিত্রার। তিনি গান নির্বাচন করলেন, ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে’। দীর্ঘ দিন বেতারে শোনা গেল না সুচিত্রার গান, শিল্পীর অবশ্য কোনও হেলদোল নেই।

Advertisement

গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে সলিল চৌধুরীর কথায় সুরে ‘সেই মেয়ে’ আজকের শ্রোতাদের কানে-প্রাণে-মনে নিশ্চয় ১৯৫০-এর আবেশ তৈরি করে না। কিন্তু সেই মেয়ের খিদের জ্বালার জন্য বাউল সুরের বিস্তার, আবার তার কালো হরিণ চোখের উল্লেখে ধ্রুপদের প্রক্ষেপ, সব পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ময়নাপাড়ার মেয়েকে তার গ্রামে প্রত্যাবর্তনের আর্জি, বিচিত্র সুর-লয়-কথকতার এই প্রবাহকে লালন করবার নিশ্চিত অধিকার সুচিত্রার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল। সলিল চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ থেকে ইতিহাসের আঘাতে জর্জরিত ‘সেই মেয়ে’-র কাছে পৌঁছেছিলেন। সুচিত্রা ‘সেই মেয়ে’-র এগারো বছর পরে ‘কৃষ্ণকলি’ রেকর্ড করেন। ‘তখন গগন ছড়ায় আগুন দারুণ তেজে’-র ঘের কিংবা ঘোর কিন্তু ব্যাহত করল না ‘ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ’-এর প্রাকৃত ব্যাপ্তিকে। কীর্তির এ রকম সূত্রেই কি উপমা পায় শিল্পীর আত্মসমীক্ষা?

‘একটা আদর্শ, একটা বিশ্বাসের জন্য অল্প বয়সে সক্রিয় রাজনীতি করেছি... মিছিল, টিয়ার গ্যাস, লাঠি চার্জ(-এর)... মধ্যে দিয়ে... অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছি... কিন্তু তাকে রাজনৈতিক জীবন আখ্যা দেওয়া ঠিক নয়... যাঁরা... রাজনীতি(র)... জন্য জীবন দিয়েছেন তাঁদের অসম্মান করা হয়। রাজনীতি... একটি... হোলটাইম ডেডিকেশন। সে-ডেডিকেশন আমার জীবনের অন্য ক্ষেত্রে। তবে... যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি... তা, সেই জীবনের প্রথম অধ্যায়ের আদর্শ এবং বিশ্বাসের জোরে... পার্টিতে নাম লেখাইনি, কিন্তু... সুদৃঢ় রাজনৈতিক আদর্শ এবং বিশ্বাস আমার আছে’। (সুভাষ চৌধুরী, ‘অন্য সুচিত্রা মিত্র’, স্বপন সোম সম্পাদিত সুচিত্রা, কারিগর ২০১৭, পৃ ৯০)। ডেডিকেশন আর দৃঢ় বিশ্বাসের মেলবন্ধনেই কি সেই রোখের উৎস, যে-রোখ ‘যতক্ষণ তুমি আমায় বসিয়ে রাখ’-র মতো পূজা পর্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে তাঁর কণ্ঠে করে তোলে মরিয়া প্রয়াসের গান? গানের দ্বিতীয় কলিতে ‘ততক্ষণ গানের পরে গান গেয়ে মোর প্রহর কাটে’-র অন্তিমে যখন পুনরায় ‘বাহির-বাটে’-র তুলনায় পেলব স্বরক্ষেপটি সুচিত্রা মূর্ত করেন, মনে হয়, বাহির ছেড়ে ভিতরে প্রবেশের অঙ্গীকার যেন প্রশ্নের অতীত!

Advertisement

তাঁর প্রায় সব ছাত্রছাত্রীই বলেন, সুচিত্রা মিত্রের প্রশিক্ষণ-পদ্ধতিতে আবশ্যিক ছিল, গানটিকে ফিরে-ফিরে পড়া। তাঁর গায়ন জুড়ে কথার অর্থবোধ আর স্বরলিপির নির্যাস পরস্পরের এত সংলগ্ন, যে কথা বা সুর, কোনও কিছুরই আধিক্যের পরিসর নেই। ‘ওগো আমার চির-অচেনা পরদেশী’-তে সুচিত্রার ‘তুমিও কোথা গেছ চলে’-র স্বরক্ষেপে, দিশাহীনতার আকুলতায় বিমূঢ় হতে হতেও শ্রোতা শোনেন, উপরের সা থেকে পঞ্চমে অবরোহণে তারার রেখাব ছুঁয়ে কোমল নিষাদ, শুদ্ধ ধৈবতের স্বরলিপি-নির্দিষ্ট ফরমান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি নেই। আবার নিছক স্বরলিপির প্রতি মান্যতায় ওই আকুলতার তল মেলে না। তাঁর শ্রোতাদের এমন বিচিত্র সব সঞ্চয় উপমা পায় বিষ্ণু দে-র ‘সুচিত্রা মিত্রের গান শুনে’-র মতো কবিতায়– ‘সামগ্রিক ঐশ্বর্যের যুক্ত সপ্ত স্বরে/ মানবিক উত্তরণে মনের বৈভব’। অরুণ মিত্রের ‘এই কণ্ঠ’ কবিতায়, ঘরে বসে সুচিত্রার গান শুনলে সেই ঘরবাসী যেন হয়ে ওঠেন অনন্ত ভুবনের অধিবাসী। ১৯৮২-র ডিসেম্বরে বিষ্ণু দে-র স্মরণসভায় সুচিত্রা গেয়েছিলেন, ‘আকাশ হতে খসল তারা’। জীবনভর গানে গানে মরণের সঙ্গে কত যে অব্যর্থ সংলাপ নির্মাণ করেছেন এই শিল্পী।

কেবল শোকসভা বা স্মরণ নয়, যে-কোনও অনুষ্ঠানেই সুচিত্রা মিত্রের গান নির্বাচন যেন রবীন্দ্রনাথে তাঁর সংবেদী শ্রমসিক্ত সমর্পণের উপমা। তাঁকে নিয়ে মুগ্ধতার পাশাপাশি বিরূপ মতও মেলে। তাঁর গলায় নাকি তারার গান্ধারের উপরে সুর ওঠে না, তখন তিনি গলা তোলার বদলে ঘাড় তুলে দেন, এমন মন্তব্য প্রসিদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষক তাঁর গানের ক্লাসে করেছেন বলে শুনেছি। সুর-বেসুরের বিচারক হিসাবে ব্রাত্য যাঁরা, তাঁরা ভাবেন, তবে কি ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ধ্রুপদী সঙ্গীত স্নাত শ্রুতি বিভ্রান্ত ছিল? তিনি তো সুচিত্রার জোরদার সুরেলা গলা, সে-গলায় টপ্পার দানা, তাঁর প্রয়োগ-সংযম আর অসামান্য ছন্দোজ্ঞান নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন! সুচিত্রা মিত্রের ব্যক্তিত্বটা বোধ হয় অস্বস্তিকর রকমের সটান ছিল। আর সে-ব্যক্তিত্ব গায়নের সংবেদন, গায়নকালীন শরীরী ভাষা, কোনও কিছুই বাদ দিয়ে নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের অব্যবহিত পরে যিনি শান্তিনিকেতনে পৌঁছেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে, তিনি সঙ্গীতে স্বীকৃতি পেতে শুরু করার পরেও কোমরে আঁচল জড়িয়ে ফুটবল খেলেছেন শান্তিনিকেতনের প্রান্তরে; নিজের অর্ধশতকের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃণাল সেনের পদাতিক চলচ্চিত্রে বলেছেন মোক্ষম সংলাপ, স্বামী স্ত্রী দু’জনেই রোজগার করেন যখন, স্বামীর উপার্জন স্ত্রীর থেকে বেশি হলে, বেশ একটা সুখী সংসারের ছবি দেখতে পাই, কিন্তু উল্টোটা হলে একটা কমপ্লেক্স-এর প্রশ্ন উঠে পড়ে না কি? বাচনের সঙ্গে চাপা হাসি, যার আড়ালে অশ্রুজল থাকাও অসম্ভব নয়।

ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে সিংহল গেছেন (১৯৬২), বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের প্রতিনিধির পরিচয়ে গেছেন মস্কো (১৯৭৩), আমেরিকায় কানাডায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন ভারতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গে (১৯৭৪), ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান কর্মসূচিতে তাঁর হাঙ্গেরি যাত্রা, একই বছরে তাঁর সঙ্গীতশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘রবিতীর্থ’-র তাসের দেশ অভিনীত হয়েছে আমেরিকা-কানাডা-সুইৎজ়ারল্যান্ড-লন্ডনে (১৯৭৫), দেশে পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি অজস্র স্বীকৃতি। ১৯৯১-তে বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি প্রাপ্তিতে অশ্রুজল আর আড়ালে থাকেনি, কান্নাবিধুর কণ্ঠে বলেছেন, এ সম্মানের কি যোগ্য আমি? কোন কীর্তিতে এ-যোগ্যতার যথার্থ উপমা? বলতেন, যখন গান করেন, গানটিকে নাকি স্পষ্ট দেখতে পান তিনি!
যখন গাইতেন ‘নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া’, ওই সামান্য পরিসরেই মুক্তি আর মায়ার বিস্তর ফারাক না-বুঝে উপায় থাকত না শ্রোতার! ‘নৃত্যের তালে তালে’-র অন্তিম পর্বে ‘তাণ্ডব’, ‘কম্পিত’, ‘সুন্দর’, ‘শঙ্কর’, ‘ভয়ঙ্কর’— এদের প্রতিটি স্বরক্ষেপে স্বরলিপির নির্দেশ আর উচ্চারণের অব্যর্থ ভিন্নতা, কে যে কার উপমা হয়ে ওঠে, তা বোঝা ভার! চিত্রাঙ্গদা বলে ‘সে নহি নহি’ আর কমলিকা হাহাকার করে, ‘কে জানে কোথা সে বিরহহুতাশে/ ফিরে অভিসারসাজে’; দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্তি নিজেদের মুক্তি-বন্ধন-মায়ার বালাই নিয়ে সার্থক বেজে ওঠে!

এমন সব মুহূর্তের মিশেলেই কি তাঁর যোগ্যতার গোটা গল্প? ১৯৬৯ সালের কথা। সুচিত্রা মিত্র তখন খ্যাতির তুঙ্গে। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার এক সাদামাঠা বাড়ির একতলার মাঝারি ঘরে দু’টিমাত্র সিলিং ফ্যান। একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মূলত স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে কাজ করে, তার আমন্ত্রণে সুচিত্রা গাইবেন।
বিনা মাইক্রোফোনে। আগের রাত থেকে জ্বর, গলা বেশ খারাপ। সঙ্গত বলতে হারমোনিয়াম আর তবলা। গাইতে বসেই সামনের স্কুলপড়ুয়া শ্রোতা আর তাদের অভিভাবকদের বললেন, গলা খারাপ খুব, তাই গলা খারাপের গান দিয়ে শুরু করব। ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল ভুলায়ে’-তে সূচনা, মোট চোদ্দোটি গান। এ কিন্তু কোনও বিশেষ ঘটনা নয়। সুচিত্রা মিত্রের মর্জি, নিবেদন আর যোগ্যতার নিরিখে নিতান্তই নির্বিশেষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement