অনুব্রত মণ্ডলের নির্দেশেই তিনি সাদা কাগজে তাঁকে ‘বেডরেস্ট’ নেওয়ার পরামর্শ লিখে দেন— চিকিৎসক চন্দ্রনাথ অধিকারীর এই স্বীকারোক্তির প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ২০০৭ সালের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় তখন অন্য রাজনৈতিক দল। সেই সময় পরিচিত এক ব্যক্তি একটি গল্প লিখেছিলেন। যাঁকে উদ্দেশ করে সেই গল্প লেখা, তিনি ছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির শিক্ষাজগতের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, ফলত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাধিনায়ক। শ্লেষাত্মক গল্পটি ছিল তাঁর একনায়কতন্ত্রী মনোভাবকে ব্যঙ্গ করে। গল্প প্রকাশিত হল। তার পর লেখকের ডাক পড়ল তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে। কিছু গুন্ডা-পরিবৃত হয়ে তিনি বসে আছেন। বলা হল, লিখিত ভাবে গল্পটি প্রত্যাহার করতে হবে। একটি গল্প যেটি প্রকাশিত হয়ে গেছে, সেটি প্রত্যাহারের কী অর্থ, সে দিন লেখকের বুঝতে কষ্টই হয়েছিল। তবে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কথাটি লিখে দিতে। তার পর চন্দ্রনাথ অধিকারীর মতোই বাইরে বেরিয়ে প্রশাসনের সর্ব স্তরে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। আজ পনেরো বছর পরে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে তাই আশ্চর্য হওয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতা চিরকাল এক ভাষাতেই কথা বলে।
বিগত কয়েক মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ও অন্যবিধ বেনিয়ম নিয়ে রাজ্য জুড়ে তোলপাড় চলেছে, চলেছে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে, এই সমস্ত ঘটনাচক্র নিয়ে মাতামাতি করে আমরা এক বৃহত্তর বিপদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকছি না তো? যাঁরা গত দুই দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, এখন এ রাজ্যে শাসকের রং বদলায়, চরিত্র বদলায় না। এই ঘটনা কখন ঘটে? ঘটে তখন, যখন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটে যায়, অর্থাৎ এক দল মানুষ রাজনীতিকে পেশাদারি ব্যবসায় পরিণত করে ফেলে, সামনে শিখণ্ডীর মতো থাকে ‘জনগণের সেবা’। সুতরাং, শাসকের রং বদলের মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে নেই আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের দুরবস্থার অবসানের ইঙ্গিত। দরকার শাসকের চরিত্র বদল। কিন্তু যে বাঘ এক বার মানুষের রক্তের সন্ধান পেয়ে যায়, অন্য মাংসে কি আর তার পেট-মন ভরে? তাই গত দু’দশকে যাঁদের নেতা হিসেবে দেখেছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, তাঁদের উপরে কোনও ভরসা যে থাকবে না, তা বলা বাহুল্য। এর পরও ভোট হবে, নেতারা সব জামা বদলে ভোটে জিতবেনও, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
উপায় অতএব একটিই। নেতৃত্বে চাই নতুন রক্ত। খুব সুকৌশলে কিন্তু সে রাস্তাটাও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিকে কেন্দ্র করে শিক্ষাঙ্গন কলুষিত হয়ে উঠছে, এই যুক্তিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা পড়াশোনার জন্য ছেলেমেয়েকে কলেজে পাঠান, সেই অভিভাবককুলও এই সিদ্ধান্তে খুশি। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গন্ডগোল কেন তৈরি হয়? হয়, কারণ সদ্য-ভোটাধিকারপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েগুলিকে প্রথম সুযোগেই নিজেদের কব্জায় টেনে নিতে রাজনৈতিক দলগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে মাথা গলিয়ে ফেলে বৃহত্তর রাজনীতি। আর রাজনৈতিক দলগুলির সেই উদ্যোগে শাণ দেন এক দল শিক্ষক-শিক্ষিকা, যাঁদের পরিচয় দিয়েই এই লেখার সূত্রপাত। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক দল যুবক-যুবতী, যারা তখনও শিক্ষকের পাণ্ডিত্যে, মর্যাদায় অবিশ্বাসী হতে শেখেনি, তারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে ফেলে এক দল সুযোগ-সন্ধানী, রাজনৈতিক দাক্ষিণ্যে কর্মরত শিক্ষকের রাহুগ্রাসে। অবশ্যই সমস্ত শিক্ষককে আমি এই বৃত্তে ফেলছি না। কাদের কথা বলছি, রাজনীতির ঠুলি না পরে থাকলে তাঁদের সহজেই চেনা যায়। তাই অনুরোধ, ঠুলি সরিয়ে তাকান। এই রাজনৈতিক দল, তাদের দালাল কিছু শিক্ষকের যূপকাষ্ঠে কিন্তু নিজেদের বাড়ির ছেলেমেয়েগুলিকেও আপনারা ঠেলে দিচ্ছেন।
একটি ছেলে বা মেয়ে যখন কলেজে পড়তে ঢোকে, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে এক জন ভোটাধিকারপ্রাপ্ত যুবক বা যুবতী। দেশের সংবিধান তো তাঁকেই ভোটাধিকার দেয়, যিনি এক জন সচেতন নাগরিক। তা হলে শিক্ষাঙ্গনে তার অধিকারকে বুঝে নিতে, কোনটি ভাল কোনটি মন্দ তা চিনে নিতে, চিনে নিয়ে প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে ওদের সাহস দিন। তবেই না এক দিন তৈরি হবে আগামী দিনের কাঙ্ক্ষিত সেই রাজনীতিক, যিনি টাকার অঙ্কে, স্বার্থের অঙ্কে রাজনীতি করবেন না। তাই এই মুহূর্তে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলার সময় এসেছে। সেই দাবি আমাদেরই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। ভোট আসবে, ভোট যাবে। মনে রাখতে হবে, শুধু রং বদলে পশ্চিমবঙ্গের আজ আর কিছু হবে না। আর তার থেকেও বড় কিছু করতে গেলে তো একটু এগিয়ে আসতেই হবে, দাবি তুলতেই হবে শিক্ষাঙ্গনে পতাকাবিহীন ছাত্র রাজনীতির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। তবে সেই সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে পতাকার রং যেন ছেলেমেয়েগুলির চোখে-মুখে না লেগে যায়।
নেতাজি মহাবিদ্যালয়