আইনত দণ্ডনীয় কথা বলেও পুরুষ বলে দেয়, ‘ইয়ার্কি মারছিলাম’
Verbal Abuse

‘আমার হাসি পাচ্ছে না’

কোন কথায় হাসি পায়, বা হাসতে হয়, তা-ও আমাদের শেখায় আজন্ম-লালিত সংস্কার, সামাজিক ঘেরাটোপ। যিনি ক্ষমতাশালী, তাঁর রসিকতায় না হাসা মানে স্পর্ধা দেখানো।

Advertisement

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৬:০৪
Share:

অমর্ত্য সেন তাঁর স্মৃতিকথা জগৎ কুটির-এ লিখেছেন তাঁর শান্তিনিকেতনের সহপাঠিনী মঞ্জুলা দত্ত, জয়া মুখোপাধ্যায় আর বীথিকা ধরের কথা। তুখোড় বুদ্ধিমতী এই মেয়েরা তাঁদের বিদ্যেবুদ্ধির জন্য শিক্ষকদের প্রশংসা পেতেন হরবখত। তবু শান্তিনিকেতনের মুক্ত হাওয়াকেও দূষিত করত লিঙ্গবৈষম্যের বিষ। ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্’— এ প্রবচন যেন বেশি করে মনে রাখতে হত মেয়েদের। অমর্ত্যর মনে হত, তাঁর ক্লাসের মেয়েরা যতখানি বুদ্ধিমতী আর প্রতিভাময়ী, তার চেয়ে তাঁরা নিজেদের একটু খাটো দেখান ইচ্ছে করেই। ছেলেরা তাতে খুশি থাকে, মনের ভিতরে অযথা বৈর লালন করে মেয়েদের সঙ্গে টক্কর দিতে চায় না প্রতি কথায়।

Advertisement

মেয়েদের বুদ্ধি কম, তাঁদের রসবোধ নেই, এ নিয়ে রসিকতার অন্ত নেই। একঘেয়ে, চটুল সেই সব চুটকি, কখনও লিখিত বার্তায়, কখনও বা দৃশ্যশ্রাব্য চেহারায় নিত্য দিন ভরিয়ে তুলছে ফোন আর ল্যাপটপ। ভার্চুয়াল জগতের আপাত-অসীম তরীখানিও যেন আজ সে সব ডিজিটাল বর্জ্যের ভারে ছোট ঠেকছে। এক বন্ধু গল্প করছিল, তার বাচ্চার স্কুলের মায়েদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রায়ই এমন সব চুটকি আসে। একটি নমুনা— স্বামী স্ত্রীকে বললেন, “জানো, আজ আলাদিনের সেই আশ্চর্য প্রদীপ পেলাম। কী বলব তোমাকে, অল্প একটু ঘষতেই বেরিয়ে এল আরব্য রজনীর জিনি।” স্ত্রী অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী চাইলে তুমি?” স্বামী বললেন, “বললাম, তোমার মগজের ক্ষমতাটাকে দশ দিয়ে গুণ করে দিতে।” আহ্লাদে আটখানা হয়ে মহিলা বললেন, “তোমার অনুরোধ রাখল জিনি?” স্বামী বললেন, “না। সে বলল, মূর্খ মানব! জানো না, শূন্যকে দশ দিয়ে গুণ করলে শূন্যই থাকে!” বন্ধু জানায়, এর প্রত্যুত্তরে নাকি সেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মহিলাদের অনেকেই হাসির ইমোজি দিয়েছেন। বাকিরা কোনও সাড়াশব্দ করেননি। সামাজিক অনুষ্ঠান বা পারিবারিক আড্ডাতেও এই সব চুটকির চাহিদা চিরকালীন। বহু পরিবারেই এমন অ্যামেচার স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান কাকু-মেসো-দাদা থাকেন, যিনি অবলীলায় এমন সব ইয়ার্কি মারেন। সে কথা শুনে হেসে ওঠেন শ্রোতৃবৃন্দ, মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে।

এ সব রসিকতায় কারও যদি হাসি না পায়, বেশির ভাগ সময়েই তিনি সোনার কেল্লার মুকুলের মতো ভাবলেশহীন গলায় বলতে পারেন না, “আমার হাসি পাচ্ছে না।” কারণ তাতে বাকিদের কাছে রসবোধহীন ভোঁপসামুখো ভ্যাঁপাটে প্রতিপন্ন হওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে। আসলে কোন কথায় হাসি পায়, বা হাসতে হয়, তা-ও আমাদের শেখায় আজন্ম-লালিত সংস্কার, সামাজিক ঘেরাটোপ। যিনি ক্ষমতাশালী, তাঁর রসিকতায় না হাসা মানে স্পর্ধা দেখানো। আবার, সুসম্পর্ক বজায় রাখতে, বন্ধুত্ব পাতাতে বা কাজ আদায় করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মজার কথায় মজা পেতে হয়। এ প্রসঙ্গে ছোটবেলায় শোনা আর একটি চুটকির কথা মনে পড়ে। এক নেতা তাঁর বন্ধুকে বলছেন, “আমার দলের ছেলেরা যখনই রসিকতা করে আমি তখনই হেসে গড়িয়ে পড়ি।” বন্ধু জানতে চান, “তারা বুঝি খুব বুদ্ধিমান?” নেতা বলেন, “উঁহু, বুদ্ধিমান আসলে আমি।”

Advertisement

সতীনাথ ভাদুড়ির ‘রাজকবি’ গল্পে পাই ‘এনজিন স্যর’-এর কথা। স্কুলের বদমেজাজি খামখেয়ালি হেডমাস্টার রামযশ ভট্টাচার্যকে ছেলেরা আড়ালে ডাকত ‘এনজিন স্যর’ বলে, কারণ তিনি রাত্রে জপে বসলে নাকি রেলের ইঞ্জিনের মতো হুসহুস করে শব্দ হত। প্রতি শনিবার তিনি কলকাতা যেতেন। যাওয়ার সময়ে স্ত্রীকে বাড়ির ভিতরে বন্ধ করে দরজায় তালা দিয়ে যেতেন। ভদ্রমহিলার গালে পান, গিন্নি-গিন্নি চেহারা, স্নেহের রসে ভরা করুণ দু’টি চোখ। ঘোমটা টেনে থাকতেন বলে তাঁর মুখ কেউ দেখতে পেত না। উত্তমপুরুষে লেখা গল্পে সতীনাথ জানান, সুযোগ পেয়ে এক বার প্রণাম করেছিলেন তাঁকে। তাঁর চোখের কোণের কুণ্ঠিত কয়েকটি রেখা দেখে অসহায় মহিলার সঙ্গে একটা নিবিড় একাত্মতা বোধ করেছিলেন। অথচ হেডমাস্টারের উপরে রাগে লেখকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নরেশ স্কুলের শৌচালয়ের দেওয়ালে ছড়া লিখেছিল, “রামযশ ফাঁকতালে বগল বাজায়। ক্যাশবাক্সে বউ পুরে কলিকাতা যায়।” কয়েক দিন অন্তর অন্তর নতুন কবিতা লিখতে থাকে নরেশ, কখনও সেই অপরিচিতা মহিলার চরিত্রস্খলনের ইঙ্গিত করে, কখনও তাঁর সম্পর্কে স্বামীর সন্দেহের কথা তুলে। বন্ধুর কবিতা লেখার ক্ষমতা দেখে লেখক অবাক হয়েছেন, কিন্তু তার রুচির প্রশংসা করতে পারেননি। তীব্র মনোকষ্ট পেয়েও প্রতিবাদ করার সাহস হয়নি কোনও দিন। চুপিচুপি গিয়ে ‘বউ’-এর ‘উ’ মুছে ‘ই’ লিখে ‘বই’ করে দিয়ে এসেছেন শৌচালয়ের দেওয়ালে। দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে বিস্তৃত সতেরো পাতার গল্পটিতে অনেক ঘটনা ঘটে, কাহিনি শেষ হয় লেখক এবং নরেশের প্রৌঢ় বয়সে। তখনও নরেশ একটি ছড়া লেখে ছোটবেলার স্কুলের হেডমাস্টারকে নিয়ে। ছড়াটি পড়ে লেখকের ইচ্ছা হয় তার হাতটি ‘সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে’, কারণ “আজকের ছড়াটির মধ্যে সে মাসিমার নাম আনেনি। এত দিনে বুঝি তাঁর দুঃখে ওরও প্রাণ কেঁদেছে।”

মেয়েদের অশ্লীল কথা বলে বা কুপ্রস্তাব দিয়ে তাকে রসিকতা বলে চালানোর ঘটনাও কম ঘটে না আশপাশে। দেশের আইন অনুযায়ী যে কথা বললে শাস্তি পাওয়ার কথা, তা অবলীলায় বলে হেনস্থাকারী পুরুষ সাফাই দেন, “আমি তো ইয়ার্কি মারছিলাম।” ভাবখানা এমন, যেন ইচ্ছা হলেই তিনি ইয়ার্কি মারবেন— আর, তার পর অলির কথা শুনে বকুলের মতোই হেসে উঠবেন মেয়েরা। ইদানীং অবশ্য ক্ষমতার চেনা ছক উল্টে দিয়ে হেসে ওঠার বদলে হাসানোর কাজটি বেছে নিচ্ছেন অনেক মেয়ে। সমাজ, পরিবার, কর্মস্থলের খুঁটিনাটি বিষয়ে নানান অসঙ্গতি আর বিসদৃশ আচরণ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন বিশ্বের মহিলা স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানরা। নিজেদের নিয়ে ঠাট্টা করতেও তাঁদের জড়তা নেই। এ দেশেও এই পেশায় আসছেন একের পর এক মেয়ে। শান্ত, ভদ্র, নম্র— আদর্শ মেয়ের মডেলটিকে ফালাফালা করছেন এঁরা স্টেজের উপরে উঠে, এক ঘর দর্শক ছাড়াও ভার্চুয়াল জগতের ফ্যান এবং ট্রোলদের সামনে। সম্পর্ক, যৌনতা, ঋতুস্রাব— ঠাট্টার বিষয় হিসাবে উঠে আসছে সমস্ত কিছুই।

উরুজ আশফাক, প্রশস্তি সিংহ, অঙ্কুর তাঙ্গাদে তেমনই কয়েক জন। অনূর্ধ্ব-ত্রিশ উরুজের একটি ভিডিয়ো ‘উবের ড্রাইভার অ্যান্ড গ্র্যান্ডমাদার’, ইউটিউবে ভিউ ১ কোটি চল্লিশ লক্ষ। ট্যাক্সিচালক ধরে নিয়েছিলেন উরুজ হিন্দু। তাই তাঁর কাছে মুসলমানদের নিন্দা করতে শুরু করেছেন। রীতিমতো হেট-স্পিচ দিয়ে বলছেন, ওরা মিথ্যে কথা বলে, চান করে না, আমিষ খায়। উরুজ মনে মনে বলছেন, “এর মধ্যে দুটো দোষ তো আমি আজই করেছি! কী করে জানল রে বাবা!” তার পরে চলে আসছেন তাঁর নানির কথায়, যিনি নানি হিসাবে দারুণ; কিন্তু মানুষ হিসাবে কেমন, এক কথায় বলা শক্ত। উরুজের কাছে তাঁর তিনটি চাহিদা— সে যেন সময়ে খায়, সময়ে ঘুমোতে যায় এবং হিন্দুদের সঙ্গে না মেশে।

বিদ্বেষদীর্ণ দেশে দলিত, কুইয়র এবং মহিলা হিসাবে নিজের পরিচয় দেন অঙ্কুর। বলেন, আমি যা খুশি তা-ই নিয়ে ঠাট্টা করতে পারি, কারণ সংখ্যালঘুর ভিতরেও সংখ্যালঘু আমি। প্রশস্তি এঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরি ছেড়ে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির পেশায় এসেছেন। এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং কর্পোরেট জগতের পুরুষ-প্রাধান্য নিয়ে তামাশা করেন। বলেন, “এইচআর যখন প্রথম দিন বলেছিল, ‘এই অফিস পরিবারের মতো’, তখন বুঝিনি, সত্যিই পরচর্চাপ্রিয় আত্মীয়দের মতো অফিসের লোকেরা সর্ব ক্ষণ জানতে চাইবে, ‘বিয়ে করবে কবে?’…, ‘বাচ্চা চাও তো?’” লক্ষ লক্ষ ভিউ আর প্রচুর প্রশংসার পাশাপাশি আসে অনিবার্য ট্রোল— “এতে হাসির কী আছে?”, “বিষয়গুলো একেবারে যা-তা।”

দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তীর ভাষায় সেই ট্রোলদের জবাব দেওয়া যায়— “ঠিক বলেছেন, যা-তা, যেমন জগৎ যেমন অনুভব-তেমন তেমন— যথা, তথা।”

অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement