নির্মম: উনিশ শতকের গোড়ায় ভারতীয় শিল্পীর আঁকা সতীদাহের ছবি।
রামমোহন রায়ের সার্ধদ্বিশতবর্ষে আর ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহর শতবর্ষে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ আমাদের এক বিরাট গৌরবের উত্তরাধিকার যেখানে রণজিৎ গুহ তাঁর রামমোহন-চিন্তার মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন, এক জন মনীষীর চিন্তা ও চেতনার ধারার পুনর্মূল্যায়ন কী ভাবে আমাদের, অর্থাৎ ভারতীয়দের, চিন্তন, মনন, সামাজিক ও রাজনৈতিক আধুনিকতাকে একটি দুরূহ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। দয়া: রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা এই জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটি বই বলে মনে হয়। আমাদের দেশের স্বাধীনতার পঁচাত্তর-পালনের সময়ে সেই গুরুত্ব যেন আরও বেশি। প্রসঙ্গত, এটা গুজরাতের দাঙ্গা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিশ বছর পূর্তির সময়ও বটে।
রণজিৎ গুহ-কৃত এই পুনর্মূল্যায়নে যা পরিষ্কার ভাবে ফুটে ওঠে তা হল, আমাদের চারিত্রিক ও বৌদ্ধিক চর্চাতে দয়ার প্রচ্ছন্ন অভাব। এবং এই অভাবের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে আমাদের রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করা ঘুণপোকাগুলি— গভীর দৈন্য, নৈরাজ্য ও নিষ্ঠুরতা। ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতিতে দয়ার স্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেই দয়ার অন্তর্নিহিত স্রোতটি কী ভাবে শুকিয়ে এল, কেন শুকিয়ে এল, তা নিয়েই তাঁর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। এরই মধ্যে দিয়ে রণজিৎ গুহ আমাদের স্বাধীনতা, আধুনিকতা, স্বদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদ— এই তাত্ত্বিক ঐতিহাসিক ধারণাগুলোরও নবমূল্যায়ন করেন।
বইটির প্রধান প্রশ্ন: মনুষ্যত্বের উদার ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যে রাজনীতি আর সামাজিক সংস্কারের মধ্যে দয়ার স্থান কোথায়? রণজিৎ গুহ প্রথমেই আমাদের সচেতন করে তোলেন যে, সৎ ইতিহাসচর্চার মধ্যে আত্মবিস্মৃতির কোনও স্থান থাকতে পারে না। কাজেই, গুজরাত দাঙ্গার সময় নারকীয় গণহত্যা এবং তাতে রাষ্ট্রের সহযোগ; সংখ্যালঘু নাগরিকদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের মহোৎসব ও জিঘাংসাকে বীরত্বের নাম দিয়ে সামাজিক উদ্যাপন রণজিৎ গুহকে বিচলিত করেছিল। কেন এবং কী ভাবে এমনটা ঘটল, তার বিশ্লেষণের পথ খুঁজতে গিয়ে তাঁর মনে দয়ার এই শুকিয়ে আসা স্রোতটির কথা বার বার জেগে ওঠে। অথচ আজ কুড়ি বছর পরে, ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা যেন অত্যন্ত সাধারণ ও গতানুগতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতটাই যে আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
ঔপনিবেশিক ভারতে সতীদাহ প্রথাটির বাড়বাড়ন্ত ইংরেজ সরকার, মিশনারি সংস্থা ও রামমোহনের মতো কিছু ভারতীয় মনীষীদের অত্যন্ত কাতর করে তুলেছিল। বাংলার রক্ষণশীলরা যেমন শোভাবাজার রাজবাড়ির পুরোধা রাজা রাধাকান্ত দেব ও তাঁর দলের অন্য অভিজাত সদস্যরা অবশ্যই প্রথার পক্ষে ছিলেন। বাঙালি সমাজের মধ্যমণিদের মধ্যে এই স্ববিরোধ ব্রিটিশদের দোটানায় ফেলেছিল। ১৮১৯ ও ১৮২০ সালে রামমোহনের দু’টি প্রবন্ধ ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় সংবাদ’ প্রকাশিত হয়। রণজিৎ গুহ এই মুহূর্তটিকে বলেছেন ‘র্যাশনাল মডার্নিটি’ বা যৌক্তিক আধুনিকতার ব্যবহারের প্রথম নিদর্শন। সমস্ত শাস্ত্রীয় তর্ক, যুক্তি ও বিবেচনাকে ছাপিয়ে সেখানে কিন্তু করুণার এক প্রচ্ছন্ন গভীর ছায়া দেখা যাচ্ছে, যা কিনা তাঁর মতে আমাদের এই ভারতীয় আধুনিকতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে।
মূল তর্ক কিন্তু দেশজ আচার বনাম শাস্ত্রীয় প্রমাণের উপর নির্ভর। হায়রার্কি অ্যান্ড কম্পারেটিভ অ্যানালিসিস অব রিলিজিয়াস টেক্সটের অনুশীলন রামমোহনই আমাদের মধ্যে প্রথম প্রচলন করেন— ধর্মবিষয়ক তর্কে শাস্ত্র-মতের বিপরীতে তিনি সাধারণ অভিজ্ঞতাকে দাঁড় করিয়ে দেন। বলেন, শাস্ত্রে যা-ই বলা থাক, নিজের চোখে দেখা ঘটনার অপরিহার্য গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রণজিৎ গুহর মতে, শাস্ত্রীয় তর্কবিতর্কের বাইরে গিয়ে, যুক্তির আত্মসচেতন স্বাতন্ত্র্যের যে প্রতিষ্ঠা রামমোহন এখানে করেন, তা ভারতীয় আধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
এখানেই রামমোহনের বিশ্লেষণ শাস্ত্রীয় বিচারের বাইরে গিয়ে, মেধা, বিদ্যা ও যুক্তির উপর নির্ভরশীল একটি আলোচনার ক্ষেত্র— পাবলিক স্ফিয়ার— তৈরি করে থামতে পারত। কিন্তু রামমোহনের সতীদাহ বিষয়ক দ্বিতীয় বই যুক্তি ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেও ছাপিয়ে আমাদের বিশ্লেষণের মধ্যে আর একটি উপাদান নিয়ে আসে। তিনি যখন বলেন, “তাহারদিগের প্রত্যক্ষ দেখিয়াও আপনাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ দয়া উপস্থিত হয় না”, সেই বেদনার মধ্যে সন্নিবিষ্ট রয়েছে মনুষ্যত্বের প্রতি আবেদন, যা কিনা দয়ার উপর নির্ভরশীল।
রণজিৎ গুহ বলেন, এই দয়া শুধুমাত্র সামাজিক ও ধর্মীয় আচরণের মাধ্যমে ক্ষমতাবানের দীন-দুঃখীর উপর সাময়িক করুণা বর্ষণের নাম নয়। দয়ার সঙ্গে বলের বা ক্ষমতার আস্ফালনের সম্পর্ক নেই। ধনী মাত্রেই দয়ালু ও গরিব মাত্রেই দয়ার পাত্র, এমন নয়। রণজিৎ গুহ বলছেন যে, রামমোহন ও বঙ্কিম, দু’জনের জন্যেই নিষ্কাম ত্যাগ দয়ার সারবত্তা। এবং দয়ার এই অপূর্ব বৈরাগ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বিশেষত সংজ্ঞাটির প্রতি টান, আমরা উনিশ শতকের এই দুই পুরোধা বাঙালি মনীষীর মধ্যেই দেখতে পাই। তবে রামমোহনের দয়ার সংজ্ঞার মধ্যে নিহিত রয়েছে কমন সেন্স বা লৌকিক জ্ঞান, বা সহজ জ্ঞান, প্রত্যক্ষ প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা, যার সঙ্গে দয়ার আর একটি যোগ রয়েছে। রামমোহনের দয়া যে প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি ও মানবিক বেদনা থেকে উদ্ভূত হয়, তাকে বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র শাস্ত্র-ভিত্তিক তর্কবিতর্কের উপর সমাজ সংস্কার বা রাজনীতির অনুশীলন, কোনওটাই সম্ভব নয়। সহানুভূতি মনুষ্যত্বের প্রধান চরিত্রগত সামাজিক বৈশিষ্ট্য— সাধারণ পরিস্থিতিতে তা ছাড়া সমাজের অস্তিত্ব কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। এই সামাজিক সহানুভূতি ও তার থেকে উদ্ভূত দয়া, তাই ভারতীয় আধুনিকতার বিশ্লেষণ আমাদের সহায়। ‘প্রথাসিদ্ধ ঔচিত্যবোধের থেকে মানবিক নীতিবোধ’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেটাই আমাদের মধ্যে জন্ম দেয় সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধের।
দয়ার প্রকাশ ও অনুশীলন তা হলে কোন পথে হবে? রণজিৎ গুহর বিশ্লেষণে তা একমাত্র সম্ভব কঠিন আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে, যা আমাদের শুধুমাত্র নিজেদের চিন্তা, চেতনা আর বৌদ্ধিক বিকাশের প্রতি দায়িত্বশীল করে না, তা আমাদের, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবানও করে তোলে। রণজিৎ গুহ বলছেন যে, নিজের মর্যাদার সমর্থন করতে হয় অন্যের মর্যাদার মাধ্যমে। যে সময়ে রামমোহন সতীপ্রথা রদ করার জন্য লিখতে বসেছেন, সেই সময়ে ব্রিটিশ শাসকের উদাসীনতা ও ভারতীয় বাঙালি হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতা, কোনওটাই তাঁর অনুকূল নয়। সেই মুহূর্তটিতে ভারতীয় আধুনিকতার জন্ম তখনই তাঁর হাত ধরে ঘটে যখন তিনি দয়াকে সামাজিক উদারতা, সহানুভূতি আর শ্রদ্ধার সঙ্গে মিলিয়ে দেন। রণজিৎ গুহর মতে, সেই মুহূর্তে মনুষ্যত্বের মর্যাদাকে তিনি আচার ও দেশ ধর্মের অনেক ঊর্ধ্বে স্থাপন করেন।
এই প্রসঙ্গে রণজিৎ গুহর বন্ধু ও কথোপকথক কবি শঙ্খ ঘোষের একটি লেখা দিয়ে শেষ করতে চাই। শঙ্খ ঘোষের বক্তৃতা অন্ধের স্পর্শের মতো, যা পরে বই আকারে বেরিয়েছে, সেখানেও ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক ও রাজনীতিক অনুশীলন ও যাপনের মধ্যে কঠিন রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্বটি ও উদগ্র নিষ্ঠুরতার প্রবেশ ও আস্ফালন নিয়ে তাঁর গভীর উদ্বেগ দেখি। তিনিও উল্লেখ করছেন ‘কমিউনিকেবিলিটি’র কথা— অন্যের কাছে নিজের মতাদর্শ, নিজের অবস্থান পরিষ্কার ভাবে ব্যক্ত করার প্রয়োজনের কথা। কিন্তু তার একটা উল্টো পিঠও রয়েছে। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, “অন্যে যা আমাকে বলল, তা কি আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে, একাগ্রতার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করলাম? তার মতামত, তার অবস্থান বুঝবার চেষ্টা করলাম কি? না নিজের বলবার কথাগুলি অত্যন্ত শক্ত ভাষায় বলে, সেই অহমিকাটাতেই আনন্দ পেলাম?” শঙ্খ ঘোষ এখানে নোম চমস্কিকে উদ্ধৃত করেছেন— “দ্যাট বিকামস দ্য বেসিস অব ইয়োর প্রিভিলেজ অ্যান্ড ইয়োর পাওয়ার।”
যে শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা থেকে অন্যের মনুষ্যত্বের প্রতি আমাদের মনে, মননে ও যাপনে সম্মানবোধ জন্মায়, তার জন্যে একনিষ্ঠ প্রয়োজন, তা বাহ্যিক আস্ফালনে সম্ভব নয়, তার দ্বারা কোনও গঠনমূলক কাজ করা যায় না। তার থেকে শুধুমাত্র প্রবল নিষ্ঠুরতার আস্ফালনের প্রকাশ ঘটে। যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও দয়ার অনুশীলন আমাদের ‘আমি থেকে আমরা’ অবধি নিয়ে যেতে পারে, তার জন্য যে আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন, তা না থাকলে আমিত্ব বা ইনডিভিজুয়ালিজ়ম আমাদের গ্রাস করে। শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশের কথা বলেন, দয়ার প্রকাশ মাত্রাবোধে, নিয়ন্ত্রণে, নীরবতায়, নীরব কর্মে— অত্যুক্তি ও আস্ফালনে নয়। সেই সুস্থ সমাজের জন্য আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ, আমাদের ‘কমিউনিকেবিলিটি’র মধ্যে সংযম ও আত্মসমীক্ষা আনতে হবে। এমন ভাবে যে, তা আমাদের আত্মবিস্মৃতির অপরাধ থেকে মুক্ত করবে। অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবান করবে।
রবীন্দ্রনাথ রামমোহনকে বর্ণনা করার জন্য উপনিষদের যে শ্লোক ব্যবহার করেছিলেন, আজ ২০২২-এ দাঁড়িয়ে সেটিই মনে করা যাক: ব্রাত্যস্থম্ প্রাণঃ। এই ব্রাত্য অস্তিত্ব, যা কিনা সামাজিক, লৌকিক, দেশজ আচারের বহু ঊর্ধ্বে অবস্থান করা এক বিচ্ছিন্ন, অক্লান্ত ভাবে আত্মসমীক্ষারত প্রাণ। এই ক্রমাগত আত্মসমীক্ষারত দয়াশীল চেতনা রামমোহনের উদারতার প্রধান উপাদান। সাহসী, নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ইতিহাসচর্চার এই ধারা, রামমোহন থেকে রণজিৎ গুহ পর্যন্ত আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকার। আমরা তাঁদের উত্তরসূরিরা, যেন তার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি।
ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন, ম্যাডিসন, আমেরিকা