রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দটির মধ্যে বেশ একটা রোম্যান্টিসিজ়ম আছে, সন্দেহ নেই! রাষ্ট্রদ্রোহী বললেই কেমন যেন উদয়ন পণ্ডিতের কথা মনে হয়— ‘অনাচার করো যদি/ রাজা তবে ছাড়ো গদি’... কিংবা মনে হয় চারুলতা-র অমলের কথা, ‘সিডিশন, সিডিশন’ বলে তার উত্তেজনা!
আজকাল সিডিশন চার পাশে আকছার। কে কবে কী কারণে রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা পেয়ে যাব, তা অনেক সময় নিজেরাও জানি না। তবে এটুকু জানি যে, এই তকমা পেতে এই ভারতবর্ষে বড় একটা প্রয়াস করার প্রয়োজন নেই। ওই দু’-চার বার ‘দড়ি ধরে মারো টান/ রাজা হবে খান খান’ গোছের স্লোগান আওড়ানো, সরকারের প্রায় যে কোনও কাজ বা নীতির সমালোচনা করে দু’-চার কথা বলা বা লেখা, এমনকি, টুইট করলেও তকমা মিলে যাবে।
এই যেমন সাংবাদিক বিনোদ দুয়া। সরকারের কোভিড মোকাবিলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করেছিলেন তিনি। আর যায় কোথা। হিমাচল প্রদেশের এক বিজেপি নেতা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে এফআইআর করলেন দুয়ার বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্টে তার সুরাহা চেয়েছিলেন দুয়া। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট কার্যত গণতন্ত্রের বিবেকের ভূমিকাই পালন করেছে— খুব স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে যে, ভিন্ন মত প্রকাশ করা রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। এবং এই প্রশ্নে এই দেশের সমস্ত সাংবাদিকের রক্ষাকবচের অধিকার রয়েছে।
শীর্ষ আদালতের বলার প্রয়োজন ছিল না, এত দিনের গণতন্ত্রের এই তথ্য জানার কথা ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু কোথায় সেই রক্ষাকবচ? শুধু তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ নয়, বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধে ভুয়ো খবর ছড়ানো, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করায় প্ররোচনা দেওয়া, মানহানি করা, প্রভৃতি ধারায় পুলিশ নানাবিধ মামলা দায়ের করেছিল।
লক্ষণীয়, এ দেশে বহু দিন যাবৎ সুপ্রিম কোর্ট সাংবাদিকের রক্ষাকবচ হিসেবে এবং গণতন্ত্রের অঙ্গাঙ্গি শর্ত হিসেবে বিরুদ্ধ মত শোনার উপরে জোর দিয়ে এসেছে। ১৯৬২ সালে সুপ্রিম কোর্টেই কেদারনাথ সিংহ মামলার রায়ের উল্লেখ করে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত এবং বিচারপতি বিনীত সরণের বেঞ্চ বলেছিল, ওই মামলার রায়ে আগেই বলা হয়েছে যে, ভিন্ন মত প্রকাশ রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। প্রসঙ্গত, ওই মামলাতেই এর আগে শীর্ষ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পাশাপাশি এটাও বলেছিল যে, কোনও নির্বাচিত সরকারের কাজকর্ম যথাযথ ভাবে চলার জন্যই বাক্স্বাধীনতা, সরকারের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষাও খুবই জরুরি।
রাষ্ট্রদ্রোহ বিষয়টি আমাদের সংবিধানের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। অম্বেডকরের মতো সংবিধান প্রণেতারাও রাষ্ট্রদ্রোহিতাকে সংবিধানের মধ্যেই রেখে গিয়েছেন। তবে অম্বেডকর বলেছিলেন যে, সংবিধান মান্য করার দায়িত্ব যাঁদের উপর থাকবে, বিষয়টি তাঁদের উপরে নির্ভর করবে। অম্বেডকর নিশ্চয়ই সে সময়ে এ কথা ভাবেননি যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের মতো বিপজ্জনক এক অস্ত্র এ রকম যথেচ্ছ ও নির্বিচারে বিরুদ্ধ স্বর দমিয়ে রাখার কাজে ব্যবহৃত হবে।
বিনোদ দুয়ার ঘটনা নিছকই হিমশৈলের চূড়ামাত্র। ভারতীয় গণতন্ত্রে যে কোনও সময় যে কাউকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়াটা শাসকের খুব প্রিয় বিষয়। তবে তার মধ্যেও ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনার প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে— সে তথ্য চোখের সামনেই রয়েছে।
মজার কথা হল, যে ব্রিটিশ শাসন কায়েম রাখতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো ধারা ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, গত ২০০৯ সালে খাস ব্রিটেনেই সেই আইন অবলুপ্ত হয়েছে। অথচ, ঔপনিবেশিক ভারতে কায়েম করা এই আইনের গুরুত্ব স্বাধীন ভারতে যেন দিন দিন বেড়ে চলেছে, এই আইন তুলে দেওয়া তো দূরের কথা।
স্বাধীন ভারতে এখন যে আইনের ফাঁদে পড়েছেন বিনোদ দুয়া, রাজদীপ সরদেশাই, মৃণাল পান্ডে, অনন্ত নাগেরা, সেই আইনই প্রয়োগ করা হয়েছিল পরাধীন ভারতে। ব্রিটিশ সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনে মহাত্মা গাঁধী, বালগঙ্গাধর টিলক, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে। সিডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন প্রসঙ্গেই গাঁধী বলেছিলেন, ‘প্রিন্স অব দি ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’।
‘প্রিন্স’ই বটে! একটি পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের গবেষণা-প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, দেশে ২০১০-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০-র ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতা সংক্রান্ত ৮১৬টি মামলায় প্রায় ১১,০০০ মানুষকে জড়ানো হয়েছে। তার মধ্যে ৬৫ শতাংশ মামলাই হয়েছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে। যাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ, তাঁদের মধ্যে বিরোধী রাজনীতিক, ছাত্র, সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষাবিদও আছেন।
ওই সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, গত দশকে রাজনীতিক ও সরকারের সমালোচনা করার জন্য যে ৪০৫ জন ভারতীয়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়েছে, তার ৯৬ শতাংশ মামলাই দায়ের হয়েছে ২০১৪-র পরে। এর মধ্যে ১৪৯ জন অভিযুক্ত হয়েছেন মোদীর বিরুদ্ধে ‘সমালোচনা’ বা ‘মানহানিকর’ মন্তব্য করার জন্য। ১৪৪ জনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে এই একই কাজের জন্য।
উত্তরপ্রদেশের আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১০ থেকে সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহিতা সংক্রান্ত যে ১১৫টি মামলা হয়েছে তার ৭৭ শতাংশই দায়ের হয়েছে গত চার বছরে, যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অভিযোগ ‘জাতীয়তাবাদ’ বিষয়ক। কেউ সিএএ এবং এনআরসি-র প্রতিবাদ করেছেন, এমনকি, কেউ কেউ ২০১৭-য় আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ভারতের হারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করায় তাঁর বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের হয়েছে!
তবে মনে রাখতে হবে, সেই জওহরলাল নেহরুর সময় থেকে মনমোহন সিংহের জমানা— কংগ্রেসই বা কবে এই মারাত্মক আইনকে দেশ থেকে তাড়ানোয় উদ্যোগী হয়েছিল? আলোচনা করলে, বা আইন কমিশনে বিষয়টি পাঠালেই কি নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দেওয়া যায়? যেটুকু বলার তা হল, ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশিত ইস্তাহারে কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ক্ষমতায় ফিরলে এই আইনটির মূল্যায়ন করবে। কংগ্রেসি ইস্তাহারে এই প্রতিশ্রুতি দেখে প্রয়াত বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি সে সময় তীব্র ভাষায় কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেছিলেন, তারা দেশের নিরাপত্তাকে বেচে দিচ্ছে। অবশ্য ফল বেরোনোর পরে কংগ্রেসের ভিতর থেকেই সমালোচনা ভেসে এসেছিল, দলের এই নির্বাচনী বিপর্যয়ের পিছনে ইস্তাহারের ওই প্রতিশ্রুতিরও ভূমিকা রয়েছে!
তীব্র জাতীয়তাবোধের কাছে কী ভাবে নতিস্বীকার করতে হয় গণতান্ত্রিক বোধকে, তার নিদর্শন এখন বিশ্ব জুড়েই। হাউ ডেমোক্র্যাসিস ডাই গ্রন্থে স্টিভেন লেভিট্সকি এবং ড্যানিয়েল জিবলাট বিশ্লেষণ করেছেন, কী ভাবে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রী’রা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কাজ করে যান। এই দুই গবেষক বলছেন, মূলত চার ভাবে তাঁরা এই কাজটা করে থাকেন। প্রথমত, কথায় বা কাজে ক্রমাগত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আক্রমণ করা। দ্বিতীয়ত, বিরোধিতাকে বৈধতা না দেওয়া। তৃতীয়ত, মানবাধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করার তীব্র প্রবণতা। চতুর্থত, হিংসায় ইন্ধন দেওয়া।
পরমত-অসহিষ্ণু এই ভারতে চারটি প্রবণতাই যেন স্পষ্ট— প্রতিবাদ মানেই তাই আজ রাষ্ট্রদ্রোহ।