ঠাঁইহারা: পোল্যান্ড অভিমুখী বাসের জন্য অপেক্ষায় ইউক্রেনীয় পরিবার, মারিয়ুপোল, ইউক্রেন ১৭ মে। ছবি: রয়টার্স
সেদিন ছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ল ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার সরাসরি আগ্রাসনের খবর, ছবি। যুদ্ধ শুরুর আগে দেশটা সম্পর্কে পৃথিবীর ঠিক কত সংখ্যক মানুষ কী খবর জানতেন, বোঝা শক্ত। কিন্তু ২৫ তারিখ থেকে দেখা গেল, সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, ভাষা এবং রাজনৈতিক মতামত সম্পর্কিত মানুষরা রাশিয়ার এই অকারণ আগ্রাসী যুদ্ধ-ঘোষণার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইউক্রেনের পতাকার ব্যবহার করে মানুষ এক দিকে ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতি বা সমর্থন এবং অন্য দিকে পুতিন ও তাঁর সমর্থনকারীদের প্রতি বিরোধিতা ও অসহযোগিতার বার্তা দিয়েছেন। ইউএনএইচসিআর বা বিশ্ব-উদ্বাস্তু সংস্থার কমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি মার্চের শেষে মন্তব্য করেন, যুদ্ধ শুরুর এক মাসের মধ্যে ইউক্রেনের মোট এক-চতুর্থাংশ মানুষ গৃহহারা এবং দেশছাড়া হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি, যেখানে এত অল্প সময়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে অন্যান্য দেশ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, সাময়িক আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে।
‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজ়েশন ফর মাইগ্রেশন’ নামে এক সংস্থার মতে, ইউক্রেন থেকে খুব কম করে ৬৫ লক্ষ জন এসেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছেন মহিলারা। মোট ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এখনও ইউক্রেনে আটকে আছেন। সরকার ৯০টি সরকারি বাসের মাধ্যমে রোজ কিভ এবং অন্যান্য শহর থেকে শরণার্থীদের বর্ডার অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ তাঁদের চুক্তিভুক্ত ২৭টি সদস্য দেশে ইউক্রেন থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের তিন বছর থাকার এবং কাজ করার অধিকার দিয়েছে। তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের পাশাপাশি চিকিৎসা, বাসস্থান এবং বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ করেছে। যাঁরা তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে ইউক্রেনে বাস করছিলেন, তাঁদের সাহায্যের জন্য ‘দ্য রিজিয়োনাল রিফিউজি রেসপন্স প্ল্যান’ নামে এক সংস্থা বিভিন্ন এনজিও-কে এক ছাতার তলায় এনে তাঁদের দেশে ফিরে যেতে সাহায্য করছে। শুধুমাত্র বাস্তুহারাদের উৎকণ্ঠা এবং যুদ্ধের আতঙ্ক থেকে তৈরি মানসিক ট্রমার চিকিৎসা খাতে ৯ মিলিয়ন ইউরো বাজেট তৈরি করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ।
ঠিক কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন? ইউএনএইচসিআর প্রদত্ত হিসাবে ইউক্রেন থেকে সংখ্যাটা এই ১০ মে অবধি ৫,৯৮১,৩৫৮। এর মধ্যে সারা বিশ্বে নথিভুক্ত ইউক্রেনের আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ২০২১ সালের জুন অবধি যেখানে ছিল ৫৩,৪৭৪, এই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৬১ লক্ষ। এ ছাড়া শুধু ইউরোপে যাওয়া ইউক্রেনের বাস্তুচ্যুত মানুষদের সংখ্যা আগে যেখানে ছিল ৩৫,৪৯২, বর্তমানে তা ৫০ লক্ষের বেশি। এর মধ্যে কিন্তু অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত এবং যাঁরা একই সঙ্গে দুই দেশের নাগরিক, এই দুই ধরনের মানুষদের হিসাব নেই। অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনের নাগরিকদের মধ্যে ৩০ শতাংশ কিভের বাসিন্দা, ৩৬ শতাংশ পূর্ব ইউক্রেন, ২০ শতাংশ উত্তর ইউক্রেন এবং ৪০ শতাংশ পশ্চিম ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা মানুষ। অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের মধ্যে খাদ্য, নগদ অর্থ, তাঁবু, ফোল্ডিং বিছানা ও শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাপ নিয়ন্ত্রণকারী কম্বলের মতো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। যাঁদের বাড়ি বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের জন্য রিসেপশন সেন্টার তৈরি করেছে।
ইউএনএইচসিআর-এর হিসাবে, ইউক্রেন থেকে বাস্তুচ্যুত আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন পোল্যান্ডে (৩,২৫১,৯৫৫), তার পর রাশিয়ান ফেডারেশন (৭৭২,১২১), রোমানিয়া (৮৮৯,৬৭৪), হাঙ্গেরি (৫৭৭,৮২০), মলডোভা (৪৫৮,২৪২), স্লোভাকিয়া (৪০৬,৮৩৩) এবং বেলারুশ (২৭,১০৮)। অধিকাংশ মানুষ পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়ার মূল কারণ, ইউক্রেনের সঙ্গে এই দেশের স্থানিক নৈকট্য। এ ছাড়া তাঁদের কোনও জাতীয় নথিপত্র দেখিয়ে আশ্রয় পেতে হচ্ছে না। ইউএনএইচসিআর, ইউএন রিফিউজি এজেন্সি এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে হাতে হাত মিলিয়ে পোল্যান্ড সীমান্তে অপেক্ষারত অভিবাসীদের দিয়েছে আবশ্যিক ত্রাণ। পোল্যান্ড আশ্রয়প্রার্থী মানুষদের অতিথি হিসেবে দেখছে, তাঁদের আইডি নম্বর দেওয়া হয়েছে। অনেক পোল্যান্ডবাসী বাড়িতে হতভাগ্য বাস্তুহারাদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়াও হোটেল ভাড়া করেছেন আপৎকালীন পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু কিছু দিন আগেও মুসলমান সিরীয় উদ্বাস্তুদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রশ্নে পোল্যান্ড মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল!
ইউক্রেনের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য দু’টি ‘স্কিম’ গ্রহণ করেছে ব্রিটেন: যাঁদের আত্মীয়-পরিজন ব্রিটেনে থাকেন, তাঁদের জন্য ফ্যামিলি ভিসা, এবং সাধারণ বাস্তুহারাদের জন্য হোমস ফর ইউক্রেন। অন্তত ছয় মাসের জন্য আশ্রয় দিতে পারে। তার জন্য তাঁরা প্রতি মাসে সরকারের থেকে সেই পরিবার জনপিছু পাবেন ৩৫০ পাউন্ড, তিন বছরের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষা। ব্রিটেনে আশ্রয় পাওয়ার জন্য প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ আবেদন করেছেন, কিন্তু আসলে ঠাঁই পেয়েছেন ৭০ হাজার। কিন্তু যে সমস্ত পরিবার মহিলা বাস্তুহারাদের আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে পরিবারের অঙ্গ করে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের থেকে মাসিক ভাতা পাচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই মহিলারা যৌন-হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। আশঙ্কা, এঁদের দ্বিতীয় বারের জন্য বাস্তুহারা হওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
আমেরিকার পরিস্থিতিও ঘোরালো। প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রথমে আশা করেছিলেন, রাশিয়ার সাঁড়াশি আক্রমণে জর্জরিত হয়ে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা ইউরোপেই আশ্রয় চাইবে। শেষ অবধি আন্তর্জাতিক চাপের কাছে মাথা নত করে বাইডেন অন্তত এক লক্ষ উদ্বাস্তুর আমেরিকায় সাময়িক আশ্রয় দেওয়া এবং ইউরোপের পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য ১ বিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করার কথা ঘোষণা করেন। এ দিকে আমেরিকায় নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করে আছেন কয়েক লক্ষ রাষ্ট্রহীন আফগান ও সিরীয় শিকড়হীন মানুষ। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের শরণার্থী পরিবারের জন্য আপৎকালীন সুরক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাও শুরু হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অভিযোগ উঠেছিল যে, রুশ সেনাদের দ্বারা ইউক্রেনের মহিলারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউক্রেনের বিদেশমন্ত্রী মহিলাদের উপর যৌন উৎপীড়নের বহু ঘটনা উল্লেখ করেন। ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী’সহ আরও চার সাংবিধানিক প্রতিনিধি, ব্রিটেনের পার্লামেন্টে দেশের অবস্থার বিবরণ দেওয়ার সময়ও স্পষ্ট উল্লেখ করেন, রাশিয়ার সেনারা কী ভাবে ইউক্রেনীয় মহিলাদের উপর নির্যাতন করছে। রক্ষা পাচ্ছেন না বৃদ্ধা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরাও। শুধু তা-ই নয়, প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ওই ধর্ষণের ভিডিয়ো বিক্রি বা আপলোড করে দেওয়া হচ্ছে পর্নসাইটে।
লক্ষণীয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে অভিহিত করা হচ্ছে প্রথম ‘সোশ্যাল মিডিয়া-ওয়ার’ বলে। কারণ, ‘মিডিয়া’ রিপোর্টের থেকেও সাধারণ মানুষ এখন বেশি বিশ্বাস করছেন রাষ্ট্রনায়ক থেকে সাধারণ মানুষের টুইট, ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুক পোস্টের ছবি, ভিডিয়ো বা কমেন্টকে। ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘ডিজিটাল অবরোধ’ গড়তে সব দেশের ঐকমত্য থাকা উচিত।
অধিকাংশ ইউক্রেনের বাসিন্দা ইংরেজি বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা জানেন না। তার সুবিধে নিয়ে অভিবাসন ফর্ম ফিল-আপ করার সময় শরণার্থীরা না বুঝেই অনেক শর্তে সই করে দিচ্ছেন। বহু মহিলা এ ভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। অনেকে স্বেচ্ছায় পতিতাবৃত্তিকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে যুক্ত হচ্ছেন মাদকচক্রের সঙ্গে। রাষ্ট্র, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং মিডিয়া হাউস এ সব বিষয় সম্পর্কে রিপোর্ট করলেও আসলে নির্বিকার। এ দিকে অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনের অসহায় মানুষরা, যাঁদের নীলরঙা চোখ আর ব্লন্ডরঙা চুল নিয়েও জাতিসত্তা রাজনীতি তুঙ্গে উঠেছে এখন।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়