Education system

ছাত্ররা ক্রেতা, কর্তৃপক্ষ বিক্রেতা

শিক্ষার বেসরকারিকরণ, এবং সেই সংক্রান্ত দুর্নীতি দিনের পর দিন দেখেও নাগরিক সমাজের সিংহভাগ মুখ বুজে থেকেছেন।

Advertisement

তাপস কুমার দাস

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২২ ০৬:৫৩
Share:

সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার স্বল্পবাস ছবি দেখে ভাবাবেগে আঘাত পাওয়া ছাত্রের অভিযোগ, এবং তার পরের ঘটনাক্রম দেখে স্তম্ভিত হওয়াই যায়। কিন্তু, তাতে বোঝা যাবে না যে, কেমন করে এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটল। এবং, ভবিষ্যতে আবারও ঘটতে পারে।

Advertisement

যে কথাগুলো বহু বার বলা হয়ে গিয়েছে, গোড়ায় আরও এক বার সেগুলোই বলে নিই, কারণ কথাগুলো দরকার হলে গজাল মেরে সমাজের মাথায় গেঁথে দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষিকার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অভিভাবকের অভিযোগ করার অসঙ্গত প্রক্রিয়াটি অপরিণত মানসিকতার পরিচায়ক। সন্তানের ভাবাবেগ এমন বিষয়ে আহত হলে কোনও সুস্থ সমাজে বাবা ছেলের কানটি মুলে দিয়ে বলতেন, অন্যের ব্যক্তিগত জীবনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করার অভ্যাসটি এখনই ছাড়ো। কিন্তু, অভিভাবকের অভিযোগের মতোই ভয়ঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ। কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক জন ব্যক্তিমানুষের শিক্ষক হিসেবে কী কী করণীয়, তার অফিশিয়াল গাইডলাইন আছে। শিক্ষকরা তাঁদের কাজের সময়ের মধ্যে, এবং শিক্ষাপ্রাঙ্গণের ভিতরে সেই নির্দেশিকা মেনে চলবেন। তার বাইরে তিনি এক জন ব্যক্তিমানুষ— তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের আইনত একটি কথাও বলার অধিকার নেই। কাজের সময়ের, এবং প্রতিষ্ঠানে পরিসরের বাইরে কোনও শিক্ষক যদি বেআইনি কাজ করেন, তা হলেও তার বিচার হবে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী, সেই বিচার করবে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ নয়। এই কথাগুলো খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

কিন্তু, শুধু এটুকু বলেই থেমে গেলে চলবে না। এই অনভিপ্রেত ঘটনার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত রয়েছে, যার শিকড় অনেক গভীরে, এবং অনেক দিন আগেই সেই বিষবৃক্ষের বীজ বপন হয়ে গিয়েছে। সেই ব্যাধিটি শুধু এই নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। দেশের কার্যত প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই সেই ব্যাধির বীজ রয়েছে— কারণ সেই বীজটি নিহিত ভারতের বর্তমান শিক্ষানীতির মধ্যে। বহু টাকা ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে, অথবা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো অঙ্কের অ্যাডমিশন ফি দিয়ে যখন ছাত্রছাত্রীরা কোনও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়, তখন তারা আর ছাত্রছাত্রী নয়— প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তখন মূলত আর্থিক তারে বাঁধা হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কাছে তারা রাজস্ব অর্জনের যন্ত্র; এবং, ছাত্রদের ও অভিভাবকদের চোখে তাঁরা ক্রেতা, প্রতিষ্ঠানের থেকে বহুমূল্যে শিক্ষাপরিষেবা কিনছেন। ক্রেতাকে সন্তুষ্ট রাখা বিক্রেতার পবিত্র দায়িত্ব— বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিসরেও ক্রেতা এবং বিক্রেতা, উভয় পক্ষই কথাটি মনে রাখেন। শুনতে পাই, কোনও ছাত্র জঘন্য ভাবে ফেল করলেও কর্তৃপক্ষ শিক্ষককে চাপ দিতে থাকেন তাকে পাশ করিয়ে দেওয়ার জন্য, বহু ছাত্রই অনভিপ্রেত আচরণ করেও অবলীলায় পার পেয়ে যায়।

Advertisement

বহু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা বলবে যে, এই বেচা-কেনা ভিত্তিক মিথোজীবিতায় কর্তৃপক্ষের কোনও আপত্তি থাকে না— কারণ, কড়া হলে ছাত্র ভর্তি কমে যাবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় মন্দা আসবে, যে সমস্ত বিত্তবান এবং ক্ষমতাশীল ব্যবসায়ীর লগ্নিকৃত অর্থে অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে, সেই লগ্নিকারীদের কৈফিয়ত দিতে হবে। ব্যবসায় মন্দা কেউই চায় না— খদ্দেরই লক্ষ্মী। ক্লায়েন্ট চটাবে কোন ব্যবসাদার?

বেকারত্বের এই বাজারে, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দুর্নীতি আর নয়ছয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে শিক্ষক অতি সহজলভ্য। এক জনকে ছাঁটাই করলে আরও দশ জন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবেন। জোগান বাড়লে দাম কমে— তাই শিক্ষকদেরও দাম নেই। তাঁদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, অধিকার নিয়ে মাথা ঘামানোর দায় কর্তৃপক্ষ এবং লগ্নিকারীর নেই।

শিক্ষার বেসরকারিকরণ, এবং সেই সংক্রান্ত দুর্নীতি দিনের পর দিন দেখেও নাগরিক সমাজের সিংহভাগ মুখ বুজে থেকেছেন। শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামোতে পচন ধরার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করেননি। আজ আঁতকে উঠলেই তো হবে না।

বিষয়টা তাই স্বল্পবাস ছবির নয়, বা সেই সংক্রান্ত আধুনিকতা অথবা অশালীনতারও নয়। মূল বিষয়টা আইনত বিচার পাওয়ার অধিকারের, গণতন্ত্রের; পেশাদার ও ব্যক্তিগত পরিচিতির বিযুক্তিকরণের অধিকারের; প্রতিষ্ঠান কোনও ব্যক্তিমানুষের উপর কতটা অধিকার বিস্তার করতে পারে, তার; শিক্ষাজগতে অরাজকতা ও কু-রাজনীতির; শিক্ষার বেসরকারিকরণে টাকার খেলার। ব্যক্তিস্বাধীনতার অবমাননা বলে গোসা করার আগে দর্পণের সামনে দাঁড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির এই কবর তো আমরাই খুঁড়েছি, অথবা কবর খোঁড়ার কাজে সহযোগিতা করেছি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে।

হরীশ-চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, প্রয়াগরাজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement