New Bengali Songs

আর নতুন গানের চরণধ্বনি?

এই সময়ের গাইয়েরা কিন্তু যথেষ্ট ক্ষমতাবান। ভাল গলার, চর্চিত কণ্ঠের অভাব নেই। অভিভাবকেরাও সদয়। তাঁদের তরফে গানবাজনা শেখায় একদা যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, উঠে গেছে তা।

Advertisement

অলক রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:০০
Share:

হারমোনিয়াম, তানপুরা নেই। নেই ঘষা কাচ ভেদ করা বিচারকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কূট তালে লয় দেখানোর ফরমায়েশ। সাবেক তবলার কোনও ক্রম উপস্থিতির পাশে ‘লেদার সেকশন’ তথা সিনথেটিক সেকশন ভরে রয়েছে ঝাঁ-চকচকে ড্রাম সেট, নানা বৈভবের ঢাকঢোল, ইলেকট্রনিক অর্গান-অক্টোপ্যাডে। রয়েছে সঞ্চালক তথা ‘অ্যাঙ্কর’-এর তরফে গাইয়ের নানা গুণকীর্তন— দেখানো হচ্ছে তাঁর বেড়ে ওঠার শহর, গ্রাম, গাছগাছালি, ইস্কুল, পড়শি, বান্ধবকুল। কার কাছে শিখলেন গান, সে তথ্য-তালাশ নেই যদিও। হালফিলের মেক-আপ আর সমকালীন পোশাকের অল্পবয়সি শিল্পীটি মাইক্রোফোন হাতে অতঃপর যে গান ধরলেন, সেখানে কিন্তু নতুনত্ব কিছু নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফেলে আসা দিনের ছবির গান তাঁর গলায়।

Advertisement

শতাংশের হিসাব আজকাল এই রকম: পরিবেশিত বিশটি গানে পুরনো বাংলা গান একটি-দু’টি, বাকি সব হিন্দি ছায়াছবির। নতুন গান? একটিও নেই। জলসা, কর্পোরেট হাউসের অনুষ্ঠান বা টিভির নানা চ্যানেলের গানের প্রতিযোগিতা— সর্বত্র একই ছবি। ‘কে তুমি নন্দিনী’ হেঁকে গায়ক দর্শকদের মধ্যে এসে নন্দিনী খুঁজবেন, পাওয়া গেলে তাঁকে নিয়ে মঞ্চে উঠছেন। এর মাঝে নতুন গানের খ্যাতি পাওয়ার, মানে সকলের কাছে সে গান পৌঁছে যাওয়ার কী উপায়? জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম কোনটি? এফএম অখ্যাতনামাদের গান শোনায় না, নেই পুরনো রেডিয়োর স্মৃতি-জাগানিয়া অনুরোধের আসর। ক্যাসেট, সিডির দোকান আজ সোনার পাথরবাটি। ইউটিউব-সহ কিছু সমাজমাধ্যম অবশ্য আছে, সেখানে গান বা গানের ছবি পোস্ট করে শ্রোতার অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে। শুধু অনুমোদন কেন, জনপ্রিয়তার ঢেউ সেই সব নিবেদনে স্পর্শ করলে নিয়মিত অর্থাগমও সম্ভব। কিন্তু সেখানেও মূল ছবিটি এক। নতুন গানের প্রবেশাধিকার থাকলেও শ্রোতার যাবতীয় মনোযোগ রিমিক্স বা রিমেকে। নতুন বোতলে পুরনো সঙ্গীতামৃত।

এই সময়ের গাইয়েরা কিন্তু যথেষ্ট ক্ষমতাবান। ভাল গলার, চর্চিত কণ্ঠের অভাব নেই। অভিভাবকেরাও সদয়। তাঁদের তরফে গানবাজনা শেখায় একদা যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, উঠে গেছে তা। অভাব শুধু আত্মবিশ্বাস আর পথনির্দেশের। স্মরণীয় গান নিখুঁত শুনিয়ে দেওয়াতেই যেন যাবতীয় দায়িত্বের ইতি। পুরস্কার হিসেবে গাড়ি, বাড়ি, লক্ষ টাকার ফলাও বিজ্ঞাপন সম্ভবত অভিভাবকদেরও মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। ‘গ্ৰুমার’রা গান শেখাচ্ছেন, সে বেশ কথা। তাঁদের কেউ কেউ তো অন্তত জিজ্ঞাসু নবীনকে জানাবেন অতীত-গৌরবগাথা, মহাজীবনের নানা মণিকণা!

Advertisement

ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য সতেরো বছর বয়সে সুবল দাশগুপ্তের সুরে গেয়েছিলেন কালজয়ী ‘যদি ভুলে যাও মোরে, জানাবো না অভিমান’। সদ্য শতবর্ষ পেরোনো, ঢাকার একরত্তি মেয়ে উৎপলা সেনের কণ্ঠকৃতি শুনে সুধীরলাল চক্রবর্তী ওঁকে দিয়ে রেকর্ডে গাইয়েছিলেন উৎপলার শিল্পীজীবনের সিগনেচার গান: ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’। শচীন দেব বর্মণের ‘তাজমহল’ শুনে নকলনবিশির পথে যাননি মৃণাল চক্রবর্তী, ওঁর গলায় ‘যমুনা কিনারে শাজাহানের স্বপ্নশতদল’ ছিল শচীনকর্তার সাঙ্গীতিক উত্তরাধিকারের এক বিনম্র নমুনা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে নবীন প্রাণের সুর শুনে মোহিত, ১৯৪০-এ তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী জগন্ময় রেকর্ডে শোনালেন ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী’। আজ নবীনের কণ্ঠে নতুন আলোর গান তুলে দেবেন কোন ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা? গ্ৰুমাররা শুনতে চাইছেন না অজ-গ্রামের নিবেদিতপ্রাণ তন্নিষ্ঠ শিক্ষকের শিক্ষাদান-পদ্ধতি। তাঁদের একমাত্র কাজ অতীতের জনপ্রিয় গান এই প্রজন্মের ঝানু-কণ্ঠ ছেলেমেয়েদের ঈষৎ অতিকৃত চালে শিখিয়ে দেওয়া। বাকি দায়িত্ব তুখোড় বাজিয়েদের হাতে ছেড়ে দিলেই হল।

সেখানে বাংলা গান ব্রাত্য— এমনকি বাংলা চ্যানেলের গানের প্রতিযোগিতাতেও। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শুনিয়ে আসমুদ্রহিমাচল বঙ্গজনের দরদের পাত্র হয়ে ওঠা প্রতুল মুখোপাধ্যায় নিশ্চিত ভাবেই দেখে গিয়েছেন, সে গানের গৌরব আজ রচনা প্রতিযোগিতার সান্ত্বনা পুরস্কারে গিয়ে ঠেকেছে। সাম্প্রতিক ছায়াছবিতে আধুনিক বাংলা গানকে বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার কারিগর ‘দেখো আলোয় আলো আকাশ’, তার স্রষ্টার উপস্থিতিতেই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রমরমা প্রতিযোগিতায় চলছে অতীত খুঁড়ে বেদনা জাগানোর কাহিনি। ভাবীকালের গাইয়েদের যা হয়তো আর্থিক নিশ্চিতি দেবে, কিন্তু দেবে না নামের পরিচিতি। তাঁদের নামে নতুন গানের সিলমোহর কোথায়?

অথচ সংখ্যায় কম হলেও শুনে মনে রাখার গান তো নিকট অতীতেই হয়েছে। একটি মাইলফলক অবশ্যই ‘আমি শুনেছি সেদিন’। সেই পথ ধরে এসেছে ‘দেখেছ কি তাকে’, ‘আমার সারাটা দিন’, ‘তুমি যাকে ভালবাসো’, ‘এ তুমি কেমন তুমি’, ‘আজ শ্রাবণের বাতাস বুকে’ বা ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’-এর মতো সমুজ্জ্বল একক, সেই শিল্পীদের যারা দিয়েছে পৃথক, বিশিষ্ট পরিচয়ের গৌরব। এমন আরও অনেক ভাল গান নিয়ে বসে আছেন মেঘে ঢাকা তারার দল। তাঁরা এই প্রজন্মের শিক্ষিত গীতিকার-সুরকার, অথচ আছেন দুয়োরানির সন্তানের মতো একঘরে হয়ে। প্রতিযোগিতার প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চে তাঁদের গান গাওয়া হয় কদাচিৎ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় কিন্তু খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় না তাঁদের। এই প্রজন্মের গাইয়েদের জন্য তাঁদের কাছে আছে বিপুল সম্ভার যা যুগের পালাবদলে হারাবে না গৌরব, হয়তো আজীবন জুড়ে থাকবে শিল্পীর নামের সঙ্গে। শিল্পীদের শুধু একটু সাহসী হতে হবে। শ্রদ্ধার পুরাতন মানিক আপাতত তোলা থাক না রত্নসিন্দুকে! ভাবতেও ভাল লাগে, নবীন গায়ক কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন চলা ও বলার ছন্দে প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাওয়া নতুন পৃথিবীর গান। শ্রোতা ও শিল্পী দু’তরফেই নতুন গানের জন্মতিথির ঘোষণা শুনতে আর কত অপেক্ষা করতে হবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement