সকলের বসার জন্য যে বড় ঘরটি আছে, ‘প্রত্যয়: মনের মতো ঘর’-এ, সেখানে আবাসিকেরা যে যার মতো গল্প করছেন, টিভি দেখছেন। সুস্থ মনোরোগীদের সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য কিছু দিন আগে উদ্বোধন হয়েছে এই বাড়িটির। বড় বড় নেতা-মন্ত্রী, প্রচার-আড়ম্বর দেখে আবাসিকরা হয়তো তাঁদের আগামী জীবনের সম্ভাবনা সম্পর্কে খানিক ভরসাও পেয়েছেন। হাসপাতাল-জীবন শেষ করে, কে কী ভাবে জীবন চালাবেন, এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। স্বপ্না রান্না করবেন বলে ভাবছেন। শুরুটা হয়েছিল, মাছ কেটে হলুদ মাখানো থেকে। “সব শেষে চামচ দিয়ে একটুখানি ঝোল হাতে নিয়ে জিভে দিয়ে দেখব, নুন-ঝাল ঠিক আছে কি না।” হাসপাতালে আসার আগে ভাস্কর দীর্ঘ দিন গান শেখাতেন। ওঁর তালিম উস্তাদ রাশিদ খানের কাছে। অনেক দিন বাদে ফের গান গাইছেন। একটা স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম পেলে রেওয়াজটা নিয়মিত শুরু করতে পারবেন।
এরই মধ্যে টিভি থেকে ছিটকে এল কয়েকটা শব্দ। এক প্রাক্তন মন্ত্রী বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতার সম্পর্কে বলছেন, তিনি ‘হিংস্র পাগল’। আবার শাসক দলের এক শীর্ষ নেতা সম্পর্কে বিরোধী দলের এক বিধায়ক বলছেন, “উনি তো পাগল-ছাগল।” খানিক পরে আর এক নেত্রী অন্য দলের নেতাকে ‘পাগল’ বলেই ক্ষান্ত হলেন না, ফিরতি টিকিটে রাঁচীতে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে বললেন।
এই সব কথায় ভবিষ্যতের ছবি আঁকার চেষ্টাগুলো থমকে গেল। আবাসিকেরা এ ওর দিকে চাইলেন। তার পর সকলেই চুপ করে গেলেন। তাঁদের অসুখটা কী করে গালাগালির শব্দ হতে পারে, সেটা বোঝার মতো ‘সুস্থ’ কি তাঁরা কখনও হয়ে উঠবেন? এই নেতাদের রাজনৈতিক যুক্তিবোধের দেউলিয়াপনা নিয়ে কোনও কথা হবে, প্রতিবাদ হবে— সে প্রত্যাশা আজ দুরাশা।
তবু এই নেতারাই তো রোজ কথা বলবেন জনসভায়, সংবাদমাধ্যমে। তাই না বলে পারা যায় না যে, ‘পাগল’ এবং ‘হিংস্র’ এক সঙ্গে উচ্চারণ করলে সেই সময়ের মানসিকতা প্রকাশ পায়, যখন মনোরোগীদের সমাজ থেকে ব্রাত্য করা হত। মানসিক হাসপাতালগুলির দেওয়াল উঁচু করে জনমানসের আড়ালে রাখা হত। নির্জনে কয়েদবাস ছিল মনোরোগীর ‘শাস্তি’। বহু কষ্টে সমাজের এই মানসিকতা বদলের চেষ্টা করছেন সমাজকর্মীরা। নেতা-মন্ত্রীদের এমন এক-একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের ফলে সে কাজটা এক ধাক্কায় অনেক দূর পিছিয়ে যায়। হিংস্রতার সঙ্গে পাগলামিকে সরলরেখায় যোগ করার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, এ কথা আজ আর অজানা নয়। অতিশয় বুদ্ধিমান, মেধাবী ব্যক্তিও মনোরোগে আক্রান্ত হতে পারেন, হচ্ছেন, তা-ও সবাই জানেন। তবু কেন হিংস্র আচরণের সঙ্গে মনোরোগের যোগ টানা হয়, কিংবা নির্বোধ, বুদ্ধিহীন বোঝাতে মনোরোগীর প্রসঙ্গ টানা হয়, এ প্রশ্নগুলো বার বার তোলা চাই।
প্রশ্ন করা চাই মনোরোগীদের মতো প্রান্তবাসী, বিপন্ন মানুষদের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি দরদ প্রদর্শন প্রচলিত ভোট-রাজনীতির একটা চেনা ধরন। কেন্দ্র আর প্রান্তের এই সম্পর্কটা ঠিক করে দেয়, অধিকার, অপমান, অনুগ্রহ, পাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি কোনটা কোন অভিমুখে থাকবে। রাজনৈতিক ভাষ্যের মধ্যে যত রকম ভাবে ঢুকে পড়ে প্রান্তিক মানুষদের প্রতি অবজ্ঞা, তত নীতিগত বিরোধিতার জায়গা নেয় কোন্দলসর্বস্ব, ব্যক্তি আক্রমণের রাজনীতি। এই ভাবেই বিভিন্ন সময়ে অন্যদের হিজড়ে, যৌনদাসী, দেহপসারিণী, চুড়ি-পরা মেয়ে— এবং তার সঙ্গে পাগল— এ সব সম্বোধনে বাজি মারতে চান।
ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়া, তার কাছাকাছি থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয়। তাঁরা কখনও চুপচাপ আমোদ নেন, কখনও কোমর বেঁধে যুক্তি সাজাতে নেমে পড়েন। সেই যুক্তির মধ্যে শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ বা রামপ্রসাদ কত বার পাগল শব্দ ব্যবহার করেছেন ইত্যাদি। এঁরা কনটেক্সট বা প্রসঙ্গের গুরুত্ব ভেবে দেখেন না। ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর মতামতই আজকাল গণমাধ্যমে অনেক বেশি জায়গা পায়। তাঁদের কথা নিয়ে বিতর্ক চলে।
