ইডেন গার্ডেন্সের প্রেস বক্স থেকে কলকাতা হাই কোর্টের দূরত্ব কতটুকু? গুগল ম্যাপের দরকার নেই। হেঁটে গেলেও যে কয়েক মিনিট সময় লাগে, তা কলকাতার যে কেউ জানেন।
আর ইডেনের প্রেস বক্স থেকে হাই কোর্টের ‘বার’ হয়ে ‘বেঞ্চ’-এ পৌঁছতে জীবনের কতটা পথ পেরোতে হয়? বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন।
লর্ডসের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল যখন ইডেনে এল, তখন কলকাতার ময়দানে এক তরুণ ক্রীড়া সাংবাদিক হাতে নোটবুক-পেন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা। তার পরে আইনের ডিগ্রি নিয়ে ইংরেজি দৈনিকে চাকরি। কিন্তু আইনজীবী নলিনীচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি, বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো কত দিন আর আইন পাশ করেও ওকালতি না করে বসে থাকা সম্ভব? বছর তিনেকের মধ্যেই গায়ে কালো কোট উঠল। প্রায় ১৬ বছর হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি। তার পরে বিচারপতির আসনে। ইডেনের হাই কোর্ট প্রান্ত থেকে হাই কোর্টের বিচারপতির বেঞ্চ।
মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেঘালয়ে বদলি নিয়ে শোরগোল শুরু হওয়ায় এক প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল বলছিলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমি ওঁকে মোটেই পছন্দ করি না। মামলা শোনার সময় খুবই রূঢ় ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু বিচারপতি হিসাবে ওঁকে একশোয় একশোয় দেব। ন্যায়সঙ্গত কথা বলতে দ্বিধা করছেন, কাউকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন, সততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে—ওঁর শত্রুও এ অভিযোগ তুলতে পারবে না।’’
ঠিক যেন ক্রিকেট ধারাভাষ্যের মাইকেল হোল্ডিং। যিনি ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা আইসিসি-কেও দরকারে দু’কথা শুনিয়ে দেন। খেলার মাঠে বর্ণবৈষম্য নিয়ে মুখ খোলেন। জনতা আইপিএল নিয়ে মাতোয়ারা হলে হোল্ডিং এই ক্রিকেট নামক পিকনিকের নিন্দামন্দ করেন। তবু তাঁর ব্যারিটোনে অমোঘ ক্রিকেট-ভাষ্য অস্বীকার করা যাবে না।
গত বছর দুর্গাপুজোর সময়ই যেমন। পুজোকমিটির হোমরা-চোমরা কর্মকর্তা থেকে আমুদে জনতা কোভিডের কথা ভুলে চতুর্থীর রাত থেকেই রাস্তায় নামতে তৈরি। কলকাতা হাই কোর্টে বসে বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় রায় দিলেন, পুজো হোক। কিন্তু দর্শনার্থী নৈব নৈব চ। হাজরা মোড়ের তাঁদের বাড়িতে পারিবারিক দুর্গাপুজো হয়। তা বলে তিনি বাস্তব যুক্তি ভুলতে নারাজ।
কলকাতা থেকে মাদ্রাজ হাই কোর্টে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার পরে বলেছিলেন, এ বার থেকে কটুভাষী না হয়েই কাজ করবেন। পরিস্থিতি তাঁকে সে অবকাশ দেয়নি। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক নেতাদের প্রচারের ভিড়ে সায় দিয়ে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ডেকে এনেছেন দেখে সপাটে বলেছেন— কমিশনের কর্তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হওয়া উচিত। তামিলনাড়ুর হিন্দু ধর্ম সংক্রান্ত সরকারি কমিটির মাথায় মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনকে বসতে হলে তাঁকে মন্দিরে ভগবানের সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দু ধর্মে আস্থার শপথ নিতে হবে বলে দাবি উঠেছিল। প্রধান বিচারপতি মনে করিয়েছিলেন, দেশটা ধর্মনিরপেক্ষ। তার অর্থ অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতা। ধর্মের নামে হানাহানিটা বন্ধ হওয়া দরকার।
কলকাতাই হোক বা মাদ্রাজ হাই কোর্ট, বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারকেই রেয়াত করেননি। কিন্তু তাঁর বদলি বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়েই মৌলিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কলেজিয়াম তাঁর বদলির সুপারিশ করার পরে মাদ্রাজের আইনজীবীরা কলেজিয়ামের কাছে সিদ্ধান্ত বদলানোর দাবি তুলেছিলেন। তাঁদের প্রশ্ন, কেন বদলির পিছনে কারণ প্রকাশ করা হবে না? চালু হয়েও কেন সেই প্রথা তুলে দেওয়া হল?
কলকাতা আইনজীবী মহলের প্রাচীন প্রবাদ, বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় সামাজিক অনুষ্ঠানেও যান না। নিজের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কেন তাঁকে মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে মেঘালয়ে বদলি করা হল, সে কারণ এখনও অজানা। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে অবশ্য এমন ঘটনা নতুন নয়। গোধরা-কাণ্ডের পরে বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রিপোর্ট দিয়েছিলেন, সাবরমতী এক্সপ্রেসে আগুন লাগাটা নিছক দুর্ঘটনা। অযোধ্যা ফেরত করসেবকদের পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র কেউ করেনি। উমেশচন্দ্রের ছেলে আইনজীবী অমিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম একাধিক বার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিয়োগের সুপারিশ করেছে। কিন্তু মোদী সরকার এখনও তাতে সায় দেয়নি। সেই কারণও অজানা।
কিছু মানুষের শিরদাঁড়া এত সবের পরেও টানটান থাকে। বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় মাদ্রাজ থেকে বিদায়বেলায় তাঁর মতো ‘খিটখিটে বুড়ো বিচারপতি’-কে সহ্য করার জন্য সহকর্মীদের সাধুবাদ জানিয়ে এসেছেন। কিন্তু হাই কোর্টের সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিটা যে ভেঙে আসতে পারলেন না, তার জন্য আফসোস রয়ে গেল। তিনি যে শিলংয়ে গিয়েও অপ্রিয় সত্য বলতে পিছপা হবেন না, তা বুঝতে আইনের ডিগ্রি লাগে না।