এই তথ্যবিকৃতির যুগে মহলানবিশের উত্তরাধিকার স্মরণে থাকুক
Prasanta Chandra Mahalanobis

উন্নয়নের পথপ্রদর্শক

অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের জন্মদিনকে বেছে নেওয়া হয়েছে পরিসংখ্যান দিবস হিসেবে, স্বাধীন ভারতের উন্নয়নযজ্ঞে তাঁর ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে।

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২২ ০৪:৫২
Share:

দিশারি: কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ৩ নভেম্বর, ১৯৫৪

গোটা দুিনয়ায় পরিসংখ্যান দিবস পালিত হয় অক্টোবরের ২০ তারিখ। ভারতে কিন্তু সেই দিনটি আজ, ২৯ জুন। অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের জন্মদিনকেই বেছে নেওয়া হয়েছে পরিসংখ্যান দিবস হিসেবে, স্বাধীন ভারতের উন্নয়নযজ্ঞে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে। আর, ২৮ জুন হল তাঁর মৃত্যুদিন— গত কাল তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নিখিল মেননের বই প্ল্যানিং ডেমোক্র্যাসি: হাউ আ প্রফেসর, অ্যান ইনস্টিটিউট অ্যান্ড অ্যান আইডিয়া শেপড ইন্ডিয়া (পেঙ্গুয়িন র‌্যান্ডম হাউস, ২০২২)। সেই বইটাকে ধরেই আজকের তথ্য-বিধ্বস্ত দেশ এবং দুনিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর উত্তরাধিকারের পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

Advertisement

কেমব্রিজের ট্রাইপস ছাত্র প্রশান্তচন্দ্রের দেশে ফেরার জাহাজ যুদ্ধের জন্য ছাড়তে দেরি হলে সেই অবকাশে কিংস কলেজের গ্রন্থাগারে কী ভাবে পরিসংখ্যানবিদ্যার বই আসে তাঁর হাতে, কী ভাবে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রবাহকে এ দেশে নিয়ে এলেন তরুণ মহলানবিশ, তা নিয়ে চর্চা হয়েছে বিস্তর। তবু, প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার তরুণ অধ্যাপক কী ভাবে এ দেশে তৈরি করলেন পরিসংখ্যানবিদ্যার এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, তা এক বিস্ময় বইকি। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর মতো এক শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা, বা ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (এনএসএসও) বা সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস (সিএসও)-এর মতো পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রশাসনিক এবং ব্যবহারিক প্রতিষ্ঠান তৈরি, একটা প্রজন্মের পরিসংখ্যানবিদ, গণিতবিদ-সহ শিক্ষক-গবেষকদের সযত্নে লালন করাই কেবলমাত্র মহলানবিশের উত্তরাধিকার নয়— রাষ্ট্র আর সমাজকল্যাণে পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগই ছিল তাঁর মূল মন্ত্র। ১৯৫০’এর পুণে সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে ‘হোয়াই স্ট্যাটিস্টিক্স’ শীর্ষক তাঁর ভাষণেও সেই এক সুরের অনুরণন।

কিন্তু, সে জন্য তো উপযুক্ত পরিকল্পনার প্রয়োজন; চাই ঠিক ভাবে পরিকল্পিত ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদিত সমীক্ষা— স্যাম্পল সার্ভে। জীবনব্যাপী অসংখ্য সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন মহলানবিশ— কৃষি, অর্থনীতি, শিল্প, পাট উৎপাদন, বাংলার দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি, এমন বহুবিধ বিষয়ে। এনএসএসও-র সমীক্ষাগুলি যে সদ্য-স্বাধীন দেশের রূপরেখা বুঝতে, প্রয়োজন অনুধাবনে, এবং সার্বিক বিকাশে চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই সব সমীক্ষার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন অ্যাঙ্গাস ডিটনের মতো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদও।

Advertisement

নিষ্ঠা এবং উদ্ভাবনীশক্তি ছিল মহলানবিশের এই সমীক্ষাগুলির জিয়নকাঠি। সমীক্ষা এবং তথ্যকে ত্রুটিহীন করতে মহলানবিশের সাধনা রূপকথাসম। সমীক্ষার তথ্যের ভুল পরিমাপের জন্য তিনি তৈরি করেন রাশিবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব। এনএসএসও-র তথ্য সংগ্রহে ক্রস এগজ়ামিনেশন বা প্রতি-পরীক্ষার জন্য স্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক কর্মী রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি। পক্ষপাতহীন তথ্য সংগ্রহের এই সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে মহলানবিশ জমানার এক বড় উত্তরাধিকার। আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে তথ্যের প্রতি এই নিষ্ঠার কথা বিশ্বাস করাই মুশকিল। তথ্যের হৃদয় নিংড়ে মানবকল্যাণে তার প্রয়োগেও অক্লান্ত মহলানবিশ। আবার, পাশাপাশি বিশ্বপর্যায়ের গবেষণাও তাঁকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। সব মিলিয়ে একটা জীবনকালে মহলানবিশের সমপর্যায়ের সুবিশাল উত্তরাধিকার তৈরি করাকেই হয়তো রূপকথা বলে।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পথনির্দেশ তাঁর এক মস্ত অবদান। আর এ কাজে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল তাঁর আইএসআই। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনুকূল ছিল অনেকটাই। নেহরুর সঙ্গে মহলানবিশের হৃদ্যতার সূত্রপাত স্বাধীনতারও এক যুগ আগে, তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্রের হাত ধরে। স্বাধীন দেশের উন্নতির পরিকল্পনায় নেহরু অনেকটাই নির্ভর করলেন মহলানবিশের উপরে। সদ্য-স্বাধীন ভারতের যোজনা কমিশন এবং তার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি ছিল ঔপনিবেশিকতা-উত্তর পৃথিবীর অন্যতম উচ্চাভিলাষী পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নেহরু বিশ্বাস করেছিলেন যে, পরিকল্পনার মাধ্যমেই প্রশমিত করা সম্ভব অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার দ্বন্দ্বকে।

মহলানবিশ এই পরিকল্পনাকে রাজনীতির মুঠো থেকে বার করে এনেছিলেন। এ বড় সহজ বিষয় নয়। সরকারি মহলে মহলানবিশের ভাবমূর্তি তখন এক সুপার-অর্থনীতিবিদের। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপকার তিনি— এক পরিসংখ্যানবিদ লিখলেন পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নীতি নির্দেশনার দলিল। ভারী শিল্পের উপর জোর দেওয়া হয় সেই পরিকল্পনায়। নিউ ইয়র্ক টাইমস একে বলেছিল এশিয়ার অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অভিযান। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপরেখাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আইএসআই-এর। এ সবের মধ্যে দিয়ে যেন কলকাতারও গুরুত্ব বাড়ল দিল্লির আমলাতান্ত্রিকতার অন্দরে। নিখিল মেনন একে বলেছেন কলকাতার দিল্লি বিজয়।

দেশগঠনে পরিসংখ্যানবিদ্যা, সমীক্ষা, তথ্যসংগ্রহ, তথ্যের বিশ্লেষণ-ভিত্তিক ফলাফলের প্রয়োগ নজর কেড়েছিল বিশ্বেরও। আইএসআই-এ এসে ভারতের প্রজ্ঞা থেকে জ্ঞান আহরণ করতে চেয়েছেন ঝৌ এনলাই, হো চি মিন। এবং ভারতে রাশিবিজ্ঞানের সৃষ্টিশীল সংস্কৃতির যে বলিষ্ঠ বনিয়াদ তৈরি করে গিয়েছেন মহলানবিশ, তাতে ভর করেই দেশ পাড়ি দিয়েছে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর।

তবু, সময় বদলায়। পরিসংখ্যানবিদ্যার ব্যবহারিক দুনিয়ায় এই বদল অমোঘ ও অনিবার্য। এই পরিবর্তনের প্রধান বৈশিষ্ট্য অবশ্যই তথ্যের খোলনলচে বদলে যাওয়া, ফুলেফেঁপে ওঠা। আজকের দুনিয়ায় প্রায় সমস্ত কিছুই তো বাঁধা পড়ে গিয়েছে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’-এর ইন্দ্রজালের বাঁধনে। বিশ্বজোড়া অতিমারি এই আন্তর্জালের নাগপাশকে আরও জোরদার করেছে। তথ্যের পরিমাণ গুণোত্তর প্রগতিতে লাফিয়ে বাড়ছে। এই বিপুল তথ্যকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা কিন্তু সত্যিই নেই রাশিবিজ্ঞানের বা আজকের প্রযুক্তির। ও দিকে ‘ডেটা’র পরিধি বেড়েই চলেছে। অবশ্য ইতিহাস সাক্ষী যে, সমসাময়িক প্রযুক্তি তথ্যকে বিশ্লেষণ করতে অপারগ হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। এমনকি মহলানবিশের বড় সমীক্ষাগুলি যখন প্রচুর তথ্যের জোগান দিতে থাকে, সে সময়কার প্রযুক্তি দিয়ে তার সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ সম্ভব ছিল না। সেই ‘বিগ ডেটা’কে বাগে আনতে কী করেছিলেন মহলানবিশ?বহু চেষ্টায় তিনি আইএসআই-এ নিয়ে এলেন ভারতের প্রথম দুটো কম্পিউটার। এক পরিসংখ্যানবিদের হাতে সূচনা হল ভারতের কম্পিউটার যুগের। পরিসংখ্যানবিদ্যার মতো ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে নিজের মতো করেই সমন্বয় সাধন করতে হয়। সব যুগেই।

আজ প্রথাগত তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও এসে গিয়েছে প্রযুক্তির অনিবার্য প্রয়োগ। যেমন, ভারতের জনশুমারি হতে চলেছে ‘ডিজিটাল’। তথ্য ও তার বিশ্লেষণের চরিত্রের এই পরিবর্তন কালে মহলানবিশের ভঙ্গিতে মানবকল্যাণে তার প্রয়োগ সহজ নয় নিশ্চয়ই। এবং তথ্য সংগ্রহে মহলানবিশের নৈর্ব্যক্তিক নিষ্ঠা যে প্রশ্নাতীত বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছিল, তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দশক পরে তা ধরে রাখাও কঠিন নিশ্চয়ই। ‘যোজনা কমিশন’-এর ‘নীতি আয়োগ’ হওয়া, বা এনএসএসও এবং সিএসও জুড়ে গিয়ে ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস হয়ে যাওয়াটাই হয়তো যথেষ্ট নয় তার জন্য।

মহলানবিশের ম্যাজিকটা ঠিক কী ছিল? আসলে তাঁর অনন্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে সে সময়কার এক সম্ভাবনাপূর্ণ কিন্তু অব্যক্ত বিষয়— পরিসংখ্যানবিদ্যা। তাকে ভাষা জুগিয়েছেন মহলানবিশ, অন্তত ভারতের প্রেক্ষিতে। দেশ ও সমাজের এক প্রকৃত ক্রান্তিকালে পরিসংখ্যানবিদ্যাকে তিনি দেখেছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপানের এক প্রধান প্রযুক্তি হিসেবে। সঙ্গে অবশ্যই ছিল সদ্য-স্বাধীন দেশের মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রত্যয়, এবং অনুকূল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। এক অসাধারণ বিজ্ঞানীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সেই ব্যতিক্রমী সময়কালের মেলবন্ধনই তৈরি করেছে মহলানবিশের স্থায়ী উত্তরাধিকার।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement