women's hockey team

Women’s Hockey: শুধু সংবর্ধনা নয়, মহিলা হকিতে চাই সমান অধিকার

টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ না জিতেও যতটা সাফল্য পেল ভারতীয় মহিলা হকি দল। তাদের যেন পুরুষ দলের চাইতে খাটো করে দেখা না হয়।

Advertisement

পয়োষ্ণী মিত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২১ ১৫:৪৭
Share:

পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অনেক বাধা পেরিয়ে মেয়েরা খেলায় আসে।

২০০৮ সালের মার্চ মাসে একটি ইংরেজি দৈনিক রিপোর্ট করেছিল, জাতীয় মহিলা হকি দলের খেলোয়াড়রা জুলাই ২০০৭ সাল থেকে তাঁদের মাসিক বেতনের চেক পাচ্ছিলেন না। বেতন কিছু খেলোয়াড়ের বেশি আর কিছু খেলোয়াড়ের কম। মোট কথা হল, সকলের বেতন ৪ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে। তখন মেয়েদের হকি পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিল মহিলা হকি ফেডারেশনের উপর। সংগঠনের সভাপতি বিদ্যা স্টোকস এবং কোষাধ্যক্ষ এমপি গণেশ বেতন পেতে বিলম্বের অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। আবার সচিব অমৃত বসু স্বীকার করেছিলেন, দেরি হয়েছিল। কারণ, স্পনসররা টাকা দিতে দেরি করেছে এবং তাই নভেম্বর ২০০৭ থেকে অর্থপ্রদান বন্ধ ছিল। অর্থাৎ, মহিলা হকি খেলোয়াড়রা অর্ধেক বছরের বেশি সময় ধরে আর্থিক অসুবিধায় ছিলেন। সেই অবস্থায় দেশবাসী আশা করছিলেন, কাজহানে গিয়ে আমেরিকাকে হারিয়ে ভারতের মহিলা হকি দল ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সে জায়গা করে নেবে। হয়নি। দলটি অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করতেই ব্যর্থ হয়েছিল।

Advertisement

এবার চলে আসি ২০২১ সালে। ভারতীয় মেয়েদের হকি দলের টোকিয়ো অলিম্পিক্সের সেমিফাইনালে ওঠার পর আমার মনে হয়, একটা দলগত খেলায় যখন কোনও দেশের মহিলারা ভাল করে, তখন বুঝতে হয় পরিকাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। একক খেলায় পদক আনাটা অনেক সময়ে একজন স্বতন্ত্র খেলোয়াড়ের নিজস্ব অধ্যবসায় বা তার পারিপার্শ্বিক সাপোর্ট সিসেটেমের উপর নির্ভরশীল। দৃশ্যত আমার এই কথাটা মনে হয়েছিল। আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখাটা লিখতে গিয়ে ভাবলাম, একটু খোঁজ করে দেখি। যোগাযোগ করলাম হকি ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এলেনা নরমানকে। তিনি আমাকে পাঠালেন মিডিয়া দলের রোহনের কাছে। জানতে চাইলাম, হকি ইন্ডিয়া কি মহিলা এবং পুরুষ দলকে কোনও বেতন দেয়? দিলে তা কত। প্রথমে বলা হল, তাঁরা ব্যস্ত। পরে যখন বেতন বা মেয়েদের হকিতে বরাদ্দ বাজেট নিয়ে প্রশ্ন করলাম, উত্তর এল— এগুলি সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করার মতো নয়। বুঝলাম, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!

প্রতীকী ছবি।

তবে সরাসরি জবাব না মেলায় একটু অবাক হলাম। হকি ইন্ডিয়া এখন পুরুষ এবং মহিলা হকির দায়িত্বে। আগের মতো মহিলাদের হকি মহিলা ফেডারেশন চালায় না। তার পর নজরে পড়ল ২০২০ সালের প্রেস বিজ্ঞপ্তি। করোনাভাইরাস অতিমারির কারণে যখন আর্থিক সমস্যায় ভুগছে অনেকে, সিনিয়র বা জুনিয়র দলের যে খেলোয়াড়দের চাকরি নেই, তাঁদের ১০ হাজার টাকা দিলেন খেলায় ফেরার জন্যে। সেখানে বেশির ভাগ জুনিয়র খেলোয়াড় হলেও সামিল ছিল সিনিয়র দলের চার মহিলা। সেই চারজনের একজনকে আমরা টোকিয়োয় ভারতের হয়ে খেলতে দেখেছি— শর্মিলা দেবী। ছবিটা পরিষ্কার হলো। হকি ইন্ডিয়া বিসিসিআইয়ের মতো বেতন দেয় না। অন্যান্য খেলার মতো এদের চাকরি সাধারণত হয় রেল, সার্ভিসেস বা বিপিসিএল ইত্যাদি সংস্থায়। ভারতীয় মহিলাদের খেলাধুলো এত বছর ধরে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে লড়াই করছে। ভারতে বেশিরভাগ মহিলা ক্রীড়াবিদের অর্থনৈতিক লড়াই শুরু হয় বাড়িতে। আমাদের বেশিরভাগ ক্রীড়াবিদ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার এবং গ্রামাঞ্চল থেকে আসে। তাঁদের জন্য খেলাধুলো একটা জীবিকার প্রতিশ্রুতি বহন করে আনে। যাঁদের সেই ধরনের চাকরি জোটেনি, তাঁদের কোনও আয় নেই। শর্মিলা এদের একজন। তাই অতিমারির সময়ে তাঁর আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন পড়েছিল। ১০ হাজার টাকা আর কতটুকু! তাতে ওঁর কতটা উপকার হয়েছিল, সে প্রশ্নও তোলা দরকার।

Advertisement

বেশ কিছু বছর ধরে ভারত সরকারের একটা ‘টপ স্কিম’ রয়েছে। সেই স্কিম প্রধানত ব্যক্তিগত ইভেন্টের খেলার খেলোয়াড়দের সাহায্যে আসে। এতে একদিক দিয়ে যেমন একজন খেলোয়াড়কে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয়, তেমনই তাঁরা প্রতিযোগিতা বা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ বা দেশের কোথাও গেলে তার যাবতীয় খরচ পাওয়া যায়। সেই সুবিধার পাশাপাশি মাসিক ৫০ হাজার টাকা ভাতাও পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, এশিয়ান গেমসের মতো বড় প্রতিযোগিতার আগে কয়েকবার কয়েক মাসের জন্যে টপ স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হয় পুরুষ হকি টিম। টপ স্কিমের নিয়ম অনুযায়ী দলের সকলেই মাসে ৫০ হাজার টাকা করে পান মাঝেমাঝে। কিন্তু টপ স্কিমে মহিলা হকি টিমের জায়গা হয়েছিল ২০২১ সালের মার্চ মাসে। অর্থাৎ, অলিম্পিকের মাত্র চার মাস আগে। তখন জাতীয় ক্রীড়া মন্ত্রক জানায়, অলিম্পিকের আগে তারা পুরুষ এবং মহিলা দুই টিমেরর ৫৮ জন খেলোয়াড়কে টপ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করল। বলে রাখি, এই ৫৮ জনের মধ্যে ৩৩ জন পুরুষ আর ২৫ জন মহিলা। কিন্তু অলিম্পিকের মাত্র চার মাস আগের এই সাহায্যে কতটুকুই বা হওয়া সম্ভব? মনে রাখতে হবে, এক-দু’জন খেলোয়াড় কিছু বেসরকারি সংস্থার সাহায্য বেশ কিছু বছর ধরে পেয়েছেন। যেমন ভারতীয় মহিলা দলের ক্যাপ্টেন রানি রামপাল এবং গোলকিপার সবিতা দেবীর পাশে দাঁড়িয়েছে ‘গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশন’। কিন্তু একই টিমে আছেন শর্মিলা দেবী। আছেন ২৫ জনের ন্যাশনাল টিম ক্যাম্পের রাজিন্দর কৌর, বিছু দেবী খারিবাম, রাশমিতা মিন্জরা। ওঁদের মার্চ মাসে টপ স্কিমের সুবিধা পাওয়ার আগে চাকরি ছিল না। ওঁদের প্রয়োজন পড়েছিল অতিমারির সময়ে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্যের।

প্রতীকী ছবি।

মনে রাখতে হবে এই অবস্থায়, এই ধরনের আর্থিক লড়াই করতে করতে ভারতীয় হকি মহিলা দল টোকিয়ো গিয়েছিল। সেমিফাইনালে হারার জন্যে কি তাদের টপ স্কিম বন্ধ হয়ে যাবে? নাকি প্যারিসের অলিম্পিক্স এখনও তিন বছর বাকি বলে সরকার তাদের স্কিম থেকে আবার সরিয়ে দেবে? যে ব্রোঞ্জ পদক পুরুষদের হকি দল জিতেছে, তা-ও কিন্তু খুব কম সাহায্য পেয়েই। কিন্তু মহিলা দলের অবস্থা আরও কঠিন। তাদের লড়াইও অনেক বেশি। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অনেক বাধা পেরিয়ে মেয়েরা খেলায় আসে।

পদক না জিতলেও সেমিফাইনালে দুর্দান্ত খেলেছে মহিলা দল। তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে অনেক। কিছু দিন লেখালেখিও হবে ঠিকই। তবে যেটা দরকার, সেটা হল দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক এবং পরিকাঠামোগত সহায়তা। ২০১৮ সালে পুরুষ হকি দলকে টপ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করার সময় ক্রীড়ামন্ত্রক বলেছিল, মহিলারা ভাল ফল করলে তাদেরও এমন সুযোগ দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল সম্প্রতি সাউথ এশিয়া পিস অ্যাকশন নেটওয়ার্কের এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তান ক্রিকেট ক্যাপ্টেন সানা মীরের বক্তব্য। সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করার সময়ে সানাকে প্রশ্ন করেছিলাম মেয়েদের বাধাবিপত্তির বিষয়ে। মীর বলেছিল, ‘‘মহিলা খেলোয়াড়দের আগে ফল দেখাতে হয়। তার পর জোটে আর্থিক সাহায্য। পুরুষদের ক্ষেত্রে উল্টো।’’

প্রতীকী ছবি।

টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ না জিতেও যতটা সাফল্য পেল ভারতীয় মহিলা হকি দল, তাতে আশা রাখব, তাদের যেন পুরুষ দলের চাইতে খাটো করে দেখা না হয়। আশা করব, এর চেয়েও বেশি ভাল ফলাফলের আশায় বসে না থেকে হকি ইন্ডিয়া এবং ভারত সরকার মহিলা হকিকে ক্রমাগত পেশাদারিত্বের পথে নিয়ে যাবে। তার জন্যে যেমন মেয়েদের অংশগ্রহণের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন প্রয়োজনীয় এক পরিকাঠামোর, যা সরকারি-বেসরকারি যাবতীয় সম্পদ জড়ো করে মহিলা হকি খেলোয়াড়দের পেশাদার খেলোয়াড় হতে সাহায্য করবে। যখন একজন জাতীয় দোলের খেলোয়াড়কে অতিমারির সময় ‘অভাবী’ বলে ১০ হাজার টাকার ভাতার আশায় থাকতে হবে না। আমেরিকার জাতীয় মহিলা ফুটবল দল সমান বেতনের লড়াই লড়ছে আদালতে। আশা রাখব, সেই পথে হাঁটার আগেই সমান অধিকার পাবে ভারতের মহিলা হকি দলও। আশা রাখি, সেই উদ্দেশ্যে আমরা সকলেই সরব হব। অতিমারির সময় প্রশিক্ষণের জন্যে পুরুষ এবং মহিলা উভয় দলকেই বেঙ্গালুরু ‘সাই’-এ রাখা হয়েছিল। কিন্তু খাবার বা প্রশিক্ষণের সুবিধার মতো সাহায্য যথেষ্ট নয়। এই স্তরে খেলোয়াড়দের টিম স্টাফ সদস্যদের মতো বেতন দেওয়া উচিত। যেমন কোচ বা অ্যানালিস্টদের দেওয়া হচ্ছে।

পদক লক্ষ্য ঠিকই। কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর সময় মহিলা হকি খেলোয়াড়দের যা প্রাপ্য তা পাওয়া উচিত। এই কারণেই খেলাধুলোকে পেশাদার করা গুরুত্বপূর্ণ। মজার ব্যাপার হল, ২০০৭-’০৮ সালে হকি খেলোয়াড়দের ফেডারেশনের বেতন দেওয়ার নিয়ম ছিল। যখন ভারতীয় ক্রীড়া মানচিত্রে অবিশ্বাস্য উন্নয়ন হচ্ছে, বিশেষত, অলিম্পিক্সে ফলাফলে, তখন কিন্তু ক্রীড়াবিদদের অর্থ পাওয়ার অধিকার সেই পরিবর্তনমুখী ব্যবস্থায় জায়গা পাচ্ছে না। রেল, পরিষেবা, বিপিসিএল, ইন্ডিয়ান অয়েল ইত্যাদি সংস্থা খেলাধুলোর কোটায় চাকরি দেয় ঠিকই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ফেডারেশন তাদের কোনও বেতনের ব্যবস্থা করবে না। মহিলাদের টিম গেমের জন্য সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে দলটা এক সঙ্গে থাকবে। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় এবং খেলার কৌশলে উন্নতির জন্য সকলকে এক সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রীড়া মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝি, আসলে ক্রীড়াজগতে আপাতদৃষ্টিতে যতই উন্নতি হয়ে থাকুক না কেন, সেই উন্নতি একজন খেলোয়াড়ের সার্বিক উন্নতিকে মাথায় রেখে হয় না। এই শতাব্দীর শুরুর দিকেও হকি পরিচালিত হত অন্য ভাবে। সেখানে অনেক সমস্যা ছিল। কিন্তু এখনকার সমস্যা অনেক জটিল। এখনকার ক্রীড়াজগৎ পুঁজিবাদী শক্তির দ্বারা চালিত। সেখানে সব সিদ্ধান্তই বাণিজ্যিক ভাবে হয়। ঠিক যা যা পণ্য হওয়া সম্ভব, তা-ই বিক্রি করা হয়। তাই মহিলা খেলোয়াড়দের পোশাকের ডিজাইন অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। অথচ, তাঁদের বেতন গুরুত্ব পায় না। ভারতবর্ষের এখনকার রাজনৈতিক পটভূমিতে জাতীয়তাবাদ যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। সেই বোধ বিক্রিও হয় বহুমূল্যে। তাই এখন ক্রীড়াজগতের উন্নতি বলে যা আমরা বুঝি, তা হল ঝাঁ-চকচকে উচ্চ স্তরের ক্রীড়া। তা কেব্‌ল টিভি মারফত আমাদের কাছে পৌঁছে যায়। তার সঙ্গেই রয়েছে দেশের নব্য উদারবাদ। এই সব কিছুর মধ্যে হারিয়ে যায় একজন খেলোয়াড়ের অধিকার। তাকে একজন ‘শ্রমিক’ হিসাবে দেখার অক্ষমতা।

খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স উন্নত করতে বহু ডলার ব্যয় করে সাপোর্ট স্টাফ আনা হয়। অথচ খেলোয়াড়ের সার্বিক উন্নতি ও মর্যাদার অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না! কেন? মহিলা খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন আরও জটিল। শুধু মহিলা হওয়ার কারণেই তাঁদের লড়াই অনেক কঠিন। হকি ইন্ডিয়া তার মহিলা খেলোয়াড়দের কেন সেই অধিকার দেবে না, এই প্রশ্ন আরও জোরদার ভাবে তুলতে হবে। বুঝতে হবে, পেশাদার খেলোয়াড়ও আসলে একজন শ্রমিক। প্রয়োজনে খেলোয়াড়দের ইউনিয়ন তৈরি করতে হবে। যা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশে। ‘ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার্স ইউনিয়ন’ বা ফিফপ্রো তারই উদাহরণ। নইলে রানিদের অধিকার সংবর্ধনার মঞ্চেই থেমে থাকবে।

(লেখক ক্রীড়া মানবাধিকার কর্মী। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement