এত দিনে আমরা কি বুঝে গিয়েছি, মনের নামও মহাশয়, যা সওয়াবে তা-ই সয়? নয়তো ‘দেশদ্রোহ আইন’-এর প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রয়োগে বহু মানুষকে জামিনবিহীন জেলে পুরে দেওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, দেশে গণতন্ত্র বিঘ্নিত হলে সে ভারী দুঃখের ব্যাপার— আমাদের কেন হেলদোল নেই? কিছু কি একটা পাল্টে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে— আমাদের ‘সওয়া’র শক্তিতে?
ইতিমধ্যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-ক ধারার দেশদ্রোহ আইন নিয়ে মামলা চলছিল সুপ্রিম কোর্টে। মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কঠোর অবস্থান নিতে চলেছে, এমন ধারণা যখন জোরদার হয়ে উঠছে, তখনই হঠাৎ শোনা গেল, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার আইনটি ‘পুনর্বিবেচনা’ করতে চায়। কোনও একটা ‘কমপিটেন্ট ফোরাম’ বা ‘যোগ্য সভা’কে দিয়ে বিষয়টা খুঁটিয়ে দেখিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে ‘রি-এগজ়্যামিন’-এর সময় দিল। এও বলল, পুনর্বিবেচনার সময়কাল জুড়ে এই আইনের বলে কোনও গ্রেফতারি, তদন্ত, মামলা কিছুই চলবে না।
সুখবর? হয়তো। তবে আমাদের ‘মহাশয়’ হওয়া মনও এই খবরে যেন উসখুস করছে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের এমন ‘গণতন্ত্র-ভক্তি’, এ কি সুখবর হতে পারে? হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাই না, তবু এটুকু তো বলতে হবেই যে— যদিও গত ১২৪ বছর ধরে আইনটির সঙ্গে পরিচিত ভারতবাসী, যদিও স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে এর ব্যবহার ঘটেছে অনেক বার, তবু সিডিশন আইনের চাবুক সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রায় পৌঁছেছে গত আট বছরে। আজ আর সিডিশন শব্দটা বললে পুরনো গৌরবগাথা মনে পড়ে না, বলতে ইচ্ছে করে না যে, ব্রিটিশ ভারতে সিডিশনের প্রথম কশাঘাতটি পড়েছিল বালগঙ্গাধর তিলকের পিঠে ১৮৯৮ সালে, মহাত্মা গান্ধীকে ইয়েরাভদা জেলে পোরা হয়েছিল সিডিশনের দায়ে, অরবিন্দের বিরুদ্ধে সিডিশন মামলা ঠোকা হলে ব্যারিস্টার দেশবন্ধু এসে দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহের বিশ্লেষণ করে জিতে নিয়েছিলেন কেস। এখন, এই ২০২২-এ সিডিশন বললেই আমাদের জর্জরিত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ভেসে ওঠে অজস্র মুখ। সে মুখগুলো কেবল সরকারের, সমাজের সমালোচনা করেছিল, রাজনীতিতে, আন্দোলনে, সংবাদজগতে। সিডিশনের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে, একের পর এক— ২০১৪ সালে ৪৭ জন, ২০১৯ সালে ৯৩ জন, ২০২০ সালে ২৩০ জন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় ২৫ জন, হাথরস গণধর্ষণকাণ্ডের পর ২২ জন, কাশ্মীরে পুলওয়ামা ঘটনার পর ২৭ জন। যত সংখ্যক অভিযুক্ত, তার নব্বই শতাংশের ক্ষেত্রে প্রমাণাভাবে চার্জশিট পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি সরকার। ২০২০ সালের ২৩০টি কেসের মধ্যে চার্জশিট আনা গিয়েছিল মাত্র ২৩টিতে।
আইনটা তো নতুন নয়। ব্রিটিশ আমলের এই সিডিশন আইনকেই গান্ধী বলেছিলেন, ‘প্রিন্স অ্যামং পলিটিক্যাল সেকশনস অব দি আইপিসি, ডিজ়াইনড টু সাপ্রেস দ্য লিবার্টি অব দ্য সিটিজ়েনস’। পরাধীন ভারতের ‘রাজকুমার-সদৃশ’ সেই অগণতান্ত্রিক আইনটি স্পষ্টতই ছিল স্বাধীন ভারতের সংবিধানের ১৯(১)(ক)-এর (নাগরিকের বাক্-স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার) সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কিংবা সংবিধানের প্রাণপুরুষ আম্বেডকর ছিলেন এই আইনের ঘোর বিরোধী। তবুও আইন থেকে যায়। তবুও নেহরু-আমলে পাশ হওয়া সংবিধানের ‘ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট’ বা প্রথম সংশোধনীতে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বাক্-স্বাধীনতা সঙ্কোচনের নীতিতে তা এক রকম সমর্থিত হয়ে যায়। সেই সময় দেশের অবস্থা ছিল অস্থির, টলোমলো, কিন্তু পরবর্তী কালেও তা প্রত্যাহার করা হয় না। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে জরুরি অবস্থার ফোকর দিয়ে অধিকার-সঙ্কোচনের পথটি পাকাপোক্ত হয়। স্বাধীন দেশে প্রায় সব সরকার এই আইনের অপপ্রয়োগ করেছে। তবে এত সব সত্ত্বেও, বলতেই হবে, ২০১৪ সালটি এই আইনের ক্ষেত্রে একটি যুগ-বিভাজিকা। এর পর থেকে যে ক্ষিপ্রতায়, যে তীব্রতায়, যে প্রচুরতা ও চতুরতায় এই আইন ব্যবহার হয়েেছ, তার সঙ্গে মোদী-পূর্ব দেশের তফাত মহাসাগরসমান।
আসলে দেশদ্রোহ আইন এখন একটি উচ্চতায় উন্নীত, এক অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্র। ঠিক যেমন, জাতীয়তাবাদ আগেও ছিল, এখনও আছে, কিন্তু ঘটে গিয়েছে একটা বিরাট পর্বান্তর— সেই ভাবেই উগ্র জাতীয়তাবাদের ‘অপর’ (‘আদার’) ‘দেশদ্রোহ’ও আজ প্রোমোশন পেয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনের অস্ত্র হয়ে গিয়েছে। আর, নেশন বা ন্যাশনালিজ়ম মানে যখন সরকার হয়ে গিয়েছে, অ্যান্টি-ন্যাশনালিস্ট বা সিডিশাস-এর মানেটাও দাঁড়িয়েছে ঝকঝকে পরিষ্কার— সরকারবিরোধী।
এ দেশে আদালতই নাগরিকের কাছে ন্যায় ও অধিকারের শেষ ভরসা। সিডিশন আইন পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রেও তাই। এখানেই উদ্বেগ। কী হবে, যদি শেষ পর্যন্ত টুকটাক কিংবা যৎসামান্য কিংবা অনুল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পর আবারও এই আইন বহাল হয়ে যায়? কী হবে যদি দেশের আসন্ন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি-উৎসবে ঢাকঢোল-বাদ্য সহকারে প্রধানমন্ত্রী দেশদ্রোহ আইনকে আবার নবজন্ম দেন? এক বার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘সংশোধিত’ বা ‘শুদ্ধ’ হয়ে বেরিয়ে এলে সেই আইন কি আদালতও মানতে বাধ্য হবে না? এখনও অবধি বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে, বিরুদ্ধ মতামতের সঙ্গে বর্তমান সরকার সর্ব ক্ষেত্রে অসহযোগিতার যে স্পর্ধা দেখিয়ে এসেছে— নাগরিকত্ব সংশোধনী থেকে কৃষক আন্দোলন, শিক্ষা সংস্কার থেকে নোটবন্দি— তাতে সত্যিই কি কল্পনা করা যায় যে, আজ ‘দেশদ্রোহ’ শব্দটির গোড়া থেকে পরীক্ষা করতে পারে এই সরকার? এ কি মোদী সরকারের পক্ষে সম্ভব? গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের গলার অব্যর্থতম ফাঁস এই আইন। যে সরকার অসহিষ্ণুতার পরাকাষ্ঠা, সে নিজের হাতেই ফাঁসের দড়িটা ছিঁড়ে ফেলবে, আদৌ কি তা সম্ভব?
‘অনাথের নাথ অবলের বল’ সুপ্রিম কোর্টের উপর ভরসা করা ছাড়া গতি নেই, কিন্তু ভুলি কী করে যে, আজ থেকে ষাট বছর আগে, ১৯৬২ সালে, সেই সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারকের বেঞ্চের হাতেই কিন্তু ‘চিকিৎসা’ পেয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল ভারতের দেশদ্রোহ আইনটি। ‘কেদার নাথ সিংহ বনাম বিহার রাজ্য’ মামলায় সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল— রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিরাগ (ডিসঅ্যাফেকশন) বা ঘৃণা (হেট্রেড) বা অবমাননা (কনটেমট) প্রকাশ এই আইন ব্যবহারের কারণ না হলেও, ‘গণ-বিশৃঙ্খলা’য় (পাবলিক ডিসঅর্ডার) উস্কানি দেওয়া হলে আইনটির প্রয়োগ হতেই পারে। সর্বোচ্চ আদালত কি সে দিন বুঝতে পারেনি, কী বিশাল একটা ধূসর জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সরকারের হাতে? সরকার তো তার অপছন্দসই কথা শুনলে বলতেই পারে যে, এর ফলে বিরাট ‘বিশৃঙ্খলা’ তৈরির সম্ভাবনা। হাথরস-এর ধর্ষণের ‘খবর’ করছেন কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান? তার মানেই গণ-বিশৃঙ্খলা ওস্কানো— সিডিশন! গুজরাতের দাভাল পটেল-সহ দেশের আরও ৫৪ জন সাংবাদিক সরকারের কোভিড-১৯ নীতির সমালোচনা করছেন? বিশৃঙ্খলা শুরু হল বলে— সিডিশন!
বিচারবিভাগ শাসনবিভাগ সকলে নিজেদের মতো চলবে, নাগরিকদের বলার জায়গা বা সুযোগ কতটুকুই বা— এই ভেবে আমরা মুখ বুজে সয়ে যেতে পারি সব। আর নয়তো সইতে না পেরে দু’চারটে কথা আজও বলে উঠতে পারি। বলতে পারি যে, আজ যা দেশদ্রোহ, কাল তা দেশের স্বাভাবিক নীতি, ইতিহাসই তার প্রমাণ। ২৩০ বছর আগে টমাস পেন রাইটস অব ম্যান-এ সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা বলে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন, আজ কি তা ভাবতে পারে তাঁর জন্মের দেশ ব্রিটেন কিংবা কবরের দেশ আমেরিকা— গণতন্ত্রের দুই ধ্বজাধারক?
বলতে পারি যে, এক জনের কাছে যা দেশপ্রেম, অন্যের কাছে তা দেশদ্রোহ ঠেকতেই পারে— যদি দেশকে দেখার ধরনে তফাত থাকে। মহাত্মা গান্ধী আর সূর্য সেন, উমর খালিদ আর বুরহান ওয়ানি, আনন্দ তেলতুম্বডে আর নরেন্দ্র মোদী, এঁরা কি দেশ, রাষ্ট্র, জাতি ইত্যাদি বলতে এক রকম জিনিস বোঝেন, না বুঝতে পারেন? তা হলে কী করব আমরা? যে যখন ক্ষমতা পাব, অন্যকে ‘সিডিশাস’ বলে জেলে পুরব?
বলতে পারি যে, প্রাক্তন ঔপনিবেশিক রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির ভালমন্দ অনেক কিছুই স্বাধীন ভারত বহন করছে, হয়তো তার সব কিছু ফেলে দেওয়া সহজও নয়— কিন্তু এই অধিকার-হত্যাকারী আইনটি আর কেন। সে দিক দিয়ে দেখলে, প্রশ্নটা এই নয় যে কেন এখনও এই ঔপনিবেশিক আইন। প্রশ্ন হল, পঁচাত্তর-বয়সি গণতন্ত্রে এখনও কেন এই গণতন্ত্র-ধ্বংসকারী আইন।
টমাস পেন-এর কথা উঠল, তাই মনে করি তাঁর একটি উক্তি। “শান্তি ও সভ্যতার কথা বলা, রাজনৈতিক অনাচারের বিরোধিতা করা... এ সব যদি দ্রোহ হয়, তবে আমার কবরের উপর লিখে রেখো, আমি দ্রোহে বিশ্বাস রেখেছিলাম।” ভারতের সামনে আজ দু’টি পথ দু’টি দিকে বেঁকেছে, একটি সভ্যতার আকাশের দিকে, অন্যটা বর্বরতার অতলের দিকে। এই মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরা, গণতান্ত্রিক ভারতের নাগরিকরা, যেন সহনশীতলতা থেকে উঠে আসতে পারি। যেন হতে পারি পেন-এরই উত্তরাধিকারী।