সমাজ তো বটেই, বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্রযন্ত্রও সেই আদিকাল থেকে মেয়েদের চরিত্র, চাহিদা, কর্তব্য কিংবা সামাজিক রীতিনীতির মতোই তাদের পোশাক পরিচ্ছদকেও নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। কখনও নরমে, কখনও গরমে। কখনও ঈশ্বর বা ধর্মের ভয় দেখিয়ে, তো কখনও নীতিপুলিশের মাধ্যমে চোখ রাঙিয়ে। কোন পোশাক ‘নারীসুলভ’ কোনটি ‘দেহোপজীবিনী-মার্কা’; কোন পোশাক উচ্চবিত্ত মহিলাদের, কোন পোশাক মধ্য বা নিম্নবিত্তের; একই পোশাক কখন কোথায় পরা যাবে, বা যাবে না; নারীঅঙ্গের কতটা আবৃত থাকবে, কতটা উন্মুক্ত— সবই মেয়েদের ড্রেসকোডের রুলবুকে চ্যাপ্টার, সাব-চ্যাপ্টার হয়ে ঠাঁই পেয়েছে অবিরাম।
আর, সে নিয়মানুবর্তিতা থেকে বিচ্যুতির শাস্তি হতে পারে মৃত্যুও। ২০২১ সালে উত্তরপ্রদেশে জিন্স পরার অপরাধে নিজের দাদু-কাকারাই পিটিয়ে মারে সতেরো বছরের মেয়ে নেহা পাসোয়ানকে। ২০২২-এ হিজাব না-পরার অপরাধে রাষ্ট্রের নীতিপুলিশের হাতে মৃত্যু হয় মাহশা আমিনির। বছর তিনেক আগে অবধিও আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার একটি স্কুলে ‘মূল্যবোধ’-এর নামে মেয়েদের স্কুলে প্যান্ট বা পাজামাজাতীয় পোশাক পরে আসা নিষিদ্ধ ছিল; এখনও আছে উত্তর কোরিয়া কিংবা সুদানে। পোশাকই যে মেয়েদের যৌন হয়রানির কারণ, নেতা-মন্ত্রী থেকে বিচারক, অনেকের মুখেই শোনা গিয়েছে কথাটি। শুধু ‘অনগ্রসর’ ভারতে নয়, শুধু ‘রক্ষণশীল’ ইসলামিক রাষ্ট্রে নয়, বহু তথাকথিত প্রগতিশীলতার পীঠস্থানেও।
সব সময় যে ছলে অথবা বলেই নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সমাজ বা রাষ্ট্র, তা কিন্তু নয়। কৌশলের প্রয়োগও হয় বিলক্ষণ। প্রায় অর্ধশতাব্দী পুরনো একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৭৪ সাল। নিউ ইয়র্ক সিটি হল-এ শুভপরিণয় সম্পন্ন করতে চায় এক যুগল। বাদ সাধল সেখানকার পোশাক বিধি। নিয়ম অনুযায়ী বিয়েতে কনেকে স্কার্ট বা গাউন পরতেই হবে। কিন্তু, এই যুগল সে নিয়ম মানতে নারাজ। ব্যাপার গড়াল আদালতে। মেয়েটি বলল, “আমার বিয়েতে আমার অঙ্গে আমি স্কার্ট তুলব না ফুলপ্যান্ট, গাউন পরব না পাজামা, তা আমার ব্যাপার। আমি স্কার্টের থেকে ফুলপ্যান্টে অনেক স্বচ্ছন্দ, বিয়েতে আমি তাই পরব। অনুমতি দেওয়া হোক।” হবু বর বলল, “বিবাহ এমন এক পবিত্র বন্ধন, যাতে দু’টি মানুষ সম-অধিকারে, সমশর্তে বাঁধা পড়ে। আমি চাই আমাদের বিয়ের পোশাকেও সেই সাম্য বজায় থাকুক। আমার হবু বৌকে বিয়েতে আমার মতোই শার্টপ্যান্ট পরতে দেওয়া হোক।”
জেলা আদালত হবু দম্পতির বিপক্ষে রায় দিলে, মামলা গড়াল ফেডারাল কোর্টে। তখন ইউরোপ, আমেরিকায় নারী আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রবাহ চলছে। বছর কুড়ি আগেই প্রকাশিত হয়েছিল সিমন দ্য বোভোয়া-র দ্য সেকেন্ড সেক্স। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে লেখা হয়েছে এমন কিছু বই, যা নারী আন্দোলনকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে— শুলামিথ ফায়ারস্টোনের দ্য ডায়ালেক্টিক অব সেক্স, জার্মেন গ্রিয়ারের দ্য ফিমেল ইউনাক, ইভা ফিগস-এর প্যাট্রিয়ার্কাল অ্যাটিটিউড আর কেট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিক্স, যেখানে নারীশরীরকে পিতৃতন্ত্র কী ভাবে কেবল পুরুষের যৌনবাসনা মেটানোর হাতিয়ার করে রেখেছে, তার পরিচ্ছদকে কী ভাবে নারীক্ষমতায়নের বিপরীতধর্মী করে প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, তা-নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। নারীবাদের বাতাস যখন এমন ঝাপ্টা দিচ্ছে, তখন যে গায়ের জোরে পোশাকের মামলার নিষ্পত্তি হবে না, ফেডারাল কোর্ট সম্ভবত সে কথা বুঝল। জানাল, “কোন বিয়েবাড়িতে কে কী পরবে, এ সব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় এত বড় আদালতের নেই। তোমরা জেলা আদালতের সঙ্গেই বোঝাপড়া করে নাও।” জেলা আদালত বিরুদ্ধ মত দিয়েই রেখেছিল, তা-ই বহাল রইল। নারী আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝেই নিউ ইয়র্ক সিটি হল-এ বিয়ের দিন কনের সনাতনী পরিচ্ছদের ফতোয়া বহাল রইল।
এ ভাবেই রাষ্ট্র ও সমাজ সুকৌশলে এক দিকে নারীপরিচ্ছদকে নারী মর্যাদার, এমনকি নারী অস্তিত্বেরই প্রধান হাতিয়ার করে প্রতিষ্ঠা করেছে, আবার অন্য দিকে প্রয়োজন অনুসারে তাকেই ‘ছোটখাটো ব্যাপার’ বলে এড়িয়ে গিয়েছে। একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। গত বিধানসভা ভোটের আগের ঘটনা। কোন দলকে ভোট দেওয়া যায়, কাকে মোটেই দেওয়া যায় না, এ সব বাগ্বিতণ্ডায় অফিস ক্যান্টিন সরগরম। প্রত্যেকে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলের পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে, বিরোধী পক্ষকে তুলোধনা করছে। এরই মাঝে এক মহিলা সহকর্মী বললেন, “যা-ই বলো না কেন, আজকাল কিছু রাজনৈতিক দল যে ভাবে মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারটায় ফতোয়া জারি করছে, ভয় করে, এরা ক্ষমতায় এলে এ রাজ্যের মেয়েদের কী হবে।” তৎক্ষণাৎ অপর এক মহিলা সহকর্মী বলে উঠলেন, “আসলে কী বলো তো, এ দেশে সন্ত্রাস, দারিদ্র, মূল্যস্ফীতি… ভাবার মতো এত বিষয় আছে যে, মেয়েদের ড্রেসপত্তরের মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কে কী বলেছে, তা ভেবে কি আর ভোট দেওয়া যায়? না কি দেওয়া উচিত?”
সত্যিই তো। এত বড় দেশ, এত কোটি মানুষ, এত রকম সমস্যা। সেখানে পোশাকআশাকের নিয়মনীতি ভাঙার অপরাধে নেহা পাসোয়ানরা কৈশোর পেরোনোর আগে যতই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুক না কেন, তা ‘ছোটখাটো বিষয়’ হয়েই থাকবে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার সময় তা নিয়ে একটুও ভাবব না। ঘাড় ঘুরিয়ে বলব না, জীবন আমার, পোশাকও।