কিন্তু এই বিতর্কে এই গোড়ার প্রশ্নটা কেউ তোলেন না যে, বিপক্ষকে খাটো দেখানোর জন্য মনোরোগকে ব্যবহার করা কেন ঘৃণা-ভাষ্য বা ‘হেট স্পিচ’ হিসেবে গণ্য হবে না? মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই আছে, কিন্তু ঘৃণা বা হিংসার উদ্গারের অধিকার কারও নেই। এই দুটোর মধ্যে সামাজিক সীমারেখা টানতে অসুবিধে কোথায়? সরকার তার নানা উদ্যোগকে আইন দিয়ে নির্ধারণ করে, কিন্তু আইনের কথার জোর সমাজে কতটুকু? প্রান্তিক মানুষের কাছে আইনের ব্যবহারের সুবিধেও তাই প্রান্তিক হয়ে থাকে। আইনি বন্দোবস্তের থেকে জানাশোনা, দৈনন্দিন কথাবার্তা, সাধারণ বোধবুদ্ধির ভূমিকাই সমাজে বেশি প্রত্যক্ষ। সেখানে ক্ষমতাকেন্দ্রের নিকটবর্তী মানুষগুলো অনেক কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেন সমাজেও, তাঁরাই সামাজিক মান্যতা পান, ‘মাতব্বর’ বলে গণ্য হন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বক্তব্য কখনওই এই নেতাদের কাছে এসে পৌঁছয় না, তাঁদের ভাষার উপরে কোনও ছাপ ফেলতে পারে না। বরং প্রান্তিকদের পরিচয়কে গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে তাঁদের প্রতি সামাজিক তাচ্ছিল্য ও বিদ্বেষের মনোভাব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
প্রান্তিক পরিচয় গালাগালি হিসেবে গণ্য হতে পারে না। এটা আইনের বিষয় ততটা নয়, যতটা সচেতনতার বিষয়। কেন সেই চেতনা দেখা যাচ্ছে না? আমাদের নেতারা সকলেই সংবেদনহীন, বোধবুদ্ধিশূন্য, এমন তো ধরে নেওয়া চলে না। তা হলে কেন প্রতি দিন এই ভাষাসন্ত্রাস, যা বিপন্ন করছে মনোরোগী-সহ নানা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে?
ক্ষমতার আশেপাশের মানুষেরা যখন রাজনৈতিক চেতনার শক্তিতে ভরসা রাখতে পারেন না, নেতার যোগ্য সম্মান ও গাম্ভীর্য বজায় রাখার ক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস হারান, সম্ভবত তখনই অন্যের প্রতি দাঁত খিঁচোনোর বিকল্পকে শ্রেয় মনে করেন। কোনও এক ‘অপর’-কে অনবরত আক্রমণ করাই তাঁর কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকাশ বলে মনে হতে থাকে। সেই আক্রমণ সমাজে কাকেআহত করল, তা দেখার সময় তাঁর থাকে না। যে কোনও বিরোধী স্বরকে এই দাঁত বার-করা হিংস্রতা দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো আমরা অহরহ দেখি। সেই সঙ্গে প্রান্তবাসীর পরিচয়কেও তাঁরা নির্বিচারে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। কখনও দলিত বা জনজাতির পরিচয়, কখনও প্রতিবন্ধীর পরিচয়, কখনও লিঙ্গপরিচয়, কখনও মনোরোগীর পরিচয় বিপক্ষের উপর আরোপ করে তাঁকে অপদস্থ করতে চান। তার ফলে দলিত-জনজাতির মানুষ, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ বা মনোরোগী নিজের সামাজিক পরিবেশে আরও কতটা বিপন্ন হল, তাঁদের আত্মপ্রত্যয় কতখানি বিপর্যস্ত হল, তা ভাবার সময় নেতাদের কোথায়? তাঁরা তখন আরও তীক্ষ্ণ, আরও মর্মভেদী কোনও অস্ত্র খুঁজতে ব্যস্ত। রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক, উন্নয়নের কাজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কঠিন। আরও কদর্য গালাগাল ছোড়াছুড়ির প্রতিযোগিতা সহজ।
অন্য দিকে, বাক্যে হিংসার এই স্রোতের সামনে আরও নীরব হয়ে যান অধিকাংশ মানুষ। দেখেও কিছু না বলার অভ্যাস শাসককে সাহস দেয়, এই হিংস্রতাকে বৈধতা দেওয়ার, তাকে জাতীয় স্থাপত্যের অংশ করে তোলার। সিংহকে যথাযথ হিংস্র করে তুলতে গিয়ে, প্রাচ্যের শিল্পরীতির বদলে পাশ্চাত্য শিল্পরীতিতে অধিকতর ভরসা দেখানোতে জাতীয় ঐতিহ্যের বোধ কোথাও আহত হয় না। বরং বিরোধিতার শব্দগুলোকেই অসংসদীয় বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা ভাষার ব্যবহারে সংযম দাবি করেন, তাঁরাই এখন প্রান্তিক।