এই পৃথিবীতে যা কিছু বিদ্যমান, আমি চাই তার নির্মম সমালোচনা। নির্মম দু’টি অর্থে— সমালোচনা করে যা বেরিয়ে আসবে, সেখান থেকে সমালোচনা পিছিয়ে যাবে না; আর অবশ্যই সমালোচনা করতে গিয়ে ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে যে সংঘাত ঘটবে, সেই সংঘাতে সে ভয় পাবে না।” ১৮৪৩ সালে পঁচিশ বছর বয়সি এক যুবকের তাঁর এক বন্ধুকে লেখা চিঠি থেকে এই উদ্ধৃতিটি নেওয়া। এই চিঠির পর সেই যুবক আরও চল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন এবং সেই চল্লিশ বছর ধরে অক্ষরে অক্ষরে এই নীতিটি তিনি পালন করে যান। শুধুমাত্র বাইরের বিদ্যমান জগতের ক্ষেত্রেই নয়, নিজের চিন্তাভাবনা এবং অনুমানের ক্ষেত্রেও তিনি অনুসরণ করে চলেন এই নিরলস সমালোচনার নীতি।
সেই যুবককে ইতিহাস স্মরণে রেখেছে কার্ল মার্ক্স নামে। ইউরোপের নানা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে মার্ক্স তাঁর জীবনের শেষ চৌত্রিশ বছর আস্তানা গেড়েছিলেন লন্ডন শহরে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ তখন আমাদের ভারত-সহ পৃথিবীর এক বিরাট অংশ জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে রেখেছে। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সদর দফতর, সেই ব্রিটেনের রাজধানীতে দারিদ্র, অসুস্থতা এবং সহযোদ্ধাদের অগাধ ভালবাসা ও সাহচর্যকে সঙ্গী করে লাইব্রেরিতে বসে মার্ক্স এক দিকে ক্যাপিটাল রচনা করেছেন, অন্য দিকে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন ও উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও সমন্বয় সাধনের কাজ করে গেছেন।
উনিশ শতকের ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ভারত, আর ব্রিটেনে বসে বিশ্বব্যাপী মানবমুক্তির মনন ও অনুশীলনে নিমগ্ন দার্শনিক কার্ল মার্ক্স। ভারত সম্পর্কে কী ভাবতেন তিনি? রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারে ভারতের বামপন্থীদের মার্ক্স ও মেকলের সন্তান বলে দেগে দেওয়া হয়। নিজেদের অতীতকে গোপন রেখে আদর্শগত বিরোধীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের এ এক পরিচিত ঘৃণ্য কৌশল। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদলে সরাসরি ব্রিটিশ রাজের সূত্রপাত ঘটে। ১৮৪৮-এ কমিউনিস্ট ইস্তাহার রচিত হয়েছিল ইউরোপে আসন্ন বিপ্লবী সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে ইউরোপের পাশাপাশি মার্ক্সের নজর এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশের উপর কেন্দ্রীভূত হয়। বার বার তাঁর লেখায় ও চিঠিপত্রে উঠে আসে ভারতের প্রসঙ্গ। ১৮৫০-এর দশকে আমেরিকান পত্রিকা নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন-এর ইউরোপীয় প্রতিবেদক হিসেবে মার্ক্স নিয়মিত ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে লেখালিখি করেছেন।
এই সব লেখাতেও নজরে আসে এক স্পষ্ট উত্তরণ। গোড়ার দিকের একটি লেখায় ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে এশিয়ার বুকে সমাজবিপ্লবের সূচনায় ইতিহাসের এক ইচ্ছানিরপেক্ষ উপকরণ হিসেবে বর্ণনা করলেও ক্রমেই মার্ক্সের লেখায় বেশি করে উঠে আসে ঔপনিবেশিক শাসনের নৃশংসতা এবং ভারতীয় জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও বিদ্রোহের কথা। ১৮৫৩ সালের জুন মাসে মার্ক্স লিখছেন বুর্জোয়া সভ্যতার সুগভীর মিথ্যাচার ও নৃশংসতা কী ভাবে নিজের দেশে সম্মানজনক মুখোশ পরে থাকে আর ভারতের মতো উপনিবেশে গিয়ে সম্পূর্ণ বেআব্রু হয়ে পড়ে। তার ঠিক পরের মাসেই লিখছেন— ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ তার নিজের স্বার্থে ভারতে যে আধুনিক কাঠামো তৈরি করছে, সেই কাঠামো থেকে ভারতীয়রা তখনই লাভবান হতে পারে যখন তারা ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়ালকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার শক্তি অর্জন করবে। এর কিছু দিনের মধ্যেই ভারতে আদিবাসীদের বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় আর তার পরই চলে আসে ১৮৫৭-র ঐতিহাসিক মহাবিদ্রোহ। ইউরোপের সংবাদমাধ্যমে ও প্রচারজগতে এই মহাবিদ্রোহ ছিল ভারতীয় সিপাহিদের অত্যাচার ও বর্বরতার জঘন্য নিদর্শন। মার্ক্সের রচনায় এই বিদ্রোহ ব্যাপক ভারতীয় জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। সুদূর ভারতের ব্যারাকপুর-পটনা-ঝাঁসি-লখনউ-দিল্লি থেকে বিদ্রোহের খবর পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। তবুও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সেই খবর সংগ্রহ করে ইউরোপ ও আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের কাছে সেই খবর পৌঁছে দিয়েছেন মার্ক্স ও এঙ্গেলস। শ্রমিকদের বুঝিয়েছেন, নিজেদের দেশে শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতি দিনের লড়াই কী ভাবে উপনিবেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। ১৮৫৮ সালের ১৬ জানুয়ারি এঙ্গেলসকে এক চিঠিতে মার্ক্স লিখছেন, ভারত এখন আমাদের, অর্থাৎ ব্রিটিশ পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রামী শিবিরের সবচেয়ে বড় মিত্র।
মার্ক্সের আশা ছিল যে, ১৮৪৮-এর ইউরোপীয় বিপ্লব ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক উত্তরসূরি হিসেবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। ১৮৪৮ সে পথে এগোয়নি, ১৮৭১-এর প্যারিস কমিউনের মুক্তির মশালও একাত্তর দিনের মাথায় নিবে যায়। বিংশ শতাব্দীতে বিরাট জয় ও বিরাট সম্ভাবনার ঠিকানা সোভিয়েট ইউনিয়ন সাত দশকের পরে পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক মানচিত্র থেকে অবলুপ্ত। পুঁজিবাদের সঙ্কটের রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে সাম্য, স্বাধীনতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ফুটন্ত সকালকে ছিঁড়ে আনার স্বপ্ন ও শপথ নিয়ে নতুন প্রজন্ম আজ পৃথিবীর বুকে লড়াই চালাচ্ছে।
মার্ক্সের সময়ের পুঁজিবাদ মুনাফার সন্ধানে দেশে দেশে উপনিবেশের তাঁবু গাড়লেও সেই মুনাফার পূর্বশর্ত ছিল উৎপাদন এবং সেই উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ছিল শ্রমিকের শ্রম, শ্রমিক ও তার পরিবারের বেঁচে থাকা। অর্থনীতির ভাষায় শ্রমের সামাজিক পুনরুৎপাদন। আজ অতিকায় পুঁজি কোনও উৎপাদন ছাড়াই মুনাফা চায়। যন্ত্র এবং প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে সম্ভব হলে মেশিন এবং কৃত্রিম মেধা দিয়েই পুঁজিবাদ সব কাজ সেরে ফেলতে চায়। অর্থাৎ, সমাজের বিরাট অংশ আজ পুঁজি ও পুঁজিবাদের চোখে অপ্রয়োজনীয়, ফালতু। মার্ক্স বলেছিলেন যে, মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে। আজ অতিমুনাফার পিছনে ধাবমান পুঁজি প্রকৃতির সঙ্গে বিধ্বংসী সংঘাতে লিপ্ত হয়ে মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। মার্ক্সের যুগে এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে পুঁজি গণতন্ত্রের মুখোশ পরে চলতে অভ্যস্ত ছিল, আজ চার দিকে আবার ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের নাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস। এই কঠিন সময়ে বিপন্ন মানবজমিনে সোনা ফলাতে আবার সেই সাম্যের কারিগরকে চাই। চাই যা কিছু বিদ্যমান তার নির্ভীক নির্মম সমালোচনা ও পরিবর্তনের দিশা নির্দেশ।