১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বরে শুরু হয় ভারতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া— ব্রিটিশদের হাত থেকে ভবিষ্যৎ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের পর্ব। সে সময় মুসলিম লিগ সরকারের মদতে বাংলার নোয়াখালিতে, ও তার প্রতিক্রিয়ায় গ্রামীণ বিহারের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাতে চলছে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সংঘাত, যা থামাতে মুসলমানপ্রধান নোয়াখালিতে পায়ে হেঁটে ঘুরেছিলেন নিরস্ত্র মহাত্মা গান্ধী। নেহরুও পথে নেমেছিলেন। নভেম্বরের শুরুতেই বিহারে পৌঁছন তিনি। প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেন, তিনি প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষের মাঝখানে দাঁড়াবেন। দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের একে অপরকে আঘাত করতে হবে তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে! কৌতূহল হয়, আজকের ভারতে তিনি থাকলে কি মণিপুরে দুই সম্প্রদায়ের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের শুরুতে একই ভাবে গিয়ে দাঁড়াতেন মেইতেই ও কুকিদের মাঝখানে? পারতেন কি এই সংঘাত রোধ করতে?
সাম্প্রতিক কালে দেশভাগ-সহ দেশের সব সমস্যার জন্য অনেকেই দায়ী করেন যে নেহরুকে, কেমন ছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব? স্বাধীনতার সময় দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগে জর্জরিত ভারতে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল ত্রিশ বছরের কাছাকাছি, সাক্ষরতার হার ১৬% (নারীদের মধ্যে ৮%)। অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী ও পদ্মা দেশাই দেখিয়েছেন যে, বার্ষিক স্কুলে ভর্তির সংখ্যা ১৯৫০-৫১ সালের ২.৩৫ কোটি থেকে ১৯৬৫-৬৬ সালে পৌঁছয় ৬.৭৭ কোটিতে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি নেহরু উপলব্ধি করেন, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পরনির্ভরশীল দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নব্য-ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের কবলে পড়া সময়ের অপেক্ষা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকায় বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু, দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে বিধ্বস্ত এই দেশগুলির পক্ষে খুবই স্বাভাবিক ছিল দ্রুত উন্নতির জন্য কোনও বৃহৎ শক্তির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়া। সেই সময়ে দুই মহাশক্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে চলছিল ক্ষমতাবিস্তারের ঠান্ডা লড়াই। সে সময় নেহরু হয়ে উঠেছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মুখ। দুই শক্তিজোটের বাইরে থেকে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী স্বাধীন বিদেশনীতি অবলম্বন যে সদ্য-স্বাধীন দেশগুলোর স্বাধীনতা-রক্ষায় অপরিহার্য, বুঝেছিলেন নেহরু। তাই হাঁটতে চেয়েছিলেন স্বনির্ভরতার পথে। তিরুঅনন্তপুরমের সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক এ বৈদ্যনাথনের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৫১ থেকে ১৯৬৫-র মধ্যে ভারতে শিল্প উৎপাদন বাড়ে বছরে গড়ে ৭.১% হারে; স্বাধীনতা-পরবর্তী দুই দশকে দেশে ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটে ৭০%। ১৯৪৭-এ ভারতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে গেলে ৯০% যন্ত্রপাতিই আমদানি করতে হত বিদেশ থেকে। ১৯৬০-এ তা নেমে আসে ৪৩ শতাংশে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ সদ্য-স্বাধীন দেশ যা পারেনি, বিপুল জনসংখ্যা এবং ধর্মীয়-ভাষাগত-জাতিগত বৈচিত্র সত্ত্বেও ভারতে যে সেই গণতান্ত্রিক কাঠামো মোটামুটি সাফল্যের সঙ্গে প্রায় আট দশক ধরে রয়েছে, তা জওহরলাল নেহরুরই উত্তরাধিকার।
তা হলে কেন নেহরু বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল? কেন তাঁর বাসভবনে নির্মিত নেহরু মেমোরিয়াল মিউজ়িয়ম ও লাইব্রেরির নামবদল, বা স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টরিক্যাল রিসার্চ-এর পোস্টারে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবির থেকে নেহরুকে বাদ দেওয়ার মতো কুরুচিকর ঘটনা? তার উত্তরও সম্ভবত রয়েছে নেহরুর আদর্শগত উত্তরাধিকারেই। ২০২৩ সালে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ভূতপূর্ব অধ্যাপক আদিত্য মুখোপাধ্যায় নেহরুর ভারত-ভাবনার পাঁচটি মতাদর্শগত ভিত্তিকে চিহ্নিত করেন— সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, দরিদ্রের প্রতি সহমর্মিতা, এবং বিজ্ঞানমনস্কতা। এর মধ্যে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ধারণা, যার মূলে ছিল তাঁর ইতিহাস ও রাষ্ট্রদর্শনে গভীর পাণ্ডিত্য।
এই পাণ্ডিত্যের প্রতিফলন ঘটেছে কারারুদ্ধ অবস্থায় তাঁর লেখা ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া, গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি, এবং তাঁর আত্মজীবনীতে। ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইটি আবেগপ্রবণতার কারণে সমালোচিত হলেও, এই তিনটি বই ও অন্যান্য লেখায় নেহরু এমন কিছু প্রশ্ন তোলেন, যা তাত্ত্বিক ইতিহাসচর্চার জগতেও আলোচিত। ইতিহাসচর্চাকে রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিবরণে সীমাবদ্ধ না-রেখে সামাজিক ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের ইতিহাসচর্চায় জোর দেওয়া, কিংবা কোনও দেশের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না দেখে পারিপার্শ্বিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে সংযোগকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা উঠে আসে নেহরুর লেখায়। ইরফান হাবিব এই বইগুলিকে তুলনা করেছেন ইটালির কারারুদ্ধ তাত্ত্বিক আন্তোনিয়ো গ্রামশির যুগান্তকারী প্রিজ়ন নোটবুকস-এর সঙ্গে।
সমকালীন বিশ্বরাজনীতির পাঠ নেহরুকে বুঝিয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের বিপদ। তেমনই নেহরু বুঝেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র অসম্ভব। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আবহেও লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতার ভাষণে নেহরু ঘোষণা করেন, স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারত হবে ধর্মনিরপেক্ষ— সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্র নয়। কারণ, গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত সব নাগরিকের সমানাধিকার। যদিও মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছিল তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ, নেহরু কখনওই তার বিপরীতে সংখ্যাগুরুবাদী হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেননি। বরং ১৯৩৩ সালেই দ্য ট্রিবিউন পত্রিকায় নেহরু লেখেন যে, এক ধর্মের সাম্প্রদায়িকতা আর এক ধর্মের সাম্প্রদায়িকতার শত্রু নয়, তারা একে অপরকে পুষ্ট করে। হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলি প্রকাশ্যে একে অপরের বিরোধিতা করলেও আইনসভায় এবং ব্রিটিশ সরকারের সামনে পরস্পরকে সাহায্য করে, এ কথাও রয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে।
তাই, নেহরু হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে ব্রিটিশ-অনুগত, জাতীয়তাবাদ-বিরোধী, দেশবিরোধী, ও প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবেই দেখেছেন, সংখ্যাগুরুবাদী সাম্প্রদায়িকতাকে দেশপ্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেননি। উপরন্তু, ইতিহাসবিদ বিপান চন্দ্র দেখিয়েছেন যে, এখন বহুআলোচিত সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগুরুবাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কথাও তুলে ধরেছিলেন নেহরু। ফ্যাসিবাদী সংগঠন এবং হিংসা ও ঘৃণার রাজনীতির লক্ষণগুলি নেহরু যেমন দেখেছিলেন ১৯৩৭-পরবর্তী মুসলিম লিগের মধ্যে, তেমনই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-সহ বিভিন্ন হিন্দু ও শিখ সংগঠনের মধ্যেও। ধর্ম ও রাজনীতির সংস্রবের বিরোধিতায়, এবং স্বৈরতন্ত্র ও হিংসার রাজনীতিকে বর্জনের প্রশ্নে নেহরুর আপসহীনতার ফলে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলির পক্ষে তাঁকে আত্মসাৎ করাও অসম্ভব। নেহরুর মতাদর্শ তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রধান প্রতিরোধ।
ভারতে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পিছনে নেহরু দেখেছেন ঔপনিবেশিক ইতিহাস-ব্যাখ্যাকেও। ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক যুগবিভাজন, যেখানে জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ, ও ব্রিটিশ যুগে ভাগ করেছিলেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চায় তা বহু-সমালোচিত ও বর্জিত। ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া-তে নেহরুও বলেন, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বৈচিত্র, পরিবর্তন ‘হিন্দু যুগ’-এর ধারণায় ধরা পড়ে না। শাসকের ধর্ম দেখে মিল যেমন ব্রিটিশ আমলকে ‘খ্রিস্টান যুগ’ নাম দেননি, তেমন ‘মুসলিম যুগ’ শব্দটিও গ্রহণযোগ্য নয়। সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি দেখান, ভারতের মুসলিম শাসকদের পূর্বপুরুষরা ক্ষেত্রবিশেষে আক্রমণকারী হিসাবে এলেও তাঁরা কালক্রমে এ দেশের সমাজে আত্তীকৃত হয়ে গিয়েছিলেন। ভারত ছিল তাঁদের নিজেদের দেশ, অন্য কোনও দেশের প্রতি তাঁদের দায় ছিল না, তাঁদের শাসনে ভারত ছিল স্বাধীন। ব্রিটিশরা ভারতে বিদেশি হিসাবেই থেকেছেন। ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসন পরিচালিত হয়েছে অন্য দেশ থেকে, অন্য দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে। তাই মুসলমান শাসনাধীন ভারতকে পরাধীন দেখানোর চেষ্টা ইতিহাসের অপব্যাখ্যা। বরং ভারত এক মিশ্র সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী— যার মধ্যে রয়েছে সিন্ধু সভ্যতা, বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ-মহাভারত-গীতা, বুদ্ধ, অশোক, আলাউদ্দিন খিলজি, আকবর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী সবার অবদান।
এই মিশ্র সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ভারতকে পাকিস্তানের হিন্দু প্রতিবিম্ব হতে না দেওয়ার লক্ষ্যে নেহরু ছিলেন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধ। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে গণতন্ত্রকে জলাঞ্জলি দিতে রাজি ছিলেন না তিনি, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নামেও নয়। স্বাধীন ভারতে কৃষিব্যবস্থার উন্নতির জন্য জমিদারি প্রথার অবসান ঘটিয়ে অত্যন্ত জরুরি ভূমিসংস্কারও করেছিলেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে— সোভিয়েট ইউনিয়ন বা চিনের মতো বহু প্রাণের বিনিময়ে, বা জাপানের মতো সামরিক নিয়ন্ত্রণে নয়। স্বাধীনতার আগেও, ১৯৩৭ সালে পর পর দু’বার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি নিজেই ‘চাণক্য’ ছদ্মনামে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় দেশবাসীকে সতর্ক করেছিলেন— জওহরলালের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এক জন স্বৈরশাসকের জন্ম দিচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখতে! মুসোলিনি-হিটলার-চার্চিল-স্তালিনের সমসাময়িক হয়েও নেহরু এখানেই অনন্য। মেক্সিকোর নোবেলজয়ী কবি ওক্তাভিয়ো পাস-এর কথায়, “এই শতাব্দীর অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, নেহরু মনে করেননি যে, ইতিহাসের চাবিকাঠি তাঁর হাতে। তাই তিনি নিজের দেশ বা পৃথিবীতে রক্তের ছাপ রেখে যাননি।”
সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়