অতঃপর: আর জি কর ঘটনার বিচারের দাবিতে পুনর্বার ধর্নায় জয়েন্ট ফোরাম অব ডক্টর্স-এর সদস্যরা, কলকাতা, ২২ ডিসেম্বর। ছবি: সনৎকুমার সিংহ।
সকালবেলার চেহারা দেখে সারা দিন কেমন যাবে, দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ। তবে দিনটা যেমন কাটল তার একটা আদল যদি বিদায়বেলাতেও দৃশ্যমান থাকে, সেই দৃশ্যের দাম দিতেই হয়। আর জি কর হাসপাতালের পিশাচলীলার পরে কয়েক মাস ধরে কলকাতার বুকে যে লাগাতার প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখেছি, বর্ষশেষেও মহানগরের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিবাদী মঞ্চে তার পরম্পরা বহাল ছিল। সেই জাগ্রত তরঙ্গবিক্ষোভ দেখে অনেক শুভপ্রত্যাশী নাগরিক নিশ্চয়ই আপন সুচেতনার উদ্দেশে উচ্চারণ করেছেন: ‘এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি’। সদ্যোবিগত ২০২৪ সদ্যোজাত ২০২৫-এর জন্য অন্তত একটি উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছে। প্রতিস্পর্ধী সাহসের উত্তরাধিকার। ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে তার মুখের উপর স্পষ্ট কথা শুনিয়ে দেওয়ার সাহস। এক বার নয়, বার বার। এটা নিঃসন্দেহে এই আন্দোলনের প্রাপ্তি। দাবিদাওয়ার ক’আনা মিটল বা মিটল না, সেই খতিয়ানের বাইরে গিয়ে মনে রাখতে হবে যে একটা নিস্তেজ এবং নিস্পৃহ নাগরিক সমাজ অন্তত একটি উপলক্ষে নিজের মনের জোর ফিরে পেয়েছিল। ‘কিছুই তো হল না’ রায় দিয়ে এই প্রাপ্তিকে যেন অস্বীকার না করি।
কিন্তু অতঃপর? এই উত্তরাধিকারকে কী ভাবে ব্যবহার করবে আমাদের নাগরিক সমাজ? অর্জিত সাহস এবং কণ্ঠস্বরকে কী ভাবে নিয়োজিত করবে আপন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে? ক্ষমতার মোকাবিলায়, ক্ষমতার সর্বব্যাপী অপব্যবহারের মোকাবিলায় কী ভাবে ছিনিয়ে আনতে পারবে নতুন সাফল্য? পঞ্জিকা এবং ক্যালেন্ডারের বার্ষিক গতিতে সাল আপনি পাল্টেছে, তারিখ পাল্টাতে থাকবে আহ্নিক গতিতে। কিন্তু নাগরিক প্রতিস্পর্ধা কি নিজেকে পাল্টাবে? সে কি নিজেকে পাল্টাতে চাইবে? না কি, গত কয়েক মাসে যা করে এসেছে সে, সেটাই একমনে করে চলবে? উত্তর জানা নেই, তবে তার কিছু আভাস বা সঙ্কেত বা লক্ষণ মিলেছে।
বছরের শেষে ধর্মতলার পুরনো পরিসরে নতুন করে প্রতিবাদ মঞ্চ আয়োজনের যুক্তি হিসেবে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য: যাঁরা তদন্ত করছেন এবং যাঁরা সেই তদন্তকারীদের চালনা করছেন তাঁদের উপর চাপ জারি না রাখলে তদন্ত পথভ্রষ্ট হতে পারে। সংগঠিত প্রতিবাদের পথ। অভিজ্ঞতা তাঁদের সামনে সেই সত্যটিকেই উন্মোচিত করেছে। যত দিন শহরের রাস্তা জুড়ে সংগঠিত এবং নিরন্তর প্রতিবাদ চলেছিল, তত দিন ক্ষমতাবানরা বিরোধী কণ্ঠস্বর এবং তার দাবিদাওয়া শুনতে বাধ্য হয়েছিলেন, বাধ্য হয়েছিলেন কিছুটা সচল থাকতেও, তদন্তে অগ্রগতির কিঞ্চিৎ আশা দেখা যাচ্ছিল। পথের আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার পরে অপরাধের তদন্ত গতি হারানোর, ভুল পথে চলে যাওয়ার বা কানাগলিতে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে। অতএব— সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, জোট বাঁধো, তৈরি হও, পথে আবার নামো সাথি। কেবল এই মঞ্চটিতে নয়, শহরের অন্য নানা বিন্দুতেও বর্ষান্তরের এই মরসুমে দ্রোহের উৎসবে ফিরে আসার নানা নজির দৃশ্যমান। স্পষ্টতই, ক্ষমতার উপর চাপ রাখতেই এই সব প্রতিস্পর্ধী উদ্যোগের তৎপরতা।
প্রতিবাদীদের আশঙ্কা ও অভিযোগ কতটা সঙ্গত, তদন্ত সত্য সত্যই ব্যাহত বা পথভ্রষ্ট হচ্ছে কি না, নেপথ্য থেকে তাকে প্রভাবিত করা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে নাগরিক সমাজের নানা পরিসরে, বিশেষত বেলাগাম সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন মতের ও পথের সর্বজ্ঞরা সতত সঞ্চরমাণ। সেই চণ্ডীমণ্ডপ যথাস্থানে তার তরজা-সুখে মশগুল থাকুক। অনেক বড় প্রশ্ন হল, ক্ষমতার উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে প্রতিবাদীরা যে পুরনো প্রকরণ ব্যবহার করতে চাইছেন, তা অতঃপর কতটা কার্যকর হবে? যে পথে সাফল্যের সন্ধান মিলেছে, এখনও সেই পথেই সাফল্য মিলবে? সামাজিক সংগ্রামের ভিন্ন প্রকরণ এবং ভিন্ন পথ খোঁজাও জরুরি নয় কি? নতুন বছরের গোড়ায় প্রশ্নটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, কেবল বছর পাল্টায়নি, ইতিমধ্যে সংগ্রামের স্বরূপও পাল্টেছে। এক নদীতে দু’বার স্নান করা যায় না, একই লড়াই দু’বার লড়া যায় না। নদী এবং লড়াই, দুই-ই নিরন্তর বহমান।
প্রশ্ন হল, সাফল্য মানে কী? ক্ষমতার মুখের উপর কথা বলা, তাকে আলোচনায় বসতে বা পথে নেমে আসতে বাধ্য করা? তা হলে বলতেই হবে: সাধু সাবধান। ক্ষমতাবানেরা যদি দেখেন যে নমনীয়তার ভঙ্গিটুকুই তাঁদের মুশকিল আসানের কৌশল হিসাবে কাজ দিচ্ছে, তবে গরুড়ের মতো পাখার একখানা পালক ফেলে দিতে তাঁদের কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, এই কৌশলেই বহু মানুষকে অভিভূত করে ফেলা যায়, তাঁরা তখন চমৎকৃত এবং বিগলিত স্বরে বলতে থাকেন: ওঁরা সব অহঙ্কার সরিয়ে রেখে প্রতিবাদীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন, কত ক্ষণ ধরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছেন, কত ধৈর্য ধরে কথা শুনছেন, আর কোথাও কোনও প্রশাসককে এমনটা করতে দেখেছ? যে ক্ষমতা নির্বোধের মতো গোঁ ধরে বসে থাকে, এই নমনীয়তা— বা নমনীয়তার ভঙ্গি— তার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধির পরিচায়ক। সেই কারণেই, আবার বলতে হয়, সাধু সাবধান।
কিন্তু দাবি আদায় করে নেওয়ার সাফল্য? সে ক্ষেত্রেও সাবধানতা বিশেষ জরুরি। প্রথমত, এ-যাবৎ দাবি আদায়ের যে সব দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে, সেগুলির এক অংশ নিছক লোকদেখানো, অন্য অংশ পরিকল্পনামাত্র। এক দিকে, অভিযুক্ত বা বিতর্কিত পদাধিকারীদের এক চেয়ার থেকে অন্য চেয়ারে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে নতিস্বীকারের পরিচয় যতখানি থাকে, তার থেকেও অনেক বেশি থাকতে পারে প্রতিবাদীদের অস্ত্রকে ভোঁতা করে দেওয়ার নিপুণ কৌশল। অন্য দিকে, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার ঘটানোর যে সব পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে, সেগুলি কেবল অত্যন্ত সীমিতই নয়, তার রূপায়ণ কত দিনে হবে, এবং শেষ পর্যন্ত কত দূর কী হবে, জানে শ্যামলাল। নতুন করে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং সম্ভবত নতুন বছরেও জারি থাকবে, তার পরিণাম আরও অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট হলে বিস্ময়ের কিছু নেই। ‘তদন্ত এবং বিচারের গতি বাড়াতে হবে’— এই ধরনের দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন রাস্তায় বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটা যেতেই পারে, কিন্তু তার পরেও বাকি থেকে যেতে পারে দীর্ঘতর রাস্তা। আইনের পথ যে প্রায়শই মহাপ্রস্থানের পথে পরিণত হয়ে থাকে, সে-কথা নিশ্চয়ই ভারতবাসীকে মনে করিয়ে দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
আন্দোলনের দাবিপত্র কিঞ্চিৎ প্রসারিত হলে একটু ভরসা পাওয়া যেত। এ-রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার গোটা আয়োজনেই ভয়ানক রকমের ঘাটতি। কেবল দুর্নীতির তদন্ত করে আর চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশাসনিক সংস্কার করে সেই ঘাটতি দূর করা যাবে না। সরকারি স্বাস্থ্য নীতি এবং তার রূপায়ণের পরিকল্পনা, দু’টি বিষয়েই শাসকদের সচল হতে বাধ্য করা দরকার। এটা আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধকালীন উদ্যোগের প্রশ্ন। ঠিক যেমন বড় রকমের উদ্যোগ দরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ বেহাল হয়ে আছে, হাল ফেরানোর কাজটা এখন কোনও অংশে যুদ্ধের থেকে কম নয়। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, দু’টি পরিসরেই অন্তত বনিয়াদি স্তরে— প্রাথমিক স্কুলে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে— যুদ্ধ শুরু করার জন্য সরকারের উপর চাপ দেওয়া এখন প্রতিস্পর্ধী নাগরিক সমাজের মৌলিক দায়িত্ব। নাগরিকরা সেই দায়িত্ব পালনের কাজে নামলে নিজস্ব বলয়ের বাইরে থাকা বৃহত্তর জনসমাজকে সঙ্গে পাবেন, কারণ প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো পরিষেবাগুলি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই পথেই শাসকের উপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব। এক দিনে সে-কাজ হওয়ার নয়, তার জন্য চাই বিশদ পরিকল্পনা এবং জোরদার সংগঠন। সে-কাজে বিপুল পরিশ্রম, কিন্তু উচ্ছ্বাস এবং উত্তেজনা নেই, হাততালি নেই, প্রচারমাধ্যমের আলো নেই।
সমস্যা কি সেখানেই? আমাদের নাগরিক আন্দোলন এখন প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে প্রতি পদক্ষেপে উত্তেজনা খোঁজে। এই কারণেই সংঘর্ষ তার অতি প্রিয়, নির্মাণে অরুচি। সংঘর্ষের উত্তেজনা নির্মাণে মেলে না। সংঘর্ষ অপ্রয়োজনীয় নয়, অত্যন্ত জরুরি। ২০২৪ তা দেখিয়েছে। কিন্তু সংঘর্ষ যথেষ্ট নয়। তার পাশাপাশি, তার সঙ্গে সঙ্গে, সংঘর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে চাই নির্মাণ। নবনির্মাণের দাবি নিয়ে শাসকের মুখোমুখি দাঁড়ালে নাগরিক সমাজ ২০২৫-এ নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারে। তার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বড় সুযোগ। কঠিন চ্যালেঞ্জও বটে।