কলের জল কিংবা কোভিডের টিকা— এমন অনেক বস্তুই আমরা বিনামূল্যে পেয়ে থাকি। কিন্তু অর্থশাস্ত্রের প্রথম পাঠেই আছে যে, বিনামূল্যে কিছু পেলেই তাকে ‘ফ্রি গুড’ বলা যায় না, কারণ বস্তুটিকে ভোগ্যবস্তু করে তুলতে উপকরণ লেগেছে, শ্রম লেগেছে, যার মূল্য আছে। সে মূল্য কেউ না কেউ চুকিয়েছে। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত যে ১৫ কোটি ভারতীয় নাগরিক টিকা নিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশকেই টিকার জন্যে দাম দিতে হয়নি। কারণ টিকার দাম বহন করেছে সরকার। অসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আপনি ২৫০ টাকার বিনিময়ে যে টিকা নিয়েছেন, তার দামও মিটিয়েছে সরকার। ওই ২৫০ টাকা নেওয়া হয়েছে প্রদত্ত সেবার দাম হিসেবে।
পয়লা মে থেকে আমূল বদলে গেল টিকা নীতি। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের যে কেউই এখন টিকা নিতে পারেন। তবে, তা নিতে হবে বাজার নির্ধারিত দামে, যদি না রাজ্য সরকার তার ব্যয়ভার বহন করে। রাজ্য সরকারগুলিকে সরাসরি টিকা-উৎপাদকদের থেকে টিকা কিনতে হবে তাদের নির্ধারিত দামে। অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি এ বার সরাসরি উৎপাদক-নির্ধারিত দামে টিকা কিনতে পারবে, এবং লাভ রেখে টিকাকরণ চালিয়ে যেতে পারবে বাজারের নিয়মে। এ দেশে টিকা-সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দু’টির উভয়েই— সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া আর ভারত বায়োটেক— একই টিকার দু’টি পৃথক দাম ধার্য করেছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের জন্যে। এরই মধ্যে সিরাম ইনস্টিটিউট তাদের কোভিশিল্ড টিকার একটি ডোজ়ের জন্যে রাজ্য সরকারের প্রদেয় দাম প্রথমে ৪০০ টাকা নির্দিষ্ট করে দিন দুয়েকের মধ্যেই কমিয়ে ৩০০ টাকা করে দিল। বিভ্রান্ত না হয়ে এ থেকে নীতিনির্যাসটুকু বার করে আনা সহজ কর্ম নয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এ বিষয়ে কোথাও কি কোনও যুক্তি বা নিয়মনীতির জায়গা নেই? টিকা বণ্টনের সঠিক পদ্ধতিটি আদতে কী হওয়া উচিত? কী ভাবেই বা নির্ধারিত হওয়া উচিত টিকার দাম?
অস্কার ওয়াইল্ড লিখেছিলেন, “এক জন অর্থনীতিবিদ তিনিই, যিনি যাবতীয় বস্তুর দাম (প্রাইস) জানেন, কিন্তু মূল্য (ভ্যালু) জানেন না।” ‘মূল্য জানেন না’ কথাটি যেমন একটুও সম্মানসূচক নয়, ভূমণ্ডলের যাবতীয় বস্তুর দাম জানাও বাস্তবে অসম্ভব। তবে দাম না জানলেও, দাম বিষয়ে দু’চার কথা অর্থশাস্ত্রীরা জানেন, যা বোধ হয় ফেলে দেওয়ার মতো নয়। খোলা বাজারে যে কোনও বস্তুর দাম নির্ধারিত হয় ক্রেতা সর্বাধিক কতটা দাম দিতে ইচ্ছুক, আর বিক্রেতা ন্যূনতম কতটা না পেলে বিক্রিই করবে না— এই দুইয়ের সামঞ্জস্যের মধ্যে দিয়ে। উচ্ছে বেগুন পটল মুলো কিংবা বেতে-বোনা ধামা কুলোর দাম এ ভাবেই নির্ধারিত হয়। কিন্তু কোভিড ভ্যাকসিনের দাম সে ভাবে হতে পারে না। কেন পারে না তার কারণগুলি একটু গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেই সেখান থেকে যুক্তিসম্মত বণ্টন নীতিটিও বেরিয়ে আসতে পারে।
প্রথমত, ভাবতে হবে দেশের সব মানুষ টিকা নিতে চান কি না। গত কয়েক দিন ধরে টিকার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগের চিত্রটিকে যেন মেলানোই যায় না। মানুষজন তখনও ধীরেসুস্থে ‘নিচ্ছি-নেব’ করছেন। যাঁরা নিচ্ছেন এক দিকে তাঁরা পঞ্চমুখে বলছেন তাঁদের চমৎকার অভিজ্ঞতার কথা, অন্য দিকে টিকা-সন্দিহানরাও কম-বেশি লড়ে যাচ্ছিলেন। আকস্মিক ঊর্ধ্বপানে ধাবিত সংক্রমণ, চিকিৎসা সঙ্কটে মৃত্যু-সম্ভাবনা, জনমানসে যে ভীতির সঞ্চার করেছে তার ফলে চিত্রটা পাল্টে গেল দ্রুত। টিকা পাব কি পাব না, তা নিয়েই ঘোরতর অনিশ্চয়তা দেখা দিল। সর্বত্র উদ্বিগ্ন মানুষের ভিড়।
এ সব দেখে মনে হতে পারে, টিকা পেতে এমন আকুলতা, সবাই দাম দিতেও রাজি— এমনকি চড়া দাম— তা হলে সরকার টিকার বিষয়টি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই তো পারে। যে কোনও অসরকারি সংস্থা, সিরাম বা ভারত বায়োটেক ছাড়াও মডার্না বা জনসন অ্যান্ড জনসন থেকে সরাসরি আমদানি করেও তো সে টিকা বেচতে পারে এমন দামে, যা অনেকেই দিতে রাজি। খানিকটা এই ভাবনা থেকেই টিকা নীতিতে বদল আনা হল পয়লা মে থেকে, কারণ পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে টিকাকরণ যে গতিতে এগোচ্ছিল, তাতে চিন্তার কারণ ছিল। শুধু ৪৫-ঊর্ধ্ব মানুষ এবং নানা অগ্রাধিকারযুক্ত অন্যদের মিলিত সংখ্যাই যেখানে প্রায় ৪২ কোটি, সেখানে এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ়টি পেয়েছেন মাত্র ১৫ কোটি। প্রতি দিন গড়ে ২০ থেকে ২২ লক্ষ মানুষকে টিকা দেওয়া যাচ্ছিল। এই গতিতে সবাইকে দিতে গেলে আরও পাঁচ মাস লাগত শুধু এই ৪২ কোটিকে টিকা দিতে। তার পর বাকিদের! সেই সঙ্গে বোধ হয় এ ভাবনাটিও ছিল যে, মানুষ যখন টাকা দিয়ে টিকা কিনতে আগ্রহী, তখন বিনামূল্যে টিকা দিয়ে অকারণ সরকারি অর্থব্যয় কেন?
অসরকারি উদ্যোগে মূল্যের বিনিময়ে টিকাকরণের সুযোগ খুলে দিলেই যে এর গতিবৃদ্ধি হবে— এমন আশাটাই অবাস্তব এ দেশে। এক, দাম দিয়ে টিকা পেতে হলে কিছু মানুষ থাকবেনই যাঁরা তা নেবেন না, যাঁরা মনে করবেন সম্ভাব্য লাভ এমন কিছু নয় যে ওই দাম দেওয়ার মানে আছে। এখানে একটা বিশেষ ব্যাপার আছে। উচ্ছের দাম বেশি বলে আমি উচ্ছে না খেলে আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু টিকার জন্যে দাম দিতে হচ্ছে বলে আমি যদি টিকা না নিই, ক্ষতি আপনারও— কারণ আমার সংক্রমিত হওয়া এবং অন্যকে সংক্রমিত করার সম্ভাবনা পুরো রয়ে গেল। একে বলে ‘এক্সটার্নালিটি’। যে সব জিনিসের প্রকৃতিতেই এই ধরনের এক্সটার্নালিটি রয়েছে, যে বস্তু আমি ‘ভোগ’ করলে অন্যদের লাভ আছে, সমাজকেই দেখতে হবে তার ব্যবহার যেন যথেষ্ট হয়। তাই সেগুলি বিনামূল্যে বণ্টিত হলেই তার সুফল পাওয়া যেতে পারে। দুই, ন্যায্যতার প্রশ্ন— যা অবশ্য ন্যূনতম যে কোনও স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কেই প্রযোজ্য। আমার টিকা কেনার ক্ষমতা নেই বলে আমাকে কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে বাঁচতে হবে, এটি অন্যায্য। আমরা আশা করি যে, রাষ্ট্রনীতিতে খানিক ন্যায্যতার প্রলেপ থাকবে। কিন্তু সবাইকে টিকা দেওয়ার দায়িত্ব যে ভাবে রাজ্যগুলির দিকে ঠেলে দেওয়া হল, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, টিকা নীতির ন্যায্যতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আপাতত ভাবতে রাজি নয়।
আরও আশ্চর্যের কথা, রাজ্যগুলির দিকে দায়িত্ব পুরোপুরি ঠেলে দেওয়া হল, অথচ টিকার সামগ্রিক উৎপাদন ও জোগানে রাজ্যগুলির কোনও হাত নেই। বর্তমানে প্রতি মাসে কোভিশিল্ডের জোগান সাত থেকে দশ কোটি হতে পারে, আর কোভ্যাক্সিনের হতে পারে মাত্র সওয়া কোটি। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে গেলে যে বিনিয়োগ লাগবে, সেই বিনিয়োগ করার মতো অর্থ নাকি সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছে নেই। তাই সরকারের কাছে সাহায্যের আর্জি জানিয়েছিলেন আদার পুনাওয়ালা। এখনও পর্যন্ত সে বিষয়ে আর কিছু জানা যায়নি। এই সীমিত জোগানের ভাগ পেতে ইতিমধ্যেই সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছে রাজ্যগুলি তাদের বরাত দিয়ে রেখেছে। দাম যখন পূর্বনির্ধারিত, এবং সে দামে চাহিদা জোগানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখনই একটা বণ্টনের নীতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কী ভাবে রাজ্যগুলির মধ্যে সীমিত জোগানের ভাগাভাগি হবে, তা নিয়ে বিশেষ ভাবনার কোনও ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি। ফলে রাজ্যবাসীদের সময়মতো টিকা না পাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে, আর টিকা না পাওয়ার পুরো ক্ষোভটাই যে পড়বে রাজ্যের সরকারের উপর, তা অনুমান করা কঠিন নয়। অতএব চলতে থাকবে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোরের পালা।
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এক অদ্ভুত খামখেয়ালিপনার মধ্যে দিয়ে চলেছে। গত বছর করোনা সংক্রমণের শুরুতে কঠোর লকডাউন ঘোষণা থেকে শুরু করে কেন্দ্রের একের পর এক একতরফা সিদ্ধান্ত প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছিল যে, দেশটি একটি যুক্তরাষ্ট্র। এখন, যখন টিকার পর্যাপ্ত জোগানের নিশ্চয়তা এবং তার যথাযথ বণ্টনের প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এবং যা স্বাভাবিক যুক্তি অনুসারে একটি কেন্দ্রীয় সরকারই যথাযথ সম্পন্ন করতে পারে, তখনই বলা হচ্ছে রাজ্যগুলি নিজ উদ্যোগে তা করে নিক। ভারী অদ্ভুত না?
আরও অদ্ভুত হল, দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি রাজ্যের নির্বাচনে রাজ্যবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তাঁর দল জয়ী হলে রাজ্যের মানুষকে বিনামূল্যে টিকা দেবেন!
অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা