মুখ বদলের সরল অঙ্ক
Narendra Modi

মোদী-শাহ তা হলে সেই জাতপাতের হিসাবেই ভরসা রাখছেন

বিশ বছর আগে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বদলের সঙ্গে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বদলের মিল এইটুকুই।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:২৮
Share:

নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার। প্রশাসনে নতুন উদ্যম। নতুন উচ্চতায় পৌঁছনোর প্রচেষ্টা। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রাজ্য গুজরাতে সপ্তাহান্তে মুখ্যমন্ত্রী বদলের সময় বিজেপি শিবির থেকে বার বার এই শব্দগুলি উঠে আসছিল। এই সবই নাকি মুখ্যমন্ত্রী বদলের কারণ! শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গে ২০০১-এর বিধানসভা ভোটের আগে সিপিএমের স্লোগান। ‘বামফ্রন্টের বিকল্প উন্নততর বামফ্রন্ট’। ভোটের ঠিক আগে জ্যোতি বসুর বদলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়ে রাজ্য সিপিএমের চাণক্য অনিল বিশ্বাস বাম সরকারের বিরুদ্ধে যাবতীয় ক্ষোভ মুছে ফেলার রণকৌশল তৈরি করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহও গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী বদলে সেই কাজটিই করতে চাইলেন। নির্বাচনের আগে মুখ বদলে দিয়ে ‘বিজেপির বিকল্প উন্নততর বিজেপি’-র মন্ত্র।

Advertisement

বিশ বছর আগে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বদলের সঙ্গে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বদলের মিল এইটুকুই। অমিল অনেক। বয়সের ভারে ন্যুব্জ জ্যোতি বসু অনেক দিন ধরেই সরে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু গুজরাতে বিজয় রূপাণী কোনও ভাবেই সরে যেতে চাননি। গুজরাতে এক নরেন্দ্র মোদী ছাড়া বিজেপির আর কেউ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। বিজয় রূপাণী অন্তত ২০১৭’র নির্বাচনের আগে-পরে মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে পাঁচ বছর কাটিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে তা উদ্‌যাপনও করেছিলেন। তখনও জানা ছিল না, তাঁকে অচিরেই সরে যেতে হবে।

আর একটি অমিল হল, জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি হিসাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নামে কোনও চমক ছিল না। কিন্তু বিজয় রূপাণীর উত্তরসূরি যে ভূপেন্দ্র পটেল নামক কাউকে বেছে নেওয়া হবে, তা আমদাবাদের কাকপক্ষীও টের পায়নি। এক অখ্যাত, প্রথম বারের বিধায়ককে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেওয়ার সঙ্গে বরঞ্চ কংগ্রেস হাই কমান্ডের মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করার ঘটনার অনেক মিল। এমন এক ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া, যাঁকে নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হবে না। আবার তাঁকে সামনে রেখে পিছন থেকে রিমোট কন্ট্রোলে সরকার চালানো সহজ হবে।

Advertisement

দিল্লির দরবারের চোখের ইশারায় গুজরাতে এই রদবদল করিয়ে দেওয়ায় ফের প্রমাণিত হল, বিজেপির সংগঠনে এখন কংগ্রেসের হাই কমান্ড সংস্কৃতি জাঁকিয়ে বসেছে। গত ছয় মাসে এই নিয়ে পঞ্চম বার বিজেপি শাসিত রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল হল। উত্তরাখণ্ডে দু’বার মুখ্যমন্ত্রী বদল হয়েছে। অসমে ভোটে জেতার পরে মুখ্যমন্ত্রী বদলানো হয়েছে। তার পরে কর্নাটক ও গুজরাত। বিজেপিতে হাই কমান্ড-এর এমনই দাপট যে, দিল্লির নির্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে পালাবদল হলেও কোথাও বিদ্রোহের টুঁ শব্দও শোনা যায়নি। কর্নাটকে বি এস ইয়েদুরাপ্পা সামান্য আপত্তি তুলেছিলেন। তার পরে চুপ। গুজরাতেও নিতিন পটেল এক বার ক্ষোভ প্রকাশ করেই ১২ ঘণ্টার মধ্যে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। যে দল হাই কমান্ড সংস্কৃতির মেধাস্বত্বের অধিকার দাবি করতে পারে, সেই কংগ্রেসের নেতারা ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী বদলাতে গিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছেন। দুর্বল হয়ে পড়া হাই কমান্ডের নির্দেশেও মুখ্যমন্ত্রীরা গদি ছাড়তে চাইছেন না। অথচ অমিত শাহ বৃহস্পতিবার এক রাতের জন্য আমদাবাদ সফরে গিয়ে শুক্রবার ফিরে আসার পরেই শনিবার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা দিয়ে ফেলছেন।

প্রদীপের তলায় অন্ধকার। বিজেপির হাই কমান্ডের এই দাপটের অন্তরালেও তেমন দু’টি সমস্যা ফের স্পষ্ট। এক, মুখে জাতপাতের রাজনীতির বিরোধিতা করে, লালু-মুলায়ম-মায়াবতীর মুণ্ডপাত করলেও দিনের শেষে বিজেপির সেই জাতপাত ও পরিচিতি সত্তার রাজনীতির অঙ্কই ভরসা। দুই, কেন্দ্রীয় সরকারে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা এখনও ধসে না পড়লেও, মোদী ম্যাজিকে যে বিধানসভা নির্বাচন জয়ের গ্যারান্টি নেই, তা ফের মেনে নেওয়া। এই জোড়া সমস্যার কারণ না হলে পাটীদার সম্প্রদায় থেকে নতুন মুখ্যমন্ত্রী বেছে নিতে হত না।

আরএসএস নেতারা জাতপাতের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে সব জাতি, সম্প্রদায়কে ‘সমগ্র হিন্দুত্ব’-র বিরাট ছাতার তলায় নিয়ে আসার কথা বলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরপ্রদেশ, বিজেপিকে সেই ওবিসি, দলিত, আদিবাসীর অঙ্ক কষতে হয়। বাংলায় ভোটে প্রচারে গিয়ে অমিত শাহ মাহিষ্য-তেলিদের মন জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কর্নাটকে মুখ্যমন্ত্রী বদলের সময় লিঙ্গায়েতদের মন রাখতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে মোদী-শাহের পাখির চোখ ওবিসি ভোট। গুজরাতে একই অঙ্কে পাটীদার ভোটব্যাঙ্ককে পাশে পেতেই মোদী-শাহ পাটীদার সমাজের থেকে মুখ্যমন্ত্রী বেছে নিয়েছেন। কারণ, কংগ্রেস পাটীদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক পটেলকে দিয়ে বিজেপির পাটীদার ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরাতে চাইছে। একই ভাবে আম আদমি পার্টিও সুরাতের পাটীদার সমাজের হিরের ব্যবসায়ী মহেশ সওয়ানিকে সামনে রেখে এগোচ্ছে। গুজরাতের জনসংখ্যার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পাটীদার প্রভাবশালী ভোটব্যাঙ্ক। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত, পেশাদারদের মধ্যে তাঁদেরই আধিক্য। তাঁদের অগ্রাহ্য করে জনসংখ্যার ১ শতাংশ জৈন সমাজের কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করে ভোটে যাওয়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব ছিল না।

২০১৯-এর লোকসভায় বিপুল আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরলেও, ২০১৮-র পর থেকে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ফল আহামরি কিছু নয়। রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ডে মোদী ম্যাজিকের থেকে রাজ্য রাজনীতির সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মোদীর ডবল ইঞ্জিনের সরকারের স্বপ্নকে সামনে রেখে, খোদ অমিত শাহের ভোট পরিচালনাতেও বিজেপির বঙ্গবিজয়ের চেষ্টা সফল হয়নি। ঝাড়খণ্ডে রঘুবর দাস জনপ্রিয়তা হারালেও নির্বাচনের আগে তাঁকে সরানো হয়নি। কর্নাটক, উত্তরাখণ্ড, গুজরাতে বিজেপি আর ঝুঁকি নিতে চায়নি।

এ বার হয়তো মোদী-শাহ জুটিও বুঝতে পারছেন, ‘ব্র্যান্ড নরেন্দ্র মোদী’ আর বিজেপির তুরুপের তাস নেই, অন্তত সব খেলায়। রাজ্য স্তরেও ঠিকঠাক নেতৃত্ব দরকার। পশ্চিমবঙ্গ ও গুজরাত এক নয়। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের হারের ব্যর্থতা থেকে মোদী-শাহ নিজেকে আড়াল করতে পারেন। তার দায় দিলীপ ঘোষ বা কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের উপরে চাপানো যায়। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির খারাপ ফল হলে যোগী আদিত্যনাথকে কাঠগড়ায় তোলা সম্ভব। কিন্তু গুজরাত মোদী-শাহের নিজেদের রাজ্য। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী যে-ই থাকুন, সাফল্য-ব্যর্থতা মোদী-শাহের ঘরেই জমা হবে। ২০২২-এর গুজরাত ভোটের ফলের ঢেউ ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে আছড়ে পড়বে। তাই মুখ্যমন্ত্রী পদে অনভিজ্ঞ এক জনকে বসিয়ে গোটা নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া তাঁদের উপায় ছিল না। গুজরাতে বিপর্যয় হলে তার দায় পুরোপুরি ঘাড়ে এসে পড়ার বিপদ রয়েছে জেনেও।

বিপদ অবশ্য অন্য দিক থেকেও আসতে পারে। বিজেপি এত দিন জাতীয় ও রাজ্য স্তরে তার যে প্রশাসনিক দক্ষতা বা সুশাসনের সাফল্যের প্রচার করেছে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ তাতেও ধাক্কা দিয়েছে। জাতীয় স্তরে প্রধানমন্ত্রী মোদীর জনপ্রিয়তা টোল খেয়েছে। গুজরাতে সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণীকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। গুজরাতে মানুষের ক্ষোভ ধামাচাপা দিতে যদি মুখ্যমন্ত্রীর মুখ বদল করতে হয়, তবে জাতীয় স্তরেও ভবিষ্যতে সেই মুখ বদলের দাবি উঠবে না তো!

বিজেপি শিবিরের আশা একটাই। বিরোধী শিবিরই হোক বা বিজেপির অন্দরমহল, কোথাও নরেন্দ্র মোদীর কোনও বিকল্প নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত। কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতার অভিযোগের পরে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি মেরামত করতে ১৭ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদীর ৭১তম জন্মদিন ও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিশ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করতে বিজেপি ঢাকঢোল নিয়ে মাঠে নামছে। দেশ জুড়ে কর্মসূচি তৈরি। তবে শুধু কোভিড নয়, অর্থনীতির দুরবস্থা, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকদের আন্দোলনও সামাল দিতে হবে। মুখ বদলের বিপদ সামলাতে এই পরিস্থিতির ভোল বদল করতেই হবে। যে কোনও মূল্যে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement