তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর মহানগরের জনসাধারণ ব্যাপক প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, দিনে রাতে পথে নেমে আওয়াজ তুলেছিলেন: ন্যায়বিচার চাই। মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নিহত তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যু অন্যান্য নারীমৃত্যু ও অবমাননার ঘটনার থেকে জনমানসে অধিক ছাপ ফেলেছিল স্বাভাবিক ভাবেই। গ্রামের মহিলাদের উপর নিরন্তর অত্যাচার অথবা শহরে কর্মরত শ্রমজীবী মহিলাদের নিরাপত্তার অভাব নিয়ে যে মধ্যবিত্ত মানস আতঙ্কিত হয়নি বা আলোড়িত হয় না, এই ক্ষেত্রে তার এই প্রতিক্রিয়া আকস্মিক নয়। বরং অনেকে ভেবেছিলেন, নির্যাতিতা তরুণীর বিচারের দাবির সঙ্গে নারীসুরক্ষা নাগরিক পরিসরে এক প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে। শ্রমজীবী নারীর সুরক্ষা গার্হস্থ হিংসার থেকে মুক্তি ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে জনআন্দোলন এক অভিনব রূপ নেবে, মহানগর পথ দেখাবে।
মেক্সিকোর মতো নানা দেশে এমন সুরক্ষার দাবিতে মেয়েরা নতুন গণআন্দোলন সৃষ্টি করেছেন। যৌনকর্মীদের সুরক্ষার দাবিতে ব্যাঙ্ককে সামাজিক সমাবেশ হয়েছে। যেমন হয়েছে আমার পরলোকগত বন্ধু ড. স্মরজিৎ জানার নেতৃত্বে এই মহানগরেও।
বলা চলে ৯ থেকে ২০ অগস্ট পর্যন্ত ছিল আন্দোলনের প্রথম পর্যায়। তার পর শুরু হল উচ্চতম ন্যায় আদালতের হস্তক্ষেপে আলাপ আলোচনাকে ঘিরে দ্বিতীয় পর্যায়। বিচারপ্রক্রিয়ার কাটাছেঁড়া, প্রচুর খরচ করে ডাক্তারবাবুদের এই বিচারপ্রক্রিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়া এবং যুক্ত হওয়া। চিকিৎসক সমাজ সঙ্ঘবদ্ধ হল। কর্মবিরতি চলতে লাগল। রোগী ফেরানো শুরু হল। ৬-৮ ঘণ্টা জিবি মিটিং বা সাধারণ সভা হতে লাগল। তরুণ চিকিৎসকেরা নিজেদের দাবি তুলে ধরতে লাগলেন। তাঁরা ধরে নিলেন যে, সিবিআই তদন্ত করে তাঁরা যা চাইছেন, সেটাই ঘোষণা করবে। উচ্চতম আদালত তাঁদের কথায় সিলমোহর দেবে। সরকারের মুখ পুড়বে। জনবাদীদের রূপ উন্মোচিত হবে। এই হল আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। অগস্ট মাস কেটে গেল চিকিৎসকদের এই সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ায়।
ইতিমধ্যে নারীসুরক্ষার দাবি ধীরে ধীরে পিছনে সরে গেল। আজ সে দাবি বলা চলে অন্তর্হিত। এমনকি নিহত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার চাই, এই আওয়াজও যেন গৌণ। তরুণ চিকিৎসকদের নিজেদের পেশাগত দাবিসনদ গুরুত্ব পেয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই গণআন্দোলন অথবা জনআলোড়ন রূপান্তরিত হয়েছে চিকিৎসক বনাম সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা যুদ্ধে।
প্রশাসনের সঙ্গে কথাবার্তা বা আলোচনার সাধারণ প্রত্যাশাকে হাতিয়ার করে চিকিৎসকদের নিজস্ব সংহতি বেড়েছে। এবং এই সংহতি অর্জিত হয়েছে সামাজিক ব্যাপকতাকে ত্যাগ করে। রাজনৈতিক সমর্থন এসেছে প্রান্তিক মানুষের এবং বিশেষত শ্রমজীবী নারীর সুরক্ষা ও কল্যাণের দাবিকে বিসর্জন দিয়ে। চিকিৎসকদের সমর্থন যত রাজনৈতিক প্রকৃতি ধারণ করছে, তত সামাজিক প্রেক্ষাপট দূরে সরে গেছে। সিবিআই, কোর্ট, সিনিয়র ডাক্তারদের নিজস্ব পেশাগত বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানগুলির ব্যবসায়িক খেলা, এই সব পদ্ধতি প্রতিষ্ঠান ও রীতি ব্যবহার করে চিকিৎসক সম্প্রদায় আজ এক সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত।
এই বাস্তবতা অস্বীকার করার জন্য স্বর উচ্চগ্রামে নিয়ে গেলেও যা নিয়তি, তা হবেই, হচ্ছে। শ্রেণিসমাজের এই বৈশিষ্ট্যকে কে দূর করে দিতে পারে? আন্দোলনের এই তৃতীয় পর্যায় এখনও চলছে। সমাজ শঙ্কায় ভুগছে। প্রাণহানি, সংঘর্ষ, ধরপাকড় এ সব থেকে মুক্তির আশায় মহানগর দিন গুনছে। উৎকণ্ঠিত মানুষের প্রশ্ন: এই সমস্যা কবে মিটবে? মধ্যবিত্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায় না, প্রাধান্য চায়। চিকিৎসক সমাজ শ্রদ্ধা চায় এবং অনুগত রোগী সমাজ চায়। প্রান্তিক মানুষ মধ্যবিত্ত সমাজের অলিখিত নিয়মও মানতে চান না, রোগী পরিষেবা না পেলে তাঁরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। যেমন খাবার না পেলে অভুক্ত জনগণ বিক্ষোভে গর্জে ওঠেন।
এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার দু’টি দিক লক্ষণীয় এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য চিহ্নিত। প্রথম, নাগরিক পরিবেশে এই স্বতঃস্ফূর্ত আলোড়ন কী ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্যের অধীন হয়। আজকের মধ্যবিত্ত গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকের কেরানিকুল নয়। নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিনোদন, সেবা এবং পরিষেবার ব্যাপক ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের এক স্তরের ক্রমাগত উচ্চমার্গে যাত্রা অব্যাহত। কামনা, আকাঙ্ক্ষা ও ঊর্ধ্বগতি অন্তহীন। পরিষ্কার শহর, চমৎকার পরিষেবা, নিরবচ্ছিন্ন পণ্য সরবরাহ, এই সব যেন নিশ্চিত থাকে। উচ্চস্তরের চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রযুক্তিবিদ, বিনোদন শিল্পী, এঁরা সাংস্কৃতিক অর্থে মধ্যবিত্ত। পেশাগত গোষ্ঠী হিসাবে এঁরা মতামতে হয়তো প্রগতিশীল, কিন্তু এঁরা আকাঙ্ক্ষায় পুঁজি ও অর্থনীতির সুফলের প্রত্যাশী। এঁদের অভিলাষ আজ মহানগরের নাগরিক পরিসরকে নিয়ন্ত্রিত করে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র তো এত সরল নয়। নয়া উদারনীতিবাদী যুগে কর্মক্ষেত্রের এক বিশেষ ধরনের প্রসারের ফলে মধ্যবিত্ত ঘর থেকে দলে দলে মেয়েরা কাজে বেরোচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা, পথেঘাটে সুরক্ষা, গার্হস্থ হিংসা থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি দাবি সমাজে ব্যাপকতর অনুরণন সৃষ্টি করেছে। আমি আগেই বলেছি, শ্রমজীবী মহিলার সুরক্ষার প্রশ্ন অথবা যৌনকর্মীর সুরক্ষার প্রশ্ন নাগরিক অবয়ব পেত না। কিন্তু নারীসুরক্ষা এক সাধারণ প্রশ্ন রূপে আজ নগরসমাজে আবির্ভূত। জনবাদী প্রশাসন এই তাৎপর্য উপলব্ধিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। একাধিক ভ্রান্ত পদক্ষেপ এবং একাধিক অসংবেদনশীল মন্তব্য এই ব্যর্থতার ফল। লক্ষণীয়, নিজস্ব শ্রেণিভিত্তি ও শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি এই সঙ্কটকালেও জনবাদীদের ছেড়ে যায়নি। এই সামাজিক যুদ্ধ তীব্রতর হবে ক্রমশ।
দ্বিতীয়, যে সাংস্কৃতিক পুঁজিতে বলীয়ান হয়ে তরুণ চিকিৎসকেরা আন্দোলনে নেমেছেন ও নাগরিক সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন, তার সামনে জনবাদী পরিভাষা ও প্রত্যুত্তর নেহাতই অকিঞ্চিৎকর। এ যেন এক অসম সামাজিক যুদ্ধ। মেরুদণ্ড, মাথা এ সব নিয়ে প্রচার ও প্রতিদ্বন্দ্বীকে অবমাননা করার পদ্ধতির অভিনবত্ব, পথে বসে পথের উপর ছবি আঁকা, স্লোগানের ভাষা, শব্দকল্পের কেরামতি, সমাবেশের নিত্যনতুন পদ্ধতি শহুরে মধ্যবিত্তকে চমৎকৃত করেছে। প্রচারমাধ্যমের সম্পূর্ণ সমর্থনে এই সাংস্কৃতিক অভিযান ও আক্রমণের সামনে জনবাদীদের প্রত্যুত্তর পদ্ধতি বর্ণহীন দেখিয়েছে। চিকিৎসকদের অবহেলার শিকার সাধারণ রোগীদের হয়ে গ্রামীণ ও আধা শহুরে জনবাদী নেতারা কিছু বললেই তাঁর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সংগঠিত প্রচারমাধ্যম ও বিভিন্ন দলীয় প্রচারযন্ত্র। জনবাদীদের মনে হয়েছে কর্কশ, সংস্কৃতিহীন, অশালীন, ঔজ্জ্বল্যহীন।
এক দিকে সাংস্কৃতিক রসদে বলীয়ান মধ্যবিত্ত বা সঠিক বলতে গেলে উচ্চমধ্যবিত্ত চালিত নাগরিক সমাজ, অন্য দিকে সাংস্কৃতিক রসদহীন প্রান্তিক জনসাধারণের লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াই থেকে কোন পক্ষ কী শিখবেন, সেটা দেখার। জনবাদীরা টিকে থাকে প্রাত্যহিক ঘটনার প্রাত্যহিক উত্তরকে অবলম্বন করে। কাজেই, এ এক সঙ্কট ঠিকই, কিন্তু এমন সঙ্কট আসবে, যাবে, এ সব মুহূর্তকে মোকাবিলা করেই নিম্নশ্রেণির রাজনীতি বইবে। জনবাদীদের দীর্ঘমেয়াদি রণনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। অন্য দিকে, উচ্চবিত্ত সমাজ নিজস্ব অবস্থানকে দৃঢ় করতে রণনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, উচ্চবিত্ত চালিত মধ্যবিত্তদের শ্রেণি অবস্থান মতাদর্শ কোনও বড় ভূমিকা গ্রহণ করে। টেলিভিশনের পর্দায় যখন প্রবীণ চিকিৎসক ঘোষণা করেন, ‘বিশ্বাস করুন, একটি রোগীর মৃত্যু হলে সবচেয়ে দুঃখ পায় দু’জন, রোগীর নিকট আত্মীয় এবং ডাক্তার’, তখন বেশির ভাগ দর্শক বা শ্রোতা এই সব মন্তব্য অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে শোনেন। স্বাভাবিক। প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকদের ক’জন বলতে পারেন, তাঁরা কোনও বৃহত্তর মতাদর্শে চালিত? ক’জন নিম্নবর্গের সেবাকর্মী, যেমন নার্স, অন্য পরিচারিকাবর্গ, হাসপাতালের বর্জ্য পরিষ্কারে নিযুক্ত কর্মীবৃন্দের কথা ভাবেন? তাঁদের ক’জন ভেবেছেন, যে সব দাবিসনদের কথা উঠেছে, তাতে সেবাকর্মে নিযুক্ত নিম্নবর্গের কথা আসেনি কেন?
তাই এই প্রশ্ন ওঠে যে সমগ্র জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নিন্দিত ও ধিক্কৃত করে স্বাস্থ্য পরিষেবায় বেসরকারি পুঁজির লাভের জন্য নামীদামি প্রবীণ চিকিৎসকদের এই প্রয়াস নয় তো? এই প্রবীণ চিকিৎসকদের ক’জন রোগীর ক্ষোভকে সঙ্গত মনে করেন? ক’জন গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কর্মজীবন শুরু করেছেন? ক’জন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে সময় দিয়েছেন?
তরুণ চিকিৎসকদের আকাঙ্ক্ষা, বক্তব্য, ও সমাবেশের অনেকটাই ন্যায্য। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য সঙ্গত বলেই তা বৃহত্তর সমর্থন অর্জন করেনি। তা করেছে কারণ এক মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে এই দাবিগুলো জনপরিসরে এসেছে। নতুবা মহানগরের নাগরিক সমাজ, চিকিৎসক সম্প্রদায়, শিক্ষিত শ্রেণি এমন অনেক ন্যায্য দাবিকে পাশ কাটিয়ে যায়, ঠিক যেমন মৃতদেহ পড়ে থাকলে পথচলতি মানুষ পাশ কাটিয়ে যায়। মধ্যবিত্ত সমাজের আসক্তি, অনাসক্তি, আগ্রহ, অনাগ্রহ সবটাই পরিচিত ইতিমধ্যে।
সামাজিক সমস্যাকে ব্যবহার করে নয়া উদারনীতিবাদী অভিযান এই প্রথম নয়, এই শেষও নয়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষমতা দখল অব্যাহত, তা সে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে কেন্দ্র করে হোক, বা অন্য কোনও সামাজিক সমস্যার কাঁধে চেপে।
জনবাদী রাজনীতি এই সমস্যার দিকে মনোযোগ না দিলে তার পতন অনিবার্য। মহানগর জনবাদীদের সম্মান করবে না। মধ্যবিত্ত কোনও দিন জনবাদীদের মন থেকে স্বাগত জানাবে না। কলকাতা মহানগর আজ গ্রামবাংলা, মফস্সল বাংলা এমনকি নগরের উপান্তের মানুষের থেকেও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ফাটল বাড়ছে, সামাজিক ভেদরেখা গভীর হচ্ছে। এক অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষ বাংলাকে গ্রাস করতে পারে।
জনবাদীদের শিখতেই হবে এই নিয়তিকে কী ভাবে ঠেকানো যায়। সামাজিক যুদ্ধ চলছে। তার পরিণতি অস্পষ্ট।