Sourced by the ABP
চিৎপুরের ব্রাহ্মসমাজে সান্ধ্যকালীন সাপ্তাহিক উপাসনা, সমবেত ভক্তদের সঙ্গে একাসনে বসে দেওয়ান রামমোহন রায়। উপনিষদের ব্যাখ্যার পর শুরু হল সঙ্গীত— সে কালের প্রচলিত কবিগান, আখড়াই, কীর্তন, প্রণয়গীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই গান— ব্রহ্মসঙ্গীত— যা বাংলা গানের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র যুগ সৃষ্টি করেছিল। সেই সময় বাংলা গানে যে বিষয়ের লঘুতা, নিম্নরুচি ও সামাজিক তামসিকতা ছিল, ব্রহ্মসঙ্গীত সেখানে উচ্চমান প্রতিষ্ঠা করল: গানের ভাবগাম্ভীর্যে, সাত্ত্বিক দ্যোতনায়, সুর ও স্বরের প্রয়োগে, তালের শুদ্ধতায়।
ব্রহ্মসঙ্গীত নামটি সম্ভবত প্রাচীন সংস্কৃত ‘ব্রহ্মগীতি’ বা ‘ব্রহ্মগীতিকা’র অনুকরণে। এ গানের রচনা থেকে গাওয়ার রীতি, সবই রামমোহনের পরিকল্পিত। ব্রহ্মোপাসনার জন্য পরিকল্পিত হলেও তাঁর রচিত গান কোনও বিশেষ গণ্ডিবদ্ধ ছিল না, তাঁর ধর্মমতের মতোই তা ছিল উদার, সর্বজনীন। বিশ্বব্যাপী যে অখণ্ডকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তাকেই রূপ দিয়েছিলেন গানে। বাঙ্গালীর গান গ্রন্থে দুর্গাদাস লাহিড়ী লিখেছেন, রাজা রামমোহন রায় এই যুগের পথপ্রদর্শক, প্রথম ব্রহ্মসঙ্গীত-রচয়িতা— পরবর্তী কালে অন্যান্য ব্রহ্মসঙ্গীত রচয়িতারা যা অনুকরণ করেছেন।
রামমোহন বুঝেছিলেন, ব্রহ্মোপাসনার পদ্ধতি হিসাবে ধ্যান ও মন্ত্রের পাশাপাশি গানেরও ভূমিকা আছে। ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে তিনি যেমন সমর্থন সংগ্রহ করেছিলেন শাস্ত্র থেকে, সঙ্গীতের বেলাতেও তা-ই। ১৮২৩-এ প্রার্থনাপত্র পুস্তকে লিখলেন, “যাজ্ঞবল্ক্য বেদ্গানে অসমর্থদের প্রতি কহিয়াছেন, ঋকসংজ্ঞক গান ও গাথাসংজ্ঞক গান ও পাণিকা ও দক্ষবিহিত গান ব্রহ্মবিষয়ক এই চারি প্রকার গান অনুষ্ঠেয় হয়, মোক্ষসাধন এই যে সকল গান ইহার অভ্যাস করিলে মোক্ষপ্রাপ্তি হয়।” এক দিকে তিনি সঙ্গীতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ, অন্য দিকে তাকে সাধনাস্বরূপ বিবেচনা করে উপাসনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি করেন। তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য, হিন্দুস্থানি রাগসঙ্গীতের আদর্শে ও অনুকরণে গান রচনা। ব্রহ্মসঙ্গীতের ভাবমূর্তি বা গাম্ভীর্য রক্ষায় তিনি প্রচলিত ধারার মধ্যে উৎকৃষ্টতম ধারাটিই অবলম্বন করেছিলেন।
১৮২১-১৮২৮ পর্যন্ত তিনি ক্যালকাটা ইউনিটারিয়ান কমিটির সভ্য ছিলেন, নিয়মিত তাঁদের উপাসনায় যোগ দিতেন। খ্রিস্টীয় উপাসনার অঙ্গগুলি তিনি খুঁটিয়ে দেখেছিলেন। উইলিয়াম কেরির পরিবারের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে রামমোহন তাঁদের পারিবারিক উপাসনায় যোগ দেন, তাঁরা তাঁকে আইজ়াক ওয়াটস রচিত খ্রিস্টীয় স্তোত্রগ্রন্থ উপহার দেন। খ্রিস্টীয় উপাসনার সমবেত সঙ্গীত ‘অ্যাট ওয়ান্স দে সিং’ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তবে ইউনিটারিয়ানদের সংস্পর্শে এসেও কিন্তু বিদেশি স্তব (hymn) রচনায় তিনি উদ্বুদ্ধ হননি।
রামমোহনের জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “বেদান্ত শাস্ত্রে ব্রহ্মরূপ যেরূপ ব্যাখাত হয়েছে, রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত সকল সেইভাবে রচিত। এতদ্ভিন্ন, উহা বেদান্ত অনুযায়ী সাধনের একান্ত উপযোগী।” রামমোহন প্রথম গান রচনা করেন ১৮১৬ সালে, ‘কে ভুলাল হায়’ এবং তাঁর রচিত শেষ গান ১৮৩২-এর ‘কি স্বদেশে কি বিদেশে যথায় তথায় থাকি’। ১৮৩২-এর ২২ সেপ্টেম্বর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধাপ্রসাদকে এই গানটি পাঠিয়ে চিঠিতে লেখেন, “ব্রাহ্মসমাজে কাজের নিমিত্ত এক গীত পাঠাইতেছি... গায়কদিগকে দিবে।”
গান রচনায় তিনি নতুন কোনও পন্থার উদ্ভাবন করেননি। তিনি ও সমসাময়িক ব্রহ্মসঙ্গীত রচয়িতারা সে যুগের পয়ার ও চতুষ্পদী রীতিই অবলম্বন করেছিলেন, গায়নভঙ্গি সে কালের উপযোগী পদ্ধতিতে নির্ধারিত হয়েছিল। যা ভারতের শাশ্বত, সহজে হৃদয়েও প্রবেশ করে, সেই সঙ্গীতই নিয়েছিলেন তিনি। বেদান্তে জ্ঞানমার্গ ও উপাসনা যে ভাবে ব্যাখ্যাত, রামমোহনের গানের অন্তর্নিহিত ভাব তার সঙ্গীতময় প্রকাশ।
তাঁর গান রচনার প্রেরণা সাঙ্গীতিক ও আধ্যাত্মিক। প্রথমটির সূত্রে তিনি হিন্দুস্থানি রাগসঙ্গীতের বহিরঙ্গের রূপটি নিলেন, দ্বিতীয়টির সূত্রে নির্বাচন করলেন গানের বিষয়বস্তু। ব্রহ্ম নিরাকার ও সর্বব্যাপী, সংসার অনিত্য, বৈরাগ্য সাধন ও পরমেশ্বরে আত্মসমর্পণ তাঁর গানের বিষয়। ‘ভাব সেই একে, জলে স্থলে শূন্যে যে সমান ভাবে থাকে’ গানটি ছান্দোগ্য উপনিষদে শ্বেতকেতুকে পিতার ব্রহ্মজ্ঞান দানের প্রসঙ্গ মনে করায়। মহানির্বাণতন্ত্রের বিখ্যাত উক্তি ‘ভয়ানাং ভয়ং ভীষণাং ভীষণানাম্, গতিঃ প্রাণিনাং পাবনাং পাবনানাম্’-কে ভিত্তি করে তাঁর গান ‘ভয় করিলে যাঁরে না থাকে অন্যের ভয়’।
রামমোহন জোর দিয়েছিলেন গানের পরিবেশনের উপরেও। ব্রাহ্মসমাজে গান গাওয়ার জন্য নিয়ে আসেন দুই ভাই কৃষ্ণপ্রসাদ ও বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীকে, কৃষ্ণনগর রাজসভায় হসনু খান, দিলওয়ার খান, মিয়াঁ মীরণ প্রমুখের কাছে ধ্রুপদ ও খেয়াল শিখেছিলেন তাঁরা। এঁদের সঙ্গে সঙ্গত করতে রামমোহন নিযুক্ত করেন পাখোয়াজে তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ ওস্তাদ গোলাম আব্বাসকে। রামমোহনের যুগে ব্রহ্মসঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গতে থাকত তম্বুরা, বেহালা, পাখোয়াজ ও তবলা।
বাংলার গানে আঠারো-উনিশ শতকে প্রধানত দু’টি ধারা লক্ষণীয়— উত্তর ভারতীয় তথা হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং লৌকিক ধারা: কীর্তন বাউল ঝুমুর পাঁচালি কবিগান, আঞ্চলিক লোকগীতি। সঙ্গীত বলতে লোকে কবিগান ও আখড়াই গান বুঝত। ১৭৬০-১৮৩০ সাল পর্যন্ত কবিগান বিপুল জনপ্রিয় ছিল। নদিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলে প্রচলিত আখড়াই গান চুঁচুড়া হয়ে কলকাতার আসরে আসে। শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সভাগায়ক কলুইচন্দ্র সেন আখড়াই গানকে সংশোধন করেন, পরে নিধুবাবুর হাতে তা আরও পরিমার্জিত হয়। আর একটি ক্ষেত্র ছিল অবস্থাপন্নদের— শোভাবাজার রাজবাড়ি, পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুরের বাড়ি, পাইকপাড়ার সিংহবাড়ি, জোড়াসাঁকো রাজবাড়ি ইত্যাদি জায়গার নিজস্ব সঙ্গীতসভা, সাধারণের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। নিধুবাবু তথা রামনিধি গুপ্ত কোনও ধনীর সঙ্গীতসভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, বটতলা আটচালায় ও শোভাবাজার-বাগবাজার অঞ্চলে গান করতেন, শ্রোতারা সেখানে এসে গান শুনতেন।
পশ্চিমে রাগসঙ্গীতের তালিম নিয়ে বাংলায় এক বিশিষ্ট রীতির গানের রচয়িতা হিসাবে তিন জন সঙ্গীতজ্ঞ উল্লেখযোগ্য: গুপ্তিপাড়ার কালী মির্জা, বর্ধমানের দেওয়ান রঘুনাথ রায় ও বিষ্ণুপুরের রামশঙ্কর ভট্টাচার্য। কালী মির্জা তথা কালীদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের শিষ্য। ১৭৭০-৭১ সালে তিনি বারাণসীতে বেদান্তশিক্ষা করেন, দিল্লি ও লখনউয়ে ফারসি ভাষা শেখেন, ১৭৮০-৮১ সালে গুপ্তিপাড়ায় সঙ্গীত-বিশারদ হয়ে ফিরে আসেন। ফারসি ভাষায় তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান, পশ্চিমি পোশাক ও আদবকায়দার জন্য তাঁকে ‘মির্জা’ বলে ডাকা হত। কালী মির্জা বর্ধমানের রাজা প্রতাপচাঁদের সভায় গায়ক নিযুক্ত হন, পরে কলকাতায় গোপীমোহন ঠাকুরের সঙ্গীতসভায় যোগ দেন। টপ্পাগায়ক ও বাংলায় উৎকৃষ্ট টপ্পার রচয়িতা হিসাবে খ্যাত এই সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন রামমোহনের সঙ্গীতগুরু। অমৃতলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গীতলহরী-তে আছে, “মহাত্মা রামমোহন রায় কলিকাতায় অবস্থান কালে মধ্যে মধ্যে মির্জা মহাশয়ের নিকট সঙ্গীত শিক্ষা করিতে যাইতেন।” বিপুল, জটিল অথচ সূক্ষ্ম আবেদনময় রাগসঙ্গীতের প্রকৃতি, বিভিন্ন রাগের গঠন ও রূপ, সুরের লীলারহস্য ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কালী মির্জার উপদেশ নিতেন।
বর্ধমানের রাজার দেওয়ান রঘুনাথ রায় রাজা তেজচাঁদের আনুকূল্যে দরবারের গুণিজনের থেকে সঙ্গীতশিক্ষা করেন। রঘুনাথ রায়ের প্রধান সাঙ্গীতিক কীর্তি হল, তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় চার তুকের (স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ) এবং খেয়ালাঙ্গের রচয়িতা, আদি খেয়াল গায়ক। রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের সঙ্গীতশিক্ষা আগরা অঞ্চল থেকে আগত জনৈক হিন্দু সঙ্গীতাচার্যের কাছে, বিষ্ণুপুরে। তিনি বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রবর্তক। রামশঙ্কর কখনও কলকাতায় আসেননি, কিন্তু তিনি প্রথম বাঙালি ধ্রুপদ গায়ক, ধ্রুপদাচার্য ও বাংলা ভাষায় প্রথম ধ্রুপদ গানের রচয়িতা।
সে যুগের স্বল্পায়তন রাগসঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে সমাজগৃহে রামমোহনের সঙ্গীত পরিবেশ সৃষ্টি একটি বিশেষ কাজ। রাগসঙ্গীত যখন মুষ্টিমেয় ধনীগৃহে আবদ্ধ, রামমোহন তখন সমাজগৃহে সাধারণের জন্য সঙ্গীতের দ্বার খুলে দিলেন। ফলে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশে সঙ্গীতের প্রতি যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, উত্তরোত্তর তার শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনী-তে লিখছেন, “বর্তমান যুগে রাজা রামমোহন রায় ধর্মমন্দিরে সঙ্ঘ-উপাসনার প্রবর্তক, মন্দিরের উচ্চাঙ্গ তাল, মান, লয় সংযোগে গানের প্রবর্তন তিনিই করেন। রাজার আরব্ধ কার্য দেবেন্দ্রনাথের দ্বারা উজ্জীবিত হয়; তিনি আদি ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে উৎকৃষ্ট সঙ্গীতের ব্যবস্থা করেন। ব্রহ্মসঙ্গীত তিনি স্বয়ং রচনা করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ নানা রকম হিন্দী গান হইতে সুর আহরণ করিয়া বা হিন্দী ভাঙ্গিয়া ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় প্রবৃত্ত হন। রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে ভগবদ্বিষয়ক সঙ্গীত রচনার আদর্শ তাহাঁরা স্থাপন করে গিয়েছিলেন।” রামমোহনের প্রয়াস ঠাকুরবাড়ির সাঙ্গীতিক পরম্পরায় পূর্ণতা পেয়েছিল। ব্রহ্মসঙ্গীত এক বিশেষ আবেদন নিয়ে এসেছিল, তৎকালীন গানবাজনার জগতে সৃষ্টি করেছিল একাধারে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক রুচি।