১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী মুক্তি পাওয়ার পরেও বেশ কিছু দিন সত্যজিৎ রায় তাঁর দ্বিতীয় ছবির বিষয়বস্তু স্থির করে উঠতে পারেননি। অপরাজিত-র কথা যে ভাবেননি তা নয়, কিন্তু পর-পর এক ধরনের ছবি করতে তাঁর চিরকালই ঘোরতর আপত্তি ছিল। শেষ অবধি যদিও অপরাজিত-ই করেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সত্যজিৎ আগামী ছবির সম্ভাব্য বিষয়ের যে তালিকা করেছিলেন, সেখানে রয়েছে প্রায় এক ডজন নাম— যার শুরুতে ঘরে-বাইরে আর শেষে পদ্মা নদীর মাঝি। একটা বাদে সবই হয় উপন্যাস, নয় ছোট গল্প; ব্যতিক্রম শুধু আট নম্বর: ‘রামমোহন’— আর তার পাশে একটা তারকাচিহ্ন। এই পরিকল্পনা সম্বন্ধে আর তথ্য পাওয়া যায় না; এমনকি এই ছবি হলে তা ডকুমেন্টারি হত না কাহিনিচিত্র, সেটাও অনিশ্চিত।
পথের পাঁচালী-র মতো সফল কাহিনিচিত্র করার পর সত্যজিৎ যে আদৌ তথ্যচিত্র করার চিন্তা করেছিলেন সেটা বিশ্বাস করা কঠিন— কিন্তু রামমোহন সম্বন্ধে ফিচার ফিল্মই যদি করতে চেয়ে থাকেন, তা হলে তা কোন গল্পের ভিত্তিতে? হয়তো এ সব প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেও খুঁজে পাননি, তাই এ ছবি তো হয়নিই, ভবিষ্যতেও রামমোহনকে নিয়ে ছবি করার ইচ্ছা সত্যজিৎ প্রকাশ করেননি। সশরীরে রামমোহনকে এক বারই তাঁর ছবিতে দেখা যায়, আর রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রের সেই দৃশ্যের চলচ্চিত্র কৌশল, ধারাভাষ্য আর অভিনয় দেখে যদি মনে হয় যে, সাময়িক একটা আগ্রহ হয়ে থাকলেও রামমোহন সম্বন্ধে সত্যজিৎ তেমন চিন্তা কখনও করেননি, তা হলে সে ধারণার নিরসন হয় চারুলতা-য়।
উনিশ শতকের ইতিহাসের এবং বাংলার তথাকথিত নবজাগরণের যে ব্যতিক্রমী ভাষ্য চারুলতা-র পরতে-পরতে বুনে দিয়েছেন চিত্রনাট্যকার, তার কিছুই মূল গল্পে ছিল না। রবীন্দ্রনাথের আখ্যানের সময়কালও স্পষ্ট নয়, তবে সরকারের ‘সীমান্ত-নীতি’ সম্বন্ধে ভূপতির সম্পাদকীয় লেখার একটা উল্লেখ আছে, যা অনেক পাঠকেরই হয়তো চোখে পড়ে না, বা পড়লেও তুচ্ছ ডিটেল বলে মনে হয়। সত্যজিৎ কিন্তু এই সামান্য একটা মন্তব্য থেকেই ১৯০১ সালে প্রকাশিত ‘নষ্টনীড়’-কে ১৮৭৯-৮০’র চারুলতা-য় রূপান্তরিত করেন। সে যুগটা শুধু যে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম অধ্যায় তা নয়, ভারতের রাজনীতিতেও তখন এসেছে নতুন জোয়ার। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজ়রেলি ও বড়লাট লিটনের আফগানিস্তান-ভারত সীমান্তের ‘বিজ্ঞানসম্মত’ পরিমার্জনের ফলস্বরূপ দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ সদ্য শেষ হয়েছে, দেশবাসীর উপর একের পর এক নতুন কর বসছে, নাট্যাভিনয় হয়েছে নিয়ন্ত্রিত, ভারতীয়দের আগ্নেয়াস্ত্র কেনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে আর্মস অ্যাক্ট জারি করে। সাম্রাজ্যবাদের এই আগ্রাসী রূপের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে ইংরেজি-শিক্ষাপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত সমাজ, তথাকথিত ‘মডারেট’ বা নরমপন্থী জাতীয়তাবাদীরা ১৮৭৬-এ ভারত সভার (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন) প্রতিষ্ঠা করে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তাঁদের যাত্রা শুরু করেছেন, সীমান্ত-নীতি ও সরকারের অন্যান্য কীর্তি নিয়ে লেখা হচ্ছে উত্তপ্ত সম্পাদকীয়। ভূপতিকে এই সন্ধিক্ষণের প্রতিভূ করে ‘নষ্টনীড়’-এর সূক্ষ্ম, মরমি মনস্তাত্ত্বিক অন্বেষণের সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ যোগ করেন সত্যজিৎ। এবং সে জন্যই প্রয়োজন হয় রামমোহনকে।
কিন্তু ১৮৩৩-এ যাঁর মৃত্যু, ১৮৭৯-৮০’র গল্পে তিনি কেন প্রাসঙ্গিক? পাঁচ দশক পূর্বের রাজনৈতিক পরিবেশে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের উন্নতির জন্য যে সব প্রস্তাব রামমোহন করেছিলেন তার জন্য নয়, রামমোহনের মূল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। তিনি ভারতের স্বাধীনতার কথা বলছিলেন না, বলা সম্ভবও ছিল না। বরং ভারতবর্ষের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক আরও বিস্তৃত করতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাঁর মতে, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক একাধিপত্যই হল অপশাসনের কারণ— যত বেশি ইংরেজ ভারতের সঙ্গে ব্যবসা করবার সুযোগ পাবে, ভারতে পাকাপাকি বসবাসী ইংরেজের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই উন্নত হবে দেশের শাসনব্যবস্থা, ততই বিস্তৃত হবে ভারতের আন্তর্জাতিক উপস্থিতি ও প্রভাব। কোম্পানি-যুগের অবসানের পর এ সব প্রস্তাব অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, তবে সেগুলির উৎস যে লিবারাল মতাদর্শে (‘উদারনীতি’ বললে অনেক কিছুই উহ্য থেকে যায়), তার আশ্চর্য বিকাশ হয় উনিশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। ব্রিটেনে লিবারাল পার্টি সরকার গঠন করে চার বার, প্রতি বারই প্রধানমন্ত্রী হন উইলিয়ম গ্ল্যাডস্টোন। গ্ল্যাডস্টোনের প্রথম সরকারের সময় ভারতীয় মডারেটদের উত্থান হয়নি, কিন্তু ১৮৮০-র নির্বাচনে— ঠিক চারুলতা-র সময়ে— ডিজ়রেলি ও টোরি পার্টিকে পরাজিত করে যখন পুনরায় ক্ষমতায় আসে লিবারালরা, ভারতের রাজনৈতিক জগতে তখন সুরেন্দ্রনাথ ও সতীর্থরা সুপ্রতিষ্ঠিত।
চারুলতা-র প্রথমার্ধে এই নির্বাচনের গুরুত্ব সম্বন্ধে ভূপতি অমলকে যা কিছু বলে, তার সবই প্রামাণিক। শুধু ডিজ়রেলি/ লিটনের অপশাসনের সমাপ্তি নয়, বিলেতের দ্বিতীয় লিবারাল সরকারের কাছে ভারতীয় মডারেটদের ছিল বহু প্রত্যাশা। রামমোহন কোম্পানির বাণিজ্যিক একাধিপত্য ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন, সুরেন্দ্রনাথরা চেয়েছিলেন উচ্চ সরকারি পদে সাদা-চামড়া সিভিলিয়ানদের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিনাশ করতে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভারতের স্থান অক্ষত রেখে দেশ শাসনের কাজ ক্রমান্বয়ে ভারতীয়দের হাতে নিয়ে এসে ভারতকে অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো স্বায়ত্তশাসিত উপনিবেশে রূপান্তরিত করাই ছিল লক্ষ্য। তাই তাঁরা নিজেদের রামমোহনের উত্তরাধিকারী মনে করতেন, তাই লিবারালদের নির্বাচনী সাফল্য উপলক্ষে ভূপতির ঘরোয়া অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান লিবারাল’ রামমোহনকে বন্দনা করে।
এই পর্যন্ত চারুলতা-য় সত্যজিৎ শুধুমাত্র প্রামাণিক ঐতিহাসিক তথ্যই সরবরাহ করেন, কিন্তু ভূপতির প্রশস্তির ঠিক পরেই যখন রামমোহন-রচিত গান শুরু হয়, তখন পরিচালক হয়ে যান কথকও। যে গানটি তিনি আমাদের শোনান, সেটি রামমোহনের সর্বাধিক পরিচিত গান হলেও যে গান শুরু হয় ‘মনে কর, শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’ দিয়ে আর যার পরের স্তবকেই রয়েছে ‘গৃহে হায় হায় শব্দ, সম্মুখে স্বজন স্তব্ধ’, তা কি আনন্দানুষ্ঠানের উপযুক্ত? এর পর আমন্ত্রিতরা ‘আর একটু লিবারাল’ হয়ে নিধুবাবুর টপ্পা শোনেন, কিন্তু সে গান ‘এমনও যে হবে, প্রেম যাবে, এ তো কভু মনে ছিল না’ আনন্দ-সম্মিলনের জন্য প্রায় সমান অনুপযুক্ত। এই অসঙ্গতির জন্যই কিন্তু গান দু’টি অন্য মাত্রা পায় ছবির ভাষ্যে, হয়ে ওঠে নরমপন্থীদের স্বপ্নভঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী, এবং চারু-ভূপতির পারিবারিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। গানের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় ইতিহাস পুনর্নির্মাণই শুধু করেন না, আখ্যান-বহির্ভূত কথকেরও ভূমিকা নেন।
বিলেতের ১৮৮০-র নির্বাচনে গ্ল্যাডস্টোনের বিজয়ের পর ভারতের ভাইসরয় হয়ে আসেন লর্ড রিপন; মডারেটদের পছন্দসই দু’-একটা পরিবর্তনও তিনি করেন শাসনব্যবস্থায়, কিন্তু তার পরই ঘটে বিপর্যয়। মফস্সলের ইউরোপীয়-অভিযুক্তদের বিচার করার অধিকার যখন ভারতীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের দেওয়ার প্রস্তাব করেন রিপন, তখন তাঁর নিজের মন্ত্রিসভার সভ্যবৃন্দ থেকে শুরু করে ভারতনিবাসী প্রায় সব সরকারি/বেসরকারি ইউরোপীয় বিদ্রোহে জ্বলে ওঠেন এবং সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে যায় রামমোহন ও তাঁর উত্তরসূরিদের ব্রিটিশ-ভারতীয় যুগ্ম-সাম্রাজ্যের লিবারাল স্বপ্ন। কংগ্রেসের পত্তন হয় ১৮৮৫-তে, সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদনে ভাটা পড়ে না, কিন্তু মডারেটদের প্রার্থনার ফল হয় না। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ক্রমশ উগ্রতর রূপ নেয়, সে যুগের মন্ত্র বন্দে মাতরম্, মন্ত্রদাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র; স্বদেশ তার ‘নেশন’ নয়, মাতৃরূপিণী দেবী। এই যুগকেও সত্যজিৎ টেনে আনেন চারুলতা-য় অমলের আনন্দমঠ প্রীতির সূত্রে, যদিও সেই উপন্যাসের ধারাবাহিক প্রকাশ আরম্ভ হয় ছবির সময়কালের এক বছরেরও বেশি পরে, ১৮৮১ সালের মার্চে বঙ্গদর্শন-এ। দর্শককে ছবিতে বর্ণিত ইতিহাসের পরিণতির আভাস দেন, তার জন্য কালাতিক্রমণ করতেও দ্বিধা করেন না।
রামমোহনকে নিয়ে যে ছবি করার চিন্তা এক দিন সত্যজিৎ করেছিলেন, সেই ছবি কেমন হত, তারই কি কিছু আভাস পাই আমরা চারুলতা-য়? যে রামমোহন ভারতে আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তার ব্যর্থ জনক, শুধু ধর্মপ্রচারক বা সমাজ-সংস্কারক নন, সেই রামমোহনের প্রতিই কি সত্যজিতের অধিকতর আগ্রহ? চারুলতা দেখলে তাঁর রামমোহন-চিত্র দেখার সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ তীব্রতর হয়।
ইতিহাস বিভাগ, বার্কবেক কলেজ, লন্ডন