Asha Workers

একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন

আশাকর্মীদের দাবি কী? প্রায়ই তাঁরা অনিয়মিত বেতন পান, তাই গত তিন মাসের বকেয়া বেতন চাইছেন ও নিয়মিত বেতন দাবি করছেন। সেই সঙ্গে চাইছেন কাজের সময় ও চাপ কমানো হোক।

Advertisement

রঞ্জিত শূর

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫ ০৭:২৮
Share:

কেরলে কয়েক হাজার আশাকর্মীর লাগাতার ধর্মঘট এক মাস পূর্ণ হল। গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে আশাকর্মীরা রাজ্য সচিবালয়ের সামনে চব্বিশ ঘণ্টা অবস্থান করে আছেন। এই ধর্মঘট কেরলে ক্রমশ একটা বড়সড় রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে উঠছে। বাম সরকার অনমনীয় মনোভাব নিয়েছে। ধর্মঘটী ইউনিয়নের সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসতেই রাজি নয়। কেরল সরকার ও শ্রমিক ইউনিয়ন সিটু ক্রমাগত চাপ বাড়াচ্ছে, যাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করেন আশাকর্মীরা। নেতারা বিবৃতি দিয়েছেন যে এই আন্দোলন অপ্রয়োজনীয়, নৈরাজ্যবাদী। আন্দোলনের পিছনে এসইউসি দলের সমর্থন আছে বলে সিপিএম নেতারা বিদ্রুপ করে বলেছেন, এটা কৌটো ভরার আন্দোলন। আশাকর্মীদের নিয়ে সিটু-রও একটা ইউনিয়ন আছে। সিটু-প্রভাবিত আশাকর্মীরা ধর্মঘটে নেই। সরকারের শরিক দল সিপিআই, এবং বিরোধী বিজেপি এবং কংগ্রেস কিন্তু আশাকর্মীদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছে।

Advertisement

আশাকর্মীদের দাবি কী? প্রায়ই তাঁরা অনিয়মিত বেতন পান, তাই গত তিন মাসের বকেয়া বেতন চাইছেন ও নিয়মিত বেতন দাবি করছেন। সেই সঙ্গে চাইছেন কাজের সময় ও চাপ কমানো হোক। সাধারণত আশাকর্মীদের চার ঘণ্টা কাজ করার কথা। সরকারি খাতায় তাঁরা ‘স্বেচ্ছাসেবক’, কিন্তু অধিকাংশ আশাকর্মীকে আট ঘণ্টা থেকে বারো ঘণ্টাও কাজ করতে হয়। অবসরের বয়সে বৃদ্ধি, অবসরের সময় এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা ও পেনশন, এবং মাসিক বেতন বাড়িয়ে সাত হাজার টাকা থেকে একুশ হাজার টাকা, এগুলিও রয়েছে তাঁদের দাবির তালিকায়।

অন্য দিকে সিপিএম নেতাদের দাবি, অন্যান্য অনেক রাজ্যের থেকে কেরলের আশাকর্মীরা বেশি বেতন পাচ্ছেন। রাজ্যের বিরুদ্ধে নয়, তাঁদের আন্দোলন করা উচিত কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের পাওনা টাকা আটকে রেখেছে বলেই রাজ্য সরকার তিন মাস আশাকর্মীদের বেতন দিতে পারেনি। সরকার ও সিটু হুমকি দিয়েছে, অবিলম্বে আশাকর্মীরা কাজে না ফিরলে সরকার তাঁদের জায়গায় বিকল্প ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ, নতুন লোক নিয়োগ করে ধর্মঘটীদের ছাঁটাই করা হবে। পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মী দিয়ে ধর্মঘটীদের চিহ্নিতকরণের কাজও শুরু হয়েছে। দেড় হাজার নতুন কর্মীর ট্রেনিং শুরু করেছে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য শাখা। ধর্মঘটী আশাকর্মীরা এ সব হুমকিকে অগ্রাহ্য করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

Advertisement

সিপিআই নেতা ডি রাজা অবশ্য বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, তিনি এবং তাঁর দল মনে করেন আশাকর্মীদের একুশ হাজার টাকা বেতনের দাবি মোটেই বেশি নয়। তিনি আরও বলেন, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের উচিত ধর্মঘটীদের সঙ্গে বৈঠকে বসা। কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা আশাকর্মীদের পক্ষে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভে নেমেছেন। তাঁরা কেরল সরকারের আচরণের সঙ্গে তুলনা টানছেন কর্নাটক সরকারের। মাত্র দু’মাস আগে কর্নাটকেও আশাকর্মীরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত তাঁদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেন এবং দাবি আংশিক মেনে নিয়ে দু’হাজার টাকা করে বেতন বাড়িয়ে দেন। এখন সে রাজ্যে আশাকর্মীরা মাসে দশ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। বিজেপি নেতারাও সচিবালয়ের সামনে গিয়ে ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন।

আশাকর্মীদের ধর্মঘট সাধারণ মানুষের প্রচুর সমর্থন পাচ্ছে। কোভিডের সময় আশাকর্মীদের কাজ মানুষের প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছে। সংক্রমণ না ছড়াতে দেওয়ায় আশাকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০১৮ সালে কেরলের ভয়াবহ বন্যার সময়ও আশাকর্মীদের পরিষেবা মানুষ মনে রেখেছেন। কেরলের সমাজে আশাকর্মীদের একটা সহজ গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাই আশাকর্মীদের প্রতি সরকার ও সিটু নেতাদের নানা অসহিষ্ণু, অসংযত মন্তব্যকে সাধারণ মানুষ ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। ছোট-বড় বহু সংগঠন ধর্মঘটী শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে, বিবৃতি দিচ্ছে, রাস্তায় নামছে। প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ গণস্বাক্ষর করে সরকারের কাছে দাবি করেছেন যে, আন্দোলনরত আশাকর্মী ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে, তাঁদের দাবিসনদের সুমীমাংসা করতে হবে। শাসকদের জিহ্বা সংযত করে আশাকর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে বলেছেন তাঁরা। এখনও অবধি সরকার পুলিশ ও দমনপীড়নের পাশাপাশি জানুয়ারি পর্যন্ত বকেয়া বেতন মিটিয়ে দিয়েছে কেবল।

সিপিএম দলের বিরুদ্ধে স্ববিরোধিতার অভিযোগও উঠেছে। গত ডিসেম্বরে দিল্লিতে আশাকর্মীদের দাবি ছিল ন্যূনতম ছাব্বিশ হাজার টাকা বেতন, যা সিটু ও সিপিএম সমর্থন করেছিল। অথচ আজ সিপিএম-শাসিত কেরলে সরকারের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে নীরবতা। এ কথা ঠিক যে, আশাকর্মীদের আর্থিক দায় অনেকটাই কেন্দ্রীয় সরকারের বহন করা উচিত। কিন্তু রাজ্যগুলিরও কি দায় নেই? আশাকর্মীরাই তো রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ। গ্রামীণ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আশাকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে, তাঁদের দক্ষতা, দায়বদ্ধতা ও শ্রমের সম্মান দিয়ে, তাঁদের পূর্ণ সরকারি কর্মীর মর্যাদা দেওয়া দরকার। পূর্ণ সময় কাজ করিয়ে আশাকর্মীদের ‘স্বেচ্ছাসেবী’ বলা অমার্জনীয় অন্যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement