Sourced by the ABP
দেওয়ানি আইন ‘প্রোটেকশন অব উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ বা পিডব্লিউডিভিএ ভারতে কার্যকর হয় ২০০৬-এ। গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে এই আইন, ৪৯৮এ-র কঠোর শাস্তির অভিমুখ থেকে সরে এসে, আবেদনকারীর সুরক্ষা প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেয়। এই আইনের প্রাথমিক লক্ষ্য, গার্হস্থহিংসায় নির্যাতিতাদের সুরক্ষা ও সুবিচার দেওয়া। এবং তাঁদের আশ্রয়, আইনি সাহায্য ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা।
এই আইনি পদ্ধতির মুখ্য উপদেষ্টা হলেন ‘প্রোটেকশন অফিসার’ বা সুরক্ষা আধিকারিক। বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশ, গার্হস্থ হিংসায় নির্যাতিতাদের, প্রধানত যাঁরা দারিদ্রসীমার আশেপাশে আছেন, তাঁদের পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া দুরূহ ব্যাপার। এ ছাড়াও রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, সহায়তা সূত্রের তথ্যের অভাব, পারিবারিক অসমর্থন ইত্যাদি। পিডব্লিউডিভিএ আইন এই অসম লড়াইয়ে মধ্যস্থতা করায় সুরক্ষা আধিকারিকদের উদ্যোগী হতে বলেছে। সুরক্ষা আধিকারিক নির্যাতিতার তরফে তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী আদালতে আবেদন করায় সাহায্য করেন। পিডব্লিউডিভিএ আইন অনুযায়ী, আদালত ৬০ দিনের মধ্যে এই মামলা নিষ্পত্তির পদক্ষেপ করেছে। এমনকি মহামান্য আদালতের নির্দেশমতো উপযুক্ত ব্যবস্থা, যেমন আবেদনকারীর বাসস্থান, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি যদি না করা হয়, তবে আদালত ফৌজদারি আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করতে পারে।
কিন্তু ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ রিপোর্ট-এ পিডব্লিউডিভিএ-র তথ্য দেখলে আমাদের মনে সংশয় ঘটে। সারা ভারতে এই আইন অনুযায়ী ২০১৯-এ সাকুল্যে ৫৫৩টি কেস ডায়েরি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এর সংখ্যা ২০২১-এ কমে দাঁড়িয়েছে ৫০৭-এ। তবে কি মহিলারা এই আইনের উপর থেকে আস্থা হারিয়েছেন? বা এই আইন ফৌজদারি আইনের মতো জোরালো বা কার্যকর নয়? বিষয়টি একেবারেই তা নয়। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ রিপোর্টে যে পিডব্লিউডিভিএ-র মামলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটিই পরিসংখ্যানে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, মামলার ধরন দেওয়ানি হলে ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ রিপোর্টে তার গুরুত্ব হারিয়েছে। অতএব, পিডব্লিউডিভিএ আইনের আওতায় সারা দেশে কত কেস রেজিস্টার্ড হচ্ছে, আদালত ছাড়া তার হিসাব রাখার কোনও সুনির্দিষ্ট উপায় নেই। কোনও রিপোর্টে এর আসল সংখ্যা প্রকাশ পায় না।
পিডব্লিউডিভিএ আইন প্রতিষ্ঠার পিছনে নারী-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, দেশ জুড়ে বিভিন্ন নারী সংগঠন, ভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এবং সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক, পর্যালোচনা ও নিরীক্ষার পর এই আইনের কাঠামো তৈরির পরামর্শ দেয়। সঙ্গত কারণেই, এই আইন বলবৎ হওয়ায় আমাদের প্রত্যাশাও অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু আইনটি চালু হওয়ার ১৭ বছর পরেও আমরা আবার হতাশ হলাম। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের ১৩টি জেলা জুড়ে একটি সমীক্ষা করেছে জাতীয় মহিলা কমিশনের সহায়তায়। এই গবেষণা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, প্রায়োগিক দিক থেকে এই আইন কতটা দুর্বল। আমরা এই সমীক্ষায় এমন ২১৯৩ জন মহিলার সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা গার্হস্থ হিংসার শিকার হয়েছেন ও নিজেদের জেলার সুরক্ষা আধিকারিকদের দ্বারস্থ হয়েছেন দৈনন্দিন অত্যাচার থেকে অব্যাহতি পেতে। এঁদের মধ্যে ৯০% মহিলা বিবাহিত এবং বেশির ভাগই ঘর-সংসার অটুট রাখতে আগ্রহী। এঁদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন, তাঁরা প্রায় প্রতি দিন বা সপ্তাহে দু’বার বা সাপ্তাহিক ভাবে নিয়মিত গার্হস্থ হিংসা সহ্য করছেন। উল্লেখ্য, এঁদের মধ্যে মাত্র ৬% তৎক্ষণাৎ সাহায্য নিতে উদ্যত হয়েছেন। ৭০%-এরও বেশি মহিলা এই হিংসার সঙ্গে আপস করছেন বছরের পর বছর, কারণ তাঁদের ভয় যে বিবাহবিচ্ছেদ হলে তাঁরা প্রবল আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হবেন বা মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও চিরদিনের জন্য হারাবেন। এঁরা আর্থিক, মানসিক, শারীরিক ও যৌন হিংসার নিয়মিত শিকার হচ্ছিলেন, অথচ সুরক্ষা আধিকারিকের কাছে আসার আগে ঠিক কাদের কাছে গেলে সঠিক বিচার পাবেন— এ বিষয়ে অন্ধকারে ছিলেন। আইনি পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত তখনই নিয়েছেন, যখন তাঁরা বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বা প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন।
আমাদের প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে, পুলিশ আর আইনজীবীরা পিডব্লিউডিভিএ-কে ৪৯৮এ-র সমপরিমাণ গুরুত্ব দেন না। এমনকি অনেক পুলিশকর্মী এই আইন সম্পর্কে সচেতনই নন। ফলে যে আইনে নির্যাতিতাদের নির্দিষ্ট ৬০ দিনে সমস্যার সমাধান পাওয়ার কথা, সেখানে ওই সহায়তা পেতে অনেক ক্ষেত্রে ১০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক কালে দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সারা দেশে ৪.৭ লক্ষ মামলা এই আইনের আওতায় এখনও অমীমাংসিত। আমাদের সমীক্ষা এই আশঙ্কায় সিলমোহর দিয়েছে।
সমীক্ষার তথ্য এও প্রমাণ করে যে, আমাদের সমাজে নারীর হিংসামুক্ত জীবনের ইচ্ছাকে সম্মান জানানো হয় না। আর কত দিন আমরা এই অমানবিক পরিস্থিতির জন্য মহিলাদেরই দায়ী করব? কবে আমাদের এই চেতনার উন্মেষ হবে যে, নারীর অধিকার লঙ্ঘন করার অর্থ তাঁদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, যা সংবিধানবহির্ভূত। কবে আমরা স্বীকার করব যে, গার্হস্থ হিংসা একটি সামাজিক সমস্যা, যার দায়িত্ব আমাদের সকলকে সমবেত ভাবে ভাগ করে নিতে হবে?