Communal Distinction in Saraswati Puja

বলছি তোমায়, নালিশ করে নয়

তখন মনে হয়, অন্তত সেই সময়ের গল্পগুলো বলি, যখন জলহাওয়ার মতো সহজ ছিল মিলেমিশে যেতে পারা।

Advertisement

সেখ সাহেবুল হক

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:১১
Share:

বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর কথা বললে, কে জানে, এখনকার ছেলেমেয়েদের হয়তো দু’দশক পরে মনে পড়বে মূলত ধর্মাচরণের কথা। আজ যদি বা না-ও হয়, পরশুর পরের দিন হয়তো সে পুজোও হয়ে দাঁড়াবে বিধর্মীদের মাপ নেওয়ার জায়গা। পাশাপাশি বসেই পড়ে রাহুল আর রাশিদ, কিন্তু রাহুলরা জানে, ইতিহাসের ক্লাসে মোগল যুগ পড়ানো হয় যখন, তখন আড়চোখে দেখে এবং মেপে নিতে হয় রাশিদদের। শিক্ষকদেরও কেউ কেউ অনায়াসে উচ্চারণ করেন এমন কথা, যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের গন্ধ উগ্র। এই বিদ্যালয়ের পরিসরে সরস্বতী পুজোর দিন অঞ্জলির লাইনে দাঁড়ালে রাশিদদের কেউ কিছু বলবে না— এ বছর যদি না-ও বা বলে, সামনের বছর বা তার পরের বছরও বলবে না— এমন ভরসা দিতে ইচ্ছা করে খুব; সাহসে কুলোয় না।

Advertisement

তখন মনে হয়, অন্তত সেই সময়ের গল্পগুলো বলি, যখন জলহাওয়ার মতো সহজ ছিল মিলেমিশে যেতে পারা। পশ্চিমবঙ্গের কোনও এক অজ্ঞাতকুলশীল মাধ্যমিক স্কুলের মুখচোরা মুসলমান ছাত্রটির তিলমাত্র অসুবিধা হত না। ফার্স্ট পিরিয়ডের পর দুটো সাইকেলে বেরিয়ে পড়েছিল তিন জন— গন্তব্য প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরের এক স্কুল। ছুটি হওয়ার আগে আবার গোটা পথ ফিরে আসতে হবে। তাতেও কি পরোয়া করত তারা? বড় হয়ে যাওয়ার প্রমাণ এই দায়িত্ব পাওয়া। তখন স্কুলশিক্ষকরা ভাবতেন না যে, এই তিনটি ছেলের মধ্যে একটি মুসলমান কি না। তাঁদের ভাবতে হত না যে, এক জন মুসলমান কিশোর সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করতে গেলে তার কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে কি না।

সে কিশোরের মনে যে সংশয় ছিল না, সে কথা বললে মিথ্যা বলা হবে। মুসলমানের ছেলে মূর্তি পুজোয় শামিল হবে? এই দোটানা তখনও তার পিছু ছাড়েনি। আব্বা বোঝালেন, “তুমি মূর্তিপুজো করছ না। এটাকে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসাবে দেখো। সব বাঙালির সংস্কৃতি। তোমার ইমান— তোমার ধর্ম— তোমার কাছে অক্ষুণ্ণ থাক।” ছেলেটি বুঝতে শিখল, অন্তত এই বাংলায় এই পুজোয় ধর্মীয় আচারই একমাত্র নয়, এই পুজোয় যোগ দেওয়া আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উৎসবে শরিক হওয়া। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সেটিকে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করা। ছেলেটির ধর্মবিশ্বাসী আব্বার পক্ষে এ কথাটি বুঝিয়ে বলতে সমস্যা হয়নি; তাকে সরস্বতী পুজোর অংশ করে নিতে বাধেনি স্কুলের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মাস্টারমশাইদেরও। “শিক্ষাঙ্গনে পুজো-আচ্চা-ধর্মাচরণ কি সমর্থনযোগ্য? ‘সংস্কৃতি’ বলে যা চালানো হয়, তা আসলে সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের রূপ নয় তো?”— এ সব প্রশ্ন মনে আসার মতো বয়স তখনও হয়নি ছেলেটার। স্কুলে যদি সরস্বতী পুজো হতে পারে, তা হলে ইফতারের মজলিশও হবে না কেন, সেই প্রশ্নও তার মাথায় আসেনি। সে তখন শুধু জানে, এই সুখযাপন আর বন্ধুরাই সব কিছু। সে তখনও জানে, ‘সরস্বতী বিদ্যাবতী’-কে খোলা চিঠি দিতে পারে সবাই।

Advertisement

তার পর হল নাটকের মহড়া— ছেলেরা মঞ্চস্থ করবে চোখে আঙুল দাদা, মেয়েরা চিত্রাঙ্গদা। এ ছাড়া অন্যান্য আন্তঃশ্রেণি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলছে, যার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হবে সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানমঞ্চে। সেই সঙ্গে বাৎসরিক পত্রিকা প্রকাশ। সব মিলিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-অভিভাবকরা মিলে কয়েক দিনের সাংস্কৃতিক আনন্দোৎসব। ক্রমে দিন এগিয়ে আসে। কুল খাওয়া যাবে কি না, সেই টানাপড়েনে কয়েক জন কুল খেয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে ‘দেখিস ফেল করবি’ মতবাদকে।

তারই ফাঁকে বইল বসন্তের বাতাস। কারও কারও খাতার শেষ পাতায় আনকোরা পদ্যের পদচারণ। পুজোর দিন সকালে পুরোহিত খোঁজার ধুম, সব খতিয়ে দেখার আবহেই নির্দিষ্ট দিনে পাঞ্জাবির দল মিলে গেল শাড়ির ঝাঁকে। গোল হয়ে ঘিরে আড্ডা। ছেলেটি লাজুক। কিছুতেই বলতে পারে না মনের কথা। সারা দিন বকবক করা ছেলেটা মোক্ষম সময়েই বোবা হয়ে যায়। যেন কল্পনার দুনিয়া থেকে নেমে এসেছে সে কিশোরী, ধীর পায়ে। পরনে মায়ের শাড়ি। অঞ্জলির ছলে এক মুঠো ফুল তার দিকে ছুড়ে দিয়ে কিশোর হৃদয় ধন্য হতে চাইছে। এ দিকে বুকে দুরুদুরু। বসন্ত পঞ্চমীর দিব্যি, সে সংখ্যালঘু কিশোর জানত না ‘লাভ জেহাদ’ কাকে বলে। জানত না, এমন ভীরু ভালবাসাকেও কারও মনে হতে পারে ধর্মযুদ্ধের আয়ুধ। কে জানে, এ বছর এমনই কোনও কিশোর এই ভাল লাগার কথা নিজের কাছে স্বীকার করার আগে এক বার শিউরে উঠবে কি না।

ভোগের পাতে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি। বন্ধুরা সঙ্গে থাকায় স্বাদ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। স্কুলের পর পাড়ার পুজোয় ঘোরাঘুরি। বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া। এমনই ছিল ফেলে আসা বসন্তদিন।পর দিন, প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে চোখে জল এল সেই কিশোরেরও— ‘সারা বছর মন দিয়ে পড়ব, মা’, এ কথা নিজের মনে উচ্চারণ করতে দ্বিধা হল না এক বারও। মা সরস্বতীরও যে ধর্মীয় ভাগ হয়, সে কথা সেই অনামা গ্রামের স্কুলের চৌহদ্দি বিশ্বাস করত না। মনে হয়, এমন স্কুলের সংখ্যা এই রাজ্যে অনেক ছিল।

চেষ্টা করলে শুধু সেটুকুও কি ধরে রাখা যায় না? বিদ্বেষের কি এতই জোর?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement