সর্বগ্রাস থেকে সর্বনাশ
Deucha Pachami

Book Review: পরিবেশ দিবস চলে যায়, কাছে আসে শেষের সে দিন

এ-বইয়ের সাকুল্যে পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠার পরিসরে নিপুণ আঁচড়ে ফুটে ওঠে এক সুগভীর ত্রিকাল-দর্শন।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২২ ০৬:১৬
Share:

হিমালয়ের একটি উপত্যকায়, বিশাল এক পাহাড়ের কোলে কয়েকখানা গ্রাম। সেই পাহাড়ের নাম মহাপর্বত। গ্রামে গ্রামে বিবাদ বিসংবাদ লেগেই থাকে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সবাই একমত— মহাপর্বতকে কোনও গ্রামের কোনও লোক অমর্যাদা করে না। পূর্বকালের মানুষেরা তাদের বলে গেছেন— ওই পাহাড় বড় জাগ্রত, তাকে নিয়ে গল্প বলবে, গান বাঁধবে, নাচের ছন্দে তাকে বন্দনা করবে, কিন্তু কখনও তার গায়ে আঁচড়টি কাটবে না, তার বুকে পা রাখবে না, সে তার অমিত সম্পদ আর নিরন্তর আশ্রয় আর অনাবিল ভালবাসা দিয়ে তোমাদের রক্ষা করবে, লালন করবে। সকলেই সে-কথা মেনে চলে, চলে এসেছে।

Advertisement

এমনই এক স্বপ্নের বিবরণে শুরু হয় অমিতাভ ঘোষের দ্য লিভিং মাউন্টেন (ফোর্থ এস্টেট, ২০২২)। তার পর? তার পর স্বপ্ন অচিরেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়, উপত্যকায় হানা দেয় বহিরাগত সম্পদ-শিকারির দল, ঝাঁপিয়ে পড়ে মহাপর্বত লুণ্ঠনের দুর্বার অভিযানে; তার পর এক সময় সেই লুণ্ঠনের উত্তরাধিকার ছিনিয়ে নেয় গ্রামবাসীরা, ‘সব নিতে চাই’ মন্ত্র তাদেরও সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়, আরও আরও সম্পদ আত্মসাৎ করার তাগিদে তারা সেই বাস্তু-পর্বতের অন্ধিসন্ধি বেয়ে আরও আরও উপরে উঠতে থাকে, দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে বিভীষিকার রূপ ধারণ করে; তার পর, অবশেষে, মহাপ্রলয়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে— এবং এক টুকরো আলোর আভাস রেখে— স্বপ্নকথা ফুরোয়।

এ-বইয়ের সাকুল্যে পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠার পরিসরে নিপুণ আঁচড়ে ফুটে ওঠে এক সুগভীর ত্রিকাল-দর্শন। এই গ্রহ— আমাদের বাঁচা-মরার এই একমাত্র মর্ত্যভূমি— কী ছিল, কী হয়েছে, এবং কী হতে চলেছে, তার সত্যরূপ ধরা পড়ে মহাপর্বতের বিপর্যয়ের বৃত্তান্তে, যে বিপর্যয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে যায় গ্রামবাসীদের পরিণতি, বহিরাগতদেরও। মহাপর্বত হয়ে ওঠে এই বসুন্ধরার প্রতীক। পুরো কাহিনিটিকে এক স্বপ্ন-বর্ণনার আকারে পেশ করেছেন লেখক। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তার কারণ, আমাদের বাস্তব যেখানে এসে পৌঁছেছে, যে বাস্তবের অতলান্ত সুড়ঙ্গপথে তীব্র থেকে তীব্রতর গতিতে এই গ্রহের এবং নিজেদের সর্বনাশের পথে ছুটে চলেছি আমরা, তার স্বরূপটিকে ঠিকঠাক জানতে হলে সরে যেতে হবে সেই বাস্তবের বাইরে এক অন্য পরিসরে, স্বপ্নের পরিসরে। আধুনিক মানুষ যে ভাবে তার পৃথিবীকে দেখতে শিখেছে, একমাত্র যে ভাবেই পৃথিবীকে দেখা যায় বলে বিশ্বাস করতে শিখেছে, তাকে প্রশ্ন করতে চাইলে আমাদের চেনা বাস্তবকে পার হয়ে যেতে হবে। এই গ্রহের সঙ্গে, তার প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে, সমস্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদ এবং পর্বত এবং নদীজপমালাধৃতপ্রান্তরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে নতুন করে খুঁজে নিতে হবে, সেই সম্পর্ককে নিজেদের জীবন দিয়ে স্বীকার করতে হবে। বাস্তব যখন বিভীষিকার নামান্তর, তার থেকে উদ্ধারের পথ তো স্বপ্নসম্ভব হতে বাধ্য।

Advertisement

মহাপর্বতের এই রূপকথাটি হঠাৎ জন্ম নেয়নি। অমিতাভ ঘোষ দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রহের ভয়াবহ বিপন্নতা নিয়ে গভীর উদ্বেগের কথা বলে চলেছেন নানা ধরনের লেখায়, যাদের প্রত্যেকটির পিছনে আছে সযত্ন অধ্যয়ন এবং অনুসন্ধান। গত বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল দ্য নাটমেগ’স কার্স (পেঙ্গুইন, ২০২১)— উনিশ অধ্যায়ে বিন্যস্ত যে গ্রন্থের ছায়া নিরন্তর খেলা করে ছোট্ট এই নতুন বইটির ছত্রে ছত্রে। অতিমারির কালে রচিত সে-গ্রন্থের শিরোনামটি কেবল অর্থবহ নয়, সেই অর্থ সুদূরপ্রসারী। ‘নাটমেগ’ হল একাধারে জয়ত্রী আর জায়ফল, সুগন্ধী মশলা হিসেবে আজও যাদের বিস্তর কদর। এই উদ্ভিদের বাসভূমি ছিল এ-গ্রহের একটি বিশেষ অঞ্চলে— জাভার কাছে, এখনকার ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি দ্বীপে। ষোলো-সতেরো শতকে ইউরোপীয় বণিকরা ‘দূর প্রাচ্যে’ সোনার হরিণ খুঁজে পেল, দেখতে দেখতে তাদের বাণিজ্যের জালে ধরা পড়ল বিস্তীর্ণ অঞ্চল। রকমারি মশলা ছিল সেই বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান রসদ। জায়ফল তাদের প্রথম সারিতে, নানা রোগের আশ্চর্য ওষুধ বলে পরিচিত, তাই অসম্ভব দাম ছিল ইউরোপের বাজারে— একমুঠো জায়ফল দিয়ে একখানা জাহাজ কিনে নেওয়া যেত। অতএব লুটেরাদের সাম্রাজ্য ঝড়ের বেগে বিস্তৃত হল। ধ্বংস হল দ্বীপমালার নিজস্ব জীবনযাত্রা, ধ্বংস হলেন অগণিত মানুষ, ধ্বংস হল প্রকৃতি ও পরিবেশ।

এই ঔপনিবেশিক মহালুণ্ঠনের ইতিহাসের সূত্র ধরেই আমাদের সমকালীন অর্থনীতির অন্তর্নিহিত সঙ্কটের উপর আলো ফেলেন অমিতাভ ঘোষ, সেই আলোয় উন্মোচিত হয় এক নির্মম বাস্তব। অতিকায় পুঁজির সর্বগ্রাসী আধিপত্যের বাস্তব। সেই আধিপত্যের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য: মুনাফা। এই পৃথিবীর মানুষ, পশুপাখি, সাত সাগর আর তেরো নদী, পাহাড়, জঙ্গল, ভূগর্ভ থেকে সমুদ্রের তলদেশ... সব কিছুই সেই লক্ষ্য পূরণের উপকরণ, তার কাঁচামাল। গত চার দশকে দুনিয়া জুড়ে ‘বাজার অর্থনীতি’র নামে এই আধিপত্য বিস্তারের পথ কী ভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, আর্থিক ও সামাজিক অসাম্যের মাত্রা তার ফলে কী প্রচণ্ড গতিতে বাড়ছে, সেই কাহিনি আজ বহুচর্চিত। কিন্তু তার পাশাপাশি, মুনাফাসন্ধানী পুঁজির এই দিগ্বিজয়ের পরিণাম হিসেবে, আমাদের বাসভূমি এই গ্রহ নিজেই এখন সর্বনাশের কিনারায় দাঁড়িয়ে। বিশ্রুত পরিবেশবিজ্ঞানীরা কেউ বলছেন, মানব সভ্যতা ইতিমধ্যেই বিপর্যয়ের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে; কারও মতে, খুব বড় রকমের আশঙ্কা আছে যে আমরা আমাদের সভ্যতার অবসান ঘটাতে চলেছি— মানব প্রজাতি হয়তো কোনও ভাবে টিকে থাকবে, কিন্তু গত দু’হাজার বছরে আমরা যা কিছু তৈরি করেছি, অচিরে তার প্রায় সবটাই ধ্বংস করে ফেলব। দ্রুত নেমে আসছে ‘জায়ফলের অভিশাপ’।

অমিতাভ ঘোষ খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, এমন পরিণতি ‘স্বাভাবিক’ নয়, বরং মানুষ আর তার পরিবেশের মধ্যে ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’কে বিনাশ করার পরিণামেই শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে এই বিপর্যয়। সেই বিনাশের কারিগরকে সরাসরি শনাক্ত করেছেন তিনি, তাকে চিহ্নিত করেছেন ‘এক্সট্র্যাক্টিভিস্ট ক্যাপিটালিজ়ম’ নামে। তাঁর সুস্পষ্ট ঘোষণা: যারা মন দিয়ে বাস্তবকে দেখছে তাদের কাছে, বিশেষ করে কমবয়সিদের কাছে, এটা এখন একেবারে পরিষ্কার যে, খুঁড়ে-খুঁড়ে মুনাফা আহরণ করে চলা এই পুঁজিতন্ত্র তার শেষ অবস্থায় পৌঁছে গেছে, “যে ভবিষ্যৎ তার (নিরন্তর মুনাফার) অস্তিত্বের শর্ত, তাকে সে নিজেই নিঃশেষ করে ফেলছে।” আর তাই, স্বাভাবিক নয় বলেই, এই বিপর্যয় আজও অ-নিবার্য নয়। তাকে রোধ করা যত কঠিনই হোক, অসম্ভব নয়। খাদের কিনারা থেকেও আমরা ফিরতে পারব, যদি ওই বেলাগাম পুঁজিতন্ত্রের নির্দেশ অস্বীকার করে আমরা এই গ্রহের অন্তরের কথা শুনি, প্রকৃতি আর পরিবেশ আর (মানুষ এবং অন্য) সমস্ত প্রাণীকে কেবলমাত্র মুনাফার উৎস বলে মনে না করি, যথেচ্ছ ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল হিসেবে না দেখি, মাটির নীচে ব্যবহারযোগ্য এবং মুনাফাগর্ভ খনিজ সম্পদের সন্ধান মিলেছে বলেই তাকে তুলে ফেলার জন্য ব্যগ্র না হই। কয়লা দামি, পৃথিবী মূল্যবান। দাম আর মূল্য এক নয়।

দ্য লিভিং মাউন্টেন-এর শেষে এক প্রবীণার নাচের দৃশ্য আছে। মহাপর্বতের কোলে গ্রামের মাটির বুকে তাঁর ছন্দোময় দু’টি পায়ের স্পর্শ লাগে, মাটি সাড়া দেয়, দর্শকরাও তা অনুভব করে, পৃথিবীর সঙ্গে ছিঁড়ে-যাওয়া সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কল্পনা? স্বপ্ন? অবশ্যই, কিন্তু এ-স্বপ্ন কেবল জরুরি নয়, অপরিহার্য। সর্বগ্রাসী পুঁজিতন্ত্রের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য তার ভুবনজোড়া মোহজালটিকে ছিন্ন করা দরকার। যে প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি সেই লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, তার তূণীরে তথ্য চাই, যুক্তি চাই, সংগঠন চাই, চাই ক্ষমতাও; কিন্তু মানুষের চেতনার স্তরেও তাকে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কেবল ‘পুঁজিবাদ নিপাত যাক’ স্লোগান দিয়ে সেটা হওয়ার নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement