রাষ্ট্র: রাজধানী দিল্লির রাজপথ-এ প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের প্রস্তুতি। ২৩ জানুয়ারি, ২০২২। পিটিআই।
ছেলেবেলায় জানুয়ারি মাস কিছুটা গড়ালেই বাড়িতে শুনতাম, “কাল তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, প্যারেড আছে।” প্যারেড মানে, রেড রোড আটকে ২৬ জানুয়ারির মহড়া। পরে, কলেজে পড়বার সময়, খেয়াল রাখতে হত, কোন কোন দিন আটটা পঁয়তাল্লিশ নিলে ক্লাসে ঢুকতে দেরি হয়ে যাবে, সাড়ে আটটা ধরা চাই। সকালে অনেকগুলো সরকারি বাস বাঁধা সময়ে ছাড়ত।
আরও অনেকটা পরে শহীদ কাদরীর কবিতা আর সুমনের গান যখন বলল, রাষ্ট্র মানেই ‘লেফ্ট রাইট লেফ্ট’, তখন খেয়াল হয়েছিল, শিশুকাল থেকেই তো জানি— ২৬ জানুয়ারি মানেই প্যারেড! টেলিভিশনে সে জিনিস দেখবার সুযোগ যখন আসে, তত দিনে শৈশব অতিক্রান্ত, দু’এক বার বসে দেখার চেষ্টা করেছিলাম, সুবিধে হয়নি। অনেকেই বড় হয়েও মন দিয়ে দেখেন। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটি শিশু বাস করে।
এত প্যারেড কেন? উত্তর সহজ। সংবিধানের প্রস্তাবনায় আছে ‘সভরিন সোশ্যালিস্ট সেকিউলার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক’-এর কথা; এই পরিচিতির প্রথম বিশেষণেই যে সার্বভৌমত্বের বন্দনা, রাষ্ট্র নিজের জন্মদিনে তার উদ্যাপন করবে না? কিন্তু তার জন্য এত রণসজ্জা কিসের, সার্বভৌমত্ব কি কেবল সামরিক নিরাপত্তার ব্যাপার? এ-প্রশ্ন শুনলে কর্তারা ধমক দেবেন, ‘চুপ করো অবিশ্বাসী, রাষ্ট্রশক্তিই সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ’। হয়তো প্রবোধও দেবেন, ‘শুধু প্যারেড তো নয়, কত রকমের জুলুস আছে না?’ এতেও প্রশ্ন না থামলে? নির্ঘাত আর্বান নকশাল।
সার্বভৌমত্ব না-হয় বোঝা গেল, পরিচিতির বাকিটা? প্রথমেই দেখা যাক রিপাবলিক শব্দটিকে। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার সূচনায় এর বাংলা করা হয়েছে ‘সাধারণতন্ত্র’, হিন্দিতে ‘গণরাজ্য’। শব্দের চরিত্র বিচার করলে, রাষ্ট্রব্যবস্থা বোঝাতে তন্ত্রের তুলনায় রাজ্য বেশি উপযোগী। তবে, শব্দের প্রয়োগ প্রসরণশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বোঝাতে অকাতরে গণতন্ত্র লিখি, যেমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রায়শই বলি অর্থনীতি। সুতরাং তন্ত্রে দোষ নেই।
তবে বাংলায় রিপাবলিক অর্থে প্রজাতন্ত্র খুব চলে। শুধু সংবাদপত্রে বা জনারণ্যে নয়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এও তা স্বীকৃত। গণতন্ত্রের রূপ বোঝাতে প্রজা কেন? বিশেষত ‘রিপাবলিক’ নামক সেই রূপটিতে যখন জনসাধারণের স্বাধিকারকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়? সঙ্গত প্রশ্ন। তবে নিজের পক্ষ নিয়ে প্রজাতন্ত্রেরও অন্তত দু’টি কথা বলবার আছে। এক, প্রজা-র আদি অর্থে রাজার ছায়া নেই— হরিচরণ বলছেন, প্রজা মানে সন্ততি, জন, লোক, ইত্যাদি। কালক্রমে রাজা তার ঘাড়ে চেপেছে, সেটা প্রজার দোষ নয়। দুই, পশ্চিমি ইতিহাসে রিপাবলিকের নামডাক হয়েছিল মনার্কি-র বিপরীতে, অতএব ঔপনিবেশিক সংসর্গে গড়ে ওঠা বাংলায় রাজতন্ত্রের বিপরীতে প্রজাতন্ত্র দাঁড়িয়ে গেছে। এই দ্বিতীয় যুক্তিটি বিশেষ জোরদার। তার কারণ, প্রজাতন্ত্র বললে কেবল এটুকুই বলা হচ্ছে না যে এ হল প্রজার তন্ত্র বা শাসন; এ-কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে আগে যে প্রজা ছিল, সে-ই এখন চালকের আসনে। অর্থাৎ, শব্দটি নিজেই এক পালাবদলের অভিজ্ঞান। সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতেই তার স্বীকৃতি আছে, সেখানে বলা হয়েছে, প্রজার মাথার উপরে বসে কেউ তার হাতে এই তন্ত্র ধরিয়ে দিচ্ছে না— ‘আমরা ভারতের জনগণ... এই সংবিধান গ্রহণ করছি।’ পড়লে রোমাঞ্চ হয়।
কিন্তু রোমাঞ্চ জুড়িয়ে গেলেই খটকা লাগে, এই জনগণ ব্যাপারটা ঠিক কী বটে? এত কাল ধরে পোড় খেয়ে খেয়ে আমরা— ভারতের জনগণ— হাড়ে হাড়ে জানি না কি, কারা আমাদের প্রজাতন্ত্রের ধারক, বাহক এবং চালক? জানি না কি, যে, আমরা তাঁদের প্রজা? বঙ্গীয় শব্দকোষের প্রজা নয়, রাজার— কিংবা রানির— রাজত্বে টিকে থাকা প্রজা? সবাই নয়, রাজারানিদের বলয়ে আছেন কিছু সৌভাগ্যবান, সর্বকালে সর্বদেশেই থাকেন তাঁরা, আর আছেন কর্পোরেট দুনিয়ার অতিকায় মালিকরা, কুবের যাঁদের দেখে লজ্জিত হতেন, এ-কালে রাজদণ্ডও যাঁদের সমীহ করে চলে, কিংবা যাঁদের হুকুমে চালিত হয়। এই ক্ষমতাবানেরা— রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ন্যূনাংশিক’রা— ১ শতাংশ, ক্ষমতাহীন প্রজারা— ‘বৃহদাংশিক’রা— ৯৯ শতাংশ। এমন প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক, ন্যূনাংশিকরা তা মনেপ্রাণে চাইবেন।
সমস্যাটা নতুন নয়, কেবল আমাদের সমস্যাও নয়। ৯৯ শতাংশের নামে গণতন্ত্রের খোলস বানিয়ে তার ভিতরে ১ শতাংশের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যাওয়ার চতুর কৌশলগুলি দুনিয়া জুড়েই ক্রমাগত চতুরতর হয়েছে। চোখের সামনে অতিমারির দু’বছরে মহালুণ্ঠন এক নতুন মাত্রা ধারণ করল— সব সম্পদ ১ শতাংশের যক্ষপুরীতে জমা হচ্ছে আর ৯৯ শতাংশ দুর্দশার অতলস্পর্শী খাদে আরও তলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য অতিমারিকে দায়ী করলে এই নির্মম সত্যকে অস্বীকার করা হবে যে, অতিমারির সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাবানেরা আধিপত্য, সম্পদ এবং শোষণের মাত্রা আরও অনেক বাড়িয়ে নিয়েছে। কোভিড তাদের হাতিয়ারমাত্র। সংবিধান থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বিশেষণটি উড়িয়ে দেওয়া হোক অথবা সেটি সংবিধান আলো করে বিরাজ করুক, ন্যূনাংশিকদের অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে ছুটবে। তাদের রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের প্রদর্শনী করবে, বৃহদাংশিক প্রজারা দেখে বিমুগ্ধ এবং বিমূঢ় হবেন।
অথবা সন্ত্রস্ত। প্রজাতন্ত্রের জাঁক দেখে যেন ভুলে না যাই যে, এ দেশের বহু মানুষ কেবল তাঁদের ধর্মপরিচয়ের কারণে প্রতিনিয়ত মাথার উপরে একটি খাঁড়া নিয়ে দিনযাপন করছেন। সংখ্যাগুরুবাদের খাঁড়া। দেশভাগের সময় থেকেই খাঁড়াটি বিরাজমান ছিল, কিন্তু দূরে ছিল, তাকে প্রতিহত করার নানা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচও অনেকখানি কার্যকর ছিল। আজ দূরত্ব ঘুচেছে, রক্ষাকবচ সরে গেছে, শাসক শিবিরের রকমারি মঞ্চ থেকে ‘ওদের শেষ করা’র হুঙ্কার ধ্বনিত হচ্ছে, আর সেই হুঙ্কারের থেকেও কর্ণভেদী ও হিংস্র হয়ে উঠছে ক্ষমতার অধীশ্বরদের প্রগাঢ় নীরবতা, যে নীরবতায় হিংসার কারবারিরা বিপুল প্রশ্রয় পাচ্ছে, পেয়ে আসছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বিশেষণটি এখনও বহাল আছে, যদিও সুবিধা বুঝলেই হয়তো সংখ্যাগুরুর দাপট তাকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করবে। কিন্তু শব্দে কী বা আসে যায়— ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চিহ্নিত করে, এনআরসি-সিএএ আদি নানা কৌশলে তাঁদের অধিকার হরণের আয়োজন করে, ‘উইপোকা’ ও অন্যান্য প্রজাতির তকমা লাগিয়ে, সরাসরি তাঁদের উপর চড়াও হয়ে যে ভারততীর্থ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই তীর্থের সাধুসন্তরা তাঁদের ‘ধর্ম সংসদ’ থেকে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে যে প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন, তাতে সাধ্য থাকলে ‘সেকিউলার’ শব্দটি নিজেই সংবিধানকে বলত, ‘এ-বার আমাকে ছেড়ে দাও, আর সহ্য হয় না’।
বিশেষণের ফর্দটিতে বাকি থাকল ‘গণতান্ত্রিক’। তার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাঁচ বছর অন্তর— ভোট দিতে পারলে— ভোট দিয়ে আসা আর তার আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্ষমতাধারী অথবা ক্ষমতাসন্ধানীদের অর্থহীন আস্ফালন এবং কুৎসিত গালিগালাজ শোনা ছাড়া আমাদের গণতন্ত্র বলতে আর কী বোঝায়, প্রজার জানা নেই।
এই তবে পরিণতি? এই প্রজাতন্ত্রকেই নতমস্তকে মেনে নিতে হবে? না। অন্য রকমও সম্ভব। সে জন্য প্রজাদের একজোট হয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে, দাবি জানাতে হবে: আমাদের তন্ত্র আমরাই তৈরি করব। দেড়শো বছর আগে প্যারিস কমিউনের নির্বাচিত পরিচালকদের মুখের উপর শহরের প্রজারা যেমন বলেছিল: আমরা তোমাদের যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছি, সেটুকুই ঠিকঠাক পালন করো, না হলে চেয়ার থেকে টেনে নামিয়ে দেব। সেই যথার্থ প্রজা-তন্ত্র স্থায়ী হয়নি, কিন্তু এই নশ্বর জীবনে স্থায়িত্বে কী আসে যায়, সম্ভাবনাটাই আসল কথা। রাজনীতি যে সম্ভাবনার শিল্প। প্রজাকে তার নিজের রাজনীতি তৈরি করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের রাজনীতি।
প্যারিস ১৮৭১ অনেক দূরের। দু’বছর আগে, এই জানুয়ারিতেই রাজধানীর শাহিন বাগে এবং দেশের অন্য নানা বিন্দুতে প্রতিস্পর্ধী প্রজাতন্ত্রের সংগঠিত সমাবেশ দেখেছি আমরা, শুনেছি অধিকারের দাবিতে দৃপ্ত উচ্চারণ। প্রতিবাদীরা সে-দিন নানা পরিসরে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করে শাসকের অন্যায় নির্দেশ অমান্য করার ডাক দিয়েছিলেন। এবং দেশ জুড়ে কোটি কোটি কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়েছিল ফৈজ় অহমদ ফৈজ়-এর সেই অ-লৌকিক প্রত্যয়: ঔর রাজ করেগী খুল্ক-এ-খুদা/জো মৈঁ ভি হুঁ ঔর তুম ভী হো। এই আহ্বান সেই প্রজাতন্ত্রের, যেখানে রাজ করবে আমি এবং তুমি এবং ৯৯ শতাংশ।
১ শতাংশ নয়।