মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে আর জি কর-কাণ্ডের দায় এড়ানো কঠিন
RG Kar Medical College and Hospital Incident

পদত্যাগ এবং সাপলুডো

গত বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি পদত্যাগ করতে রাজি। তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার চাই না। তিনি আর জি কর-কাণ্ডের নির্যাতিতার বিচার চান।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:০৪
Share:

সমাধানসূত্র: জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকের পরে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন মুখ্যমন্ত্রী। ১৬ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছবি: পিটিআই।

মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে দেশের দু’জন মুখ্যমন্ত্রীর মুখে পদত্যাগের কথা শোনা গেল। গত বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি পদত্যাগ করতে রাজি। তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার চাই না। তিনি আর জি কর-কাণ্ডের নির্যাতিতার বিচার চান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যের পরে এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। তিনি পদত্যাগ করেননি। সেই প্রসঙ্গেই আর যাননি।

Advertisement

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ মন্তব্যের তিন দিন পরে জামিনে তিহাড় জেল থেকে ছাড়া পাওয়া দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল দলীয় কর্মীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। রবিবারের সেই দুপুরে আম আদমি পার্টির সুপ্রিমো আচমকাই ঘোষণা করেন, দু’দিন পরে তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করতে চলেছেন। দু’দিন পরে ইস্তফা দিয়েও ফেলেছেন কেজরীওয়াল।

রাজনীতির সাপলুডো খেলায় সরকারি কুর্সি থেকে পদত্যাগের অর্থ ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো নয়, তা আসলে নিজেকে বাজি ধরার কৌশল। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়ে বহু রাজনীতিকই নিজেকে বাজি ধরেছেন। ইন্দিরা গান্ধী থেকে ভি পি সিংহ, নরেন্দ্র মোদী থেকে অরবিন্দ কেজরীওয়াল। অতীতে মমতাও নিজেকে বাজি ধরেছেন। কিন্তু এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সাহস দেখাতে পারলেন না।

Advertisement

আর জি কর-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক আন্দোলনের জেরে তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব এখন অভূতপূর্ব ভাবে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। তৃণমূলের দুর্গ কলকাতা ও আশেপাশের শহরাঞ্চলেই ক্ষোভ উপচে পড়ছে। যা কোনও দিন ভাবা যায়নি, এখন সেটাই হচ্ছে। কালীঘাটের সামনে আমজনতা স্লোগান তুলছেন। এই ক্ষোভ শুধু আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিক্রিয়া নয়। ভোটের সময় দাদাগিরি থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ কেলেঙ্কারি, স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের রোজকার তোলাবাজি থেকে মন্ত্রীদের ঘর থেকে কোটি কোটি টাকা নগদ-গয়না উদ্ধার— যাবতীয় জমে-থাকা ক্ষোভ এখন প্রকাশ্যে আসছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পদত্যাগের কথা বললেন, তখন জাতীয় রাজনীতিতে হইচই পড়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, এই সঙ্কটকালে ঘুরে দাঁড়াতে মমতা কি পদত্যাগকেই তুরুপের তাস হিসাবে কাজে লাগাবেন? না। কেজরীওয়াল যা পেরেছেন, মমতা তা পারেননি। তার প্রধান কারণ অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের এখনও প্রায় দু’বছর বাকি। অন্য দিকে, দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের আর ছ’মাসও বাকি নেই। ফলে কেজরীওয়াল এখন থেকেই জনতার আদালতে চলে যেতে চাইছেন। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে উঠে আসা কেজরীওয়াল ও তাঁর আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধেই এখন দুর্নীতির নালিশ। সেই দুর্নীতির অভিযোগের আইনি আদালতে বিচারের আগেই কেজরীওয়াল জনতার আদালতে বিচার চাইছেন। মানুষের সামনে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “আপনারা কি কেজরীওয়ালকে ইমানদার মনে করেন? জনতা এই ফয়সালা না করা পর্যন্ত আমি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসব না।”

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে এখন এই জনতার আদালতে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এত দিন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার রাজনীতি করেই সুফল কুড়িয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। তিনি এখন নিজেই ‘প্রতিষ্ঠান’। মাসতিনেক আগেও দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ক্ষোভের আঁচ থেকে নিজেকে আড়াল করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে তাঁর সরকারের মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ ও দলের কর্মীদের দুর্নীতি নিয়ে ধমক দিয়েছিলেন। নিজেকে এ সবের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছিলেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অনুব্রত মণ্ডলদের ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সরাসরি তাঁর দিকেই নাগরিক আন্দোলনের তির। তিনিই দল ও সরকারের প্রধান মুখ। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনও তাই তাঁর বিরুদ্ধেই। এই আন্দোলন স্তিমিত না হওয়া পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে জনতার আদালতে যাওয়া কঠিন। আর সেই কারণেই তিনি মুখে পদত্যাগের কথা বললেও সে পথে হাঁটেননি।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই লোকসভা নির্বাচনে মানুষের সামনে নিজেকে বাজি ধরেছিলেন। গত ৫ এপ্রিল কোচবিহারের মাথাভাঙার জনসভায় বলেছিলেন, “আমার মুখটা মনে করবেন, আর তৃণমূল প্রার্থীকে একটা করে ভোট দেবেন।” মমতা যে দিন কোচবিহার থেকে এ কথা বলছেন, ঠিক সে দিনই নরেন্দ্র মোদী প্রচারে বলেছিলেন, “আজ আমি নিজের জন্য ভোট চাইছি। প্রতিটি গলি-মহল্লার মানুষের কাছে আমার আর্জি, আপনাদের ভোট সরাসরি আমাকে দিন।” মোদীও বাজি ধরেছিলেন নিজেকে। তিন বছর আগে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও জনতার আদালতে নিজেকে বাজি ধরে বাজিমাত করেছিলেন মমতা। সে বারও তাঁর প্রচারের মন্ত্র ছিল, “কে প্রার্থী সেটা আসল নয়, আমাকে দেখে ভোট দিন।”

১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তুঙ্গে উঠেছিল। কংগ্রেসের পুরনো নেতারা ইন্দিরার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সে সময় ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এ বারের নির্বাচনের প্রধান প্রশ্ন কী? ইন্দিরা বলেছিলেন, তিনিই এ বার ভোটের প্রশ্ন। ১৯৮৭ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। দু’বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর গদিতে তাঁকে দেখা গিয়েছিল। ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তি নিয়ে বামেদের বিরোধিতার মুখে মৃদুভাষী মনমোহন সিংহ পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন। এখন বিজেপিকে চমকে দিয়ে অরবিন্দ কেজরীওয়াল মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জনতার মাঝে চলে যাচ্ছেন। যে বিজেপি এত দিন তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা চাইছিল, সেই বিজেপি এখন উল্টো চাপে পড়ে গিয়েছে।

বলা বাহুল্য, এর কোনও পরিস্থিতির সঙ্গেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির তুলনা হয় না। নাগরিক আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করলে আগেভাগেই হার মেনে নেওয়ার বার্তা যেত। কেজরীওয়ালের সঙ্গে তাঁর গোটা দল রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিকরা একমত কি না, তা নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেজরীওয়াল পদত্যাগ করে ব্যক্তিগত ভাবে যে নৈতিক অবস্থান নিয়ে নিলেন, নাগরিক ক্ষোভের থেকে নিজেকে দায়মুক্ত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি সেই একই রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারতেন না? না কি, তিনি আসলে চাপের সামনে মাথা নত করে সব দায় নিজের মাথাতেই নিয়ে ফেলছেন?

রাজনৈতিক অঙ্ক বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে এমনিতেও আর জি কর-কাণ্ড থেকে দায়মুক্ত হওয়া মুশকিল। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব ছাড়াও আর জি কর-কাণ্ডে সরকারের যে দুই দফতরের দিকে অভিযোগের আঙুল, সেই স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র দফতর উভয়ই মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। স্বাস্থ্য ভবন দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হয়ে উঠলে তার দায় মন্ত্রী এড়াতে পারেন না। একই ভাবে, পুলিশকর্তারা যদি আর জি করের ঘটনার সঠিক তদন্ত না করে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করে থাকেন, তা হলে তার দায়ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে এড়ানো মুশকিল।

আন্দোলনের মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই দায়ই মেনে নিয়ে স্বাস্থ্য ও পুলিশ কর্তাদের সরাতে রাজি হয়ে গিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা-অধিকর্তাকে সরানোর পাশাপাশি কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। ২০১৩-র তৎকালীন নগরপাল রঞ্জিত পচনন্দার ঘটনা বাদ দিলে, গত দুই দশকে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার কোনও মুখ্যমন্ত্রী নাগরিক দাবি মেনে নিয়ে কলকাতার নগরপালকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ২০০৭-এ রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর পরে এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই রাস্তায় নামায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নগরপালের পদ থেকে প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার পরেও অবশ্য বাম দুর্গের পতন ঠেকানো যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে পদত্যাগ না-করে পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্তাদের সরিয়ে কি তাঁর সরকারের পতন ঠেকাতে পারবেন? না কি রাজনীতির সাপলুডো খেলা এখনও অনেক বাকি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement