ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও অন্য সমাজমাধ্যমগুলি গোড়ার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে আনন্দের উৎস ছিল। এখন দেখছি ক্রমশই তা অনেকের জন্য মনোরোগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফোমো, বা ফিয়ার অব মিসিং আউট, এখন একটা চলতি শব্দ। এর প্রয়োগ মূলত সমাজমাধ্যমে অন্যের আনন্দ-ফুর্তির পোস্ট দেখে বিষণ্ণ বোধ করা, কেন জগতের এই আনন্দযজ্ঞে কেউ অনিমন্ত্রিত! কাছের বা দূরে থাকা পরিচিত বন্ধুবান্ধব, বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ছবি আর ভিডিয়ো ভাগ করে নিয়ে যোগাযোগ রাখা মানসিক ভাবে আমাদের আনন্দই দেয়। বহু দিনের হারানো বন্ধুদের ফিরে পাওয়াও কম আনন্দের নয়। কিন্তু তার পর আস্তে আস্তে কারও কারও ‘দেওয়ালে’ সে সব পোস্ট আত্মপ্রদর্শনী হতে শুরু করে। ‘লাইক’-এর লোভে, হাততালি পাওয়ার আনন্দে, ‘আমিও আছি’-র ভিড়ে অজানতেই আমাদের রুচির অবনমন ঘটতে থাকে।
মানুষের সুপ্ত আত্মপ্রচারের লোভকে কি উস্কে দেয় এই সমাজমাধ্যমগুলি? কার নতুন জামা হল, কার গয়না হল, কে নতুন গাড়ি কিনল, কার সন্তান দারুণ রেজ়াল্ট করেছে, কার বই বেরোল, কার ঘরে কী সুখাদ্য রান্না হল, এগুলি কেবল বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন মনে হতে থাকে। যেন কবির কথা সত্যি করে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন সত্যিই ‘নিয়ন আলোয় পণ্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! যেন সবাই সুখী, দুঃখের কোনও নিশানা নেই কারও ঘরে। যেন বুদ্ধের উপদেশ আমাদের আবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে, সেই গৃহ থেকে নিয়ে এসো এক মুষ্টি শস্য, যে গৃহে কোনও দুঃখ, রোগ, জরা, মৃত্যু, নিরানন্দ নেই! আত্মঘোষিত ‘সুখী’ গৃহকোণগুলির বিজ্ঞাপন দেখে অন্যের বিষাদ কেবল বেড়ে চলে। এমনও বলেন কেউ কেউ যে, “এমন একটা পোস্ট দেব যে ওদের গা জ্বলবে!” ‘ওদের’, অর্থাৎ অনিমন্ত্রিতদের!
পাশাপাশি, উপমহাদেশে রাজনৈতিক দলগুলি যেমন সমাজমাধ্যমের ফয়দা তুলছে, তেমনই ধর্মের ধ্বজাধারী কিছু গোষ্ঠী চালিয়ে যাচ্ছে মিথ্যা প্রচার এবং হিংসার সর্বনাশী বিষবিতরণ। জ়াকারবার্গের কলেজজীবনে সহপাঠিনীদের মধ্যে কে সেরা সুন্দরী বেছে নেওয়ার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল যে নতুন যোগাযোগের সেতু তৈরির সমাজমাধ্যম, তার পরিণতি তবে এই দাঁড়াল?
সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু গবেষণায় সমাজমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার কুফল নিয়ে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। দুশ্চিন্তা, চাপ, মনোরোগ, ঘুমের সমস্যা, স্বাস্থ্য, আত্মহত্যা, ও আসক্তি— এই সমস্যাগুলি দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে বেড়ে চলেছে। স্টিভেন্স, হাম্ফ্রি, ও অন্য গবেষকরা দেখিয়েছেন যে চাপমুক্তির আশায় ছাত্রছাত্রীরা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস, ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা বিপুল হওয়াই সামাজিক অনুমোদনের ইঙ্গিত, এবং এর ফলে শরীর সুস্থ এবং মন ফুরফুরে থাকে। কিন্তু তাঁরাই সমীক্ষায় জানাচ্ছেন, অপরিচিত বন্ধুত্বের আমন্ত্রণে তাঁদের উদ্বেগ বাড়ছে। অন্তত এক-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা জানাচ্ছেন যে তাঁরা ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’-এর উত্তর দিতে দীর্ঘসূত্রিতা করেন, কারণ অনুরোধকারীর উদ্দেশ্য কী, এঁরা পরে কী আচরণ করবেন, সেটা বলা মুশকিল। আরও এক-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা জানান যে, কারও বন্ধুতালিকা থেকে বাদ পড়লে, বা ‘আন-ফ্রেন্ড’ করলে তাঁদের অপমান ও হতাশা তৈরি হয়। ফেস্টিঙ্গার তাঁর সামাজিক তুলনাতত্ত্বে বলেছিলেন, আমরা আমাদের সমতুল বা আমাদের চেয়ে সামাজিক উচ্চস্তরে আছেন যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করি, যার স্বাভাবিক পরিণতি হল বিষাদ। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে এই সামাজিক তুলনাতত্ত্বের প্রভাব ভয়ানক। পোস্টে যথেষ্ট ‘লাইক’ না পেলে গ্রাহকরা মনোকষ্টে ভোগেন।
সবচেয়ে ভয়ানক তথ্য হল— গত কুড়ি বছরে বিশ্বজোড়া আত্মহত্যার সংখ্যা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। এবং এর একটি কারণ হল আত্মহত্যার বিশদ উপায় জানার জন্য সমাজমাধ্যমের পোস্টের চেয়ে ভাল রসদ আর কোথাও নেই। সমাজমাধ্যমে আসক্তি এখন নটিংহ্যাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা একটি ক্লিনিক্যাল রোগ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। শতকরা আট জন টিন-এজার, যাঁরা দিনে পাঁচ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে সমাজমাধ্যমে সময় কাটান, তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দু’-ঘণ্টার কম সময় ব্যয় করা ছেলেমেয়েদের তুলনায় তিনগুণ বেশি! এ ছাড়া
যাঁরা রাতে ঘুমোনোর আগে উত্তেজনাকর পোস্ট পড়েন বা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে, বুদ্ধিবৃত্তির অবনতি ঘটছে, এবং স্বাস্থ্যের নানা ক্ষতি হচ্ছে।
এই লেখাটির উদ্দেশ্য সমাজমাধ্যমগুলির কেবল সর্বনাশা দিকগুলি বিচার করে তাকে বর্জন করতে বলা নয়। অস্বীকার করা যায় না, এর নানা আনন্দ এবং গুণের দিক তো আছেই। করোনাকালে লকডাউনের সময় বহু মানুষ তাঁদের স্বজনবন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে শান্তি পেয়েছেন এই সমাজমাধ্যমেই। স্কুল-কলেজের অনলাইন ক্লাসও সম্ভব হয়েছে এই প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু কোভিড-কালেরও দুই বছর হতে চলল, এখন কি আমাদের এই মায়াজাল থেকে মুখ ফিরিয়ে আসল পৃথিবী ও মানুষের দিকে একটু ভাল করে তাকানো উচিত নয়?
সচেতনতা ও ভারসাম্যের বোধ থাকলে সমাজেরই কল্যাণ। কিশোর ও তরুণ মনে যাতে এই মাধ্যমগুলি এর কুফল বিস্তার না করতে পারে, তার জন্য গবেষক গগন দীপ তাঁর ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ওয়েল বিয়িং পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, প্রধানত তিনটি উপায় কার্যকর হয়েছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায়— এক, শিক্ষা এবং সচেতনতা; দুই, পাঠ্যক্রম বহির্ভূত নানা কাজে ব্যস্ত থাকা; এবং তিন, সমাজমাধ্যম ব্যবহারে সীমালঙ্ঘন না করা। এর মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয়েছে শিক্ষা এবং সচেতনতা। স্কুল কলেজ ও অভিভাবকদের সমাজমাধ্যমের ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে ছেলেমেয়েদের অবহিত করলে, এবং মিলেনিয়াল প্রজন্মের প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনায় গেলে হয়তো এই কুফলগুলির ক্ষয় হবে। মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি মেশার আনন্দ যে কী, দীর্ঘ এই অতিমারির পর পুনর্মিলনের অভিজ্ঞতা আমাদের তা শিখিয়ে দিয়ে গেল। সামাজিকতার বিকল্প তো বৈদ্যুতিন জগৎ হতে পারে না। মুখোমুখি আদানপ্রদানের বন্ধুত্ব ফিরে আসুক। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেদের উপলব্ধি করার সুযোগ আবার আসুক, একমাত্র তবেই তো প্রকৃত বন্ধুতার পরিবেশ তৈরি হতে পারবে।