বাজার যখন আগুন, তখন বাড়ির মেয়েদের গায়েই তার আঁচ লাগে সবচেয়ে বেশি। দুর্দিনে সংসারের সকলের মুখে পুষ্টিকর খাবার জোগানোর সমস্ত দায়টুকুই যেন এসে বর্তায় ‘সুগৃহিণী’দের কাঁধে। কোন খাতে খরচ কমিয়ে তাঁরা সেই ঝড় সামলাবেন, তা নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে স্বাধীনতার সময় থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা খবরের কাগজে। কখনও মেয়েরা নিজেরা উগরে দিয়েছেন তাঁদের ক্ষোভ, হতাশা। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগে প্রবাসী পত্রিকায় ‘জনৈকা বাঙালি গৃহিণী’ ছদ্মনামে এক জন যেমন লিখছেন, বাঙালি বাড়িতে এই অভাব-অনটনের সময়ে রান্না করা মেয়েদের কাছে এক অত্যন্ত দুরূহ কাজ। অনেক খাবারই কাটা পড়েছে সাধারণ খাদ্যতালিকা থেকে। “আজকালকার দিনে বাঙ্গালীর সম্বন্ধে ভোজনবিলাসী কথাটি প্রযোজ্য কিনা ভাবিয়া দেখিবার বিষয়।... ব্যয় যে পরিমাণ বৃদ্ধি হইয়াছে আয় সে অনুপাতে বাড়ে নাই, এবং খাদ্যবস্তুর মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান নামিতে নামিতে নিম্নতম স্তরে আসিয়া পৌছিয়াছে।” লেখিকার আশঙ্কা, বাঙালিকে অচিরে ‘ছাতু-গুড় খাইয়াই কোনমতে পৈতৃক প্রাণ রক্ষা করিতে হইবে’।
বাড়ির মেয়েরা কী ভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে রান্না করে খরচ কমানোর পাশাপাশি খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়াতে পারেন, তা নিয়ে বহু আলোচনা পাওয়া যায় ১৯৫০-এর দশকের পত্র-পত্রিকায়। মহিলা পত্রিকায় ১৯৫১ সালে প্রকাশিত অরুণা মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধের উদাহরণ দিই। প্রবন্ধটির নাম ‘খাদ্যে পুষ্টি (ফ্যান)’। লেখিকা ভাতের ফ্যানের পুষ্টিগুণের বিবরণ দিয়ে লিখছেন, “ফ্যান ছাড়া ভাতের যে সংসারে দৈনিক তিন সের চালের খরচ হয়, ফ্যান-শুদ্ধু ভাতে সেখানে মোটামুটি খরচ হয় মাত্র দুসের এক পোয়া।... এখনকার সময়ে যখন পরিপূর্ণ খাদ্যের অভাবে হাজার হাজার লোক শুকোচ্ছে, তখন ফ্যানকে মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করাতে কোন ক্লেশ বা দ্বিধা থাকতেই পারে না।” এ সময়ে মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য-সঙ্কট সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছিল নিঃসন্দেহে। আবার, ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হোম সায়েন্স পড়ানো শুরু হল। এক দিকে দারুণ অভাব, অন্য দিকে বিজ্ঞানের মহিমায় নেহরুর ভারতের অগাধ বিশ্বাস সহজেই বিজ্ঞান ও গৃহস্থালিকে মিলিয়ে দিয়েছিল এই সময়ে।
টানাটানির সময় স্বামী-সন্তানের পাতে ফ্যান দেওয়ার আগে নিজেরা কৃচ্ছ্রসাধন করে খরচ কমানোর চেষ্টা যুগে যুগে করেছেন মেয়েরা। সে সব নজির বার বার উঠে আসে গল্প-উপন্যাস, সিনেমায় বা পারিবারিক স্মৃতিচারণে। আজকের দিনের জনস্বাস্থ্যের গবেষণা দেখায় যে, পৃথিবী জুড়ে খাবারের দাম বাড়লে বা রোজগার কমলে বয়স নির্বিশেষে মেয়েদের খাবারের পরিমাণ কমে পুরুষদের চেয়ে বেশি। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, পরিবারের পুরুষ এবং শিশুদের খাইয়ে আজও শেষ পাতে বাসি-পচা-উচ্ছিষ্ট খান ভারতের বহু মেয়ে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখিয়েছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা কম খান ডিম, মাংস, মাছ ও ফল। মহিলাদের রক্তাল্পতা, অপুষ্টি, অর্ধাহার এখনও দেশের অন্যতম জনস্বাস্থ্য সঙ্কট। মহিলাদের কম খাওয়া বা শেষে খাওয়া নিয়ে তাই শেষ ক’বছরে চর্চাও কম হয়নি। এমনকি রাজস্থানের একটি অসরকারি সংস্থা মহিলাদের শেষে খাওয়ার কুপ্রথা ভাঙতে দস্তুরমতো একটি প্রকল্প শুরু করে।
পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রীতিনীতি, বিধিনিষেধ, দায়িত্ব-কর্তব্য, শোভন-অশোভনের ধারণা মিলিয়ে মিশিয়ে একটা অদ্ভুত ঘেরাটোপ তৈরি হয়। সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে পুরুষদের মতো মহিলারাও তাতে আটকে থেকে স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন। এই ঘেরাটোপে খাবারের সঙ্গে মহিলাদের সম্পর্কটিও জটিল, বহুমাত্রিক। আমেরিকান সাংবাদিক লরা শ্যাপিরো তাঁর হোয়াট শি এট বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “খাবার কথা বলে। কিন্তু সে কথা শোনার লোক চাই।” লরা দেখিয়েছেন, বিখ্যাত মহিলাদের জীবনীকারেরা অনেক সময়ে তাঁদের রান্না-খাওয়ার বিবরণগুলিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বাদ দিয়ে গিয়েছেন। কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বোন ডরোথি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হিটলারের বান্ধবী ইভা ব্রাউন-সহ ছ’জন বিখ্যাত মহিলার ডায়েরি, রান্নার খাতা এবং সে সময়ের খবরের কাগজ ঘেঁটে তাঁদের রান্না করা না-করা, এবং খাওয়া না-খাওয়ার বিবরণগুলি ছেঁকে তুলে এনেছেন লরা। দেখিয়েছেন, খাবারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের বদলাতে থাকা সমীকরণের মধ্যে দিয়ে কী ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁদের হেঁটে যাওয়া পথের বিস্মৃত চড়াই-উতরাই।
লরার পদ্ধতি অবলম্বন করে কয়েকটি বহুপঠিত বাংলা গল্প-উপন্যাস আর এক বার পড়তে বসি, খাবারকে কেন্দ্রে রেখে মহিলাদের জীবনের ওঠাপড়া বুঝতে। দেখি শরৎচন্দ্রের বিদুষী নায়িকা বিজয়া নরেনকে হাতপাখা নেড়ে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে, “পুরুষমানুষদের খাওয়া না হলে আমাদের খেতেও নেই।” চরম অভাবের দিনে বিরাজ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ সে শুধু জানে যে, “ওঁকে (তার উপার্জনহীন মাদকাসক্ত স্বামী নীলাম্বরকে) আর খেতে দিতে পারচি নে।” কৃচ্ছ্রসাধনের পরাকাষ্ঠা পিয়ারীবাই শ্রীকান্তকে বলে, “আমরা (মহিলারা) শত কষ্ট সইতে পারি, কিন্তু তোমরা (পুরুষেরা) পারো কি! এই যে সন্ধ্যা হতে-না-হতেই ক্ষিদেয় অন্ধকার দেখছিলে?” শরৎ-সাহিত্যে খাবারের সঙ্গে মহিলাদের সম্পর্ক মোটামুটি ছকে বাঁধা। তারা নির্লোভ, ত্যাগী, উপবাসে অভ্যস্ত এবং কৃচ্ছ্রসাধনে দড়। এমনকি আচারনিষ্ঠ বিপ্রদাসের বাড়িতে এসে সাহেবি কায়দায় মানুষ হওয়া আধুনিক মেয়ে বন্দনাও বলে, আশৈশব প্রাতরাশ খাওয়ার অভ্যাস থাকলেও সে বাড়িতে সকালে তার এক দিনও খিদে পায় না। বিভূতিভূষণের মেয়েরা বরং এ দিক থেকে মাটির অনেক কাছাকাছি। তারা অন্যের বাগান থেকে আনাজ চুরি করে আনে, রোদে দেওয়া আমসত্ত্বের কোনা ছিঁড়ে খায়, নারকেল কোরানোর সময় খানিকটা চেয়ে নিয়ে খেয়ে স্বর্গসুখ অনুভব করে, পৌষ সংক্রান্তির দিন কম করেও আঠারো-উনিশটা পিঠে খেয়ে ফেলে। ‘পুঁইমাচা’ গল্পে ক্ষেন্তির মা তাকে বকেন, “মেয়েমানুষের আবার অত নোলা কিসের!” আবার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময়ে শঙ্কিত হন, তাঁর ‘অত্যন্ত অগোছালো, নিতান্ত নিরীহ এবং একটু অধিক মাত্রায় ভোজনপটু মেয়েটিকে’ কি ‘অপরে ঠিক বুঝিবে’?
খাবারকে কেন্দ্রে রেখে আর এক বার পড়লে বহুবিধ ব্যঞ্জনায় ধরা দেয় নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পাদপীঠ’ গল্পটি। আধুনিক নাগরিক ছেলে ননীগোপাল তার মনে-প্রাণে সেকেলে স্ত্রী কমলাকে নিয়ে ভারী বিব্রত। কমলা প্রতি দিন ভোরে তার পায়ের ধুলো নেয়, তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় না খেয়ে বসে থাকে এবং তার এঁটো পাতে খায়। ননীগোপাল তাকে আলাদা থালায় খেতে বললেও শোনে না। হেসে বলে, “একখানা বাসন বেশি এঁটো করে লাভ কী?” কমলা সংসারের কাজে অহর্নিশি ডুবে থাকে স্বেচ্ছায়। ননীগোপাল তাকে সঙ্গিনী হিসাবে পায় না। এক দিন নিউ এম্পায়ারে নাচের শো দেখার দুটো দামি টিকিট পায় ননীগোপাল। কমলা যেতে চায় না। ননীগোপাল সঙ্গে নিয়ে যায় তার বন্ধুর বোন মীনাক্ষীকে। ‘কালো ঢ্যাঙা আইবুড়ো মাষ্টারনী মেয়েটা’ স্বামীর সঙ্গে গেছে জেনে কুরুক্ষেত্র করে কমলা। অনেক মান-অভিমানের পরে রাতে স্বামীর বুক ভিজিয়ে ধরা গলায় কমলা বলে, “আমি এখন থেকে তুমি যা বল তাই করব… মাথায় আঁচল দেব না, এঁটো পাতে খাব না।” পর দিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে ননীগোপাল দেখে কমলা কাঁদছে। কমলা জানায়, গত রাতের আলোচনার পরে আজ আর কিছুতেই সে নিজেকে স্বামীর পায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারছে না। স্ত্রীর এই নতুন সমস্যার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ননীগোপাল। কিছুতেই বলতে পারে না, “তুমি আমার পাশে থাকলেই যথেষ্ট, বুকে থাকলেই যথেষ্ট, পায়ের কাছে যাওয়ার তোমার কোনও দরকার নেই।” গল্পটি এখানে শেষ হয়।
আমাদের সমাজের গল্প অবশ্য এগিয়ে (নাকি পিছিয়ে) চলতে চলতে এ যুগে এসে ঠেকে দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন-এ। ‘রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা’— যুগের পর যুগ ধরে ‘একটানা এক ক্লান্ত সুরে’ ঘুরতে থাকে মেয়েদের কাজের চাকা। সমান তালে চলে বঞ্চনা আর আত্মত্যাগ। তাই অবাক হই না, যখন গবেষণায় দেখা যায় যে, অতিমারির সময়ে পরিবারের অন্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে গিয়ে অর্ধভুক্ত থেকেছেন দেশের বহু মহিলা।
অর্থনীতি বিভাগ ও ইতিহাস বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা