Government Holiday

সব দায় কি শিক্ষকদেরই

এ বার আসি বদলির প্রসঙ্গে। উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষকদের পছন্দসই জায়গায় বদলি চালু হল। প্রচুর শিক্ষক-শিক্ষিকা আবেদন করলেন।

Advertisement

বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:০৫
Share:

Sourced by the ABP

রাজশক্তি বজ্রকঠিন। অনন্ত আতঙ্কাধীনও বটে। এই আতঙ্ক থেকেই সে তুলে নেয় বশ্যতার, আনুগত্যের আয়ুধ। শিশু-কিশোররা কাঁচা মাটির তাল। তাদেরকে অনুগত করে তুলতে পারলে ভবিষ্যৎ খানিকটা সুরক্ষিত করা যায়। শিক্ষার্থীরা রাজার পছন্দমতো বিষয়গুলিই পড়বে। তাদের জ্ঞানচর্চার প্রথম পাঠ হবে রাজানুগত্য।

Advertisement

এই পরিকল্পনা রূপায়ণে এক বিরাট কারিগর শিক্ষকরা। রাজা চান ‘মুক্তধারা’র পণ্ডিতকে, হীরক রাজার উদয়নকে নয়। তবে কিনা, আজকের দিনে উদয়নরা সংখ্যায় বাড়ছেন। এই বেয়াড়া শিক্ষককুলের উপর আঘাত আনার জন্য তৈরি হল অত্যাধুনিক আয়ুধ। তাঁদের ফেলা হল ছুটির ফাঁদে। করোনা নিশ্চিত ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছে। ছাত্রছাত্রী নিয়মিত স্কুলে আসা ভুলে গেল। তার উপর একটু গরম পড়লেই ছুটি। অথচ, সরকার-পোষিত স্কুলগুলোতে যারা পড়ে, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে, তারা গরমে বাড়িতে খুব আরামে থাকে, এমনটা নয়। বরং স্কুলে থাকলে পাখার তলায় খানিক আরামে থাকবে, সময়ে চারটি গরম ভাত পাবে। আর এ দিকে সকলের অপ্রিয়ভাজন হলেন শিক্ষকরা। যেন তাঁরা জোর করে এ সব ছুটি ছিনিয়ে নিয়েছেন। অথচ, বেশির ভাগ শিক্ষকই কিন্তু এই ছুটি চাননি। করোনাকালে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, অনেক শিক্ষক চেয়েছেন খোলা মাঠে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসে পড়াতে। কিন্তু তাঁদের প্রশাসনের রক্তচক্ষুর শিকার হতে হয়েছিল। অনেকেই জানেন না, শিক্ষকদের নিজেদের প্রয়োজন মতো নেওয়ার জন্য ছুটি অন্য সরকারি কর্মচারীদের থেকে অনেক কম। শিক্ষকদের বিয়ে করতে হলেও মেডিক্যাল লিভ নিতে হয়, বাবা-মা গত হলেও তা-ই। সরকার-পোষিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অর্জিত ছুটি বা ‘আর্নড লিভ’ বলে কিছু নেই। আর ‘হঠাৎ ছুটি’ বাদ দিলে শিক্ষকদের সারা বছরে ছুটি ৬৫টি (গরম, পুজো-পার্বণ, বড়দিন-সহ)। তার বাইরে যে অকারণ ছুটি এখন পাওয়া যায়, তা সরকারি মর্জিতে, শিক্ষকদের আর্জিতে নয়।

এ বার আসি বদলির প্রসঙ্গে। উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষকদের পছন্দসই জায়গায় বদলি চালু হল। প্রচুর শিক্ষক-শিক্ষিকা আবেদন করলেন। যোগ্যরা পছন্দের জায়গায় বদলিও হলেন। কিন্তু দেখা গেল, বদলি হয়ে আসা নতুন স্কুলে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। কোথাও বা ছাত্রছাত্রীর তুলনায় শিক্ষক সংখ্যা বেশি। আবার কোথাও ছাত্রছাত্রীদের অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা কমে গেল। আধিকারিকরা জানতেন না কোথায় কত শূন্য পদ, সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা কত? শিক্ষকদের এ ব্যাপারে দায় থাকতে পারে না। অথচ দায়ী হলেন তাঁরাই। পরের খেলা আরও জমে গেল। আদালত শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সমতা বিধান করার জন্য ‘র‌্যাশনালাইজ়েশন’-এর আদেশ দিলেন। তড়িঘড়ি সেই আদেশ কার্যকর করার জন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই শিক্ষা দফতর এলোপাথাড়ি বদলি-নির্দেশ দিতে শুরু করল। আমার এক সহকর্মী শিক্ষিকা দীর্ঘ দিন দূরে চাকরি করার পর স্বামীর কর্মস্থলের কাছাকাছি বদলি হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু নতুন স্কুলে আসার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাঁকে আবার আরও দূরের এক স্কুলে বদলি করা হল। তাঁর বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি, দু’বছরের বাচ্চা বাড়িতে। এটা কি সরকারের দেওয়া সুবিধা নেওয়ার জন্য সরকারেরই শাস্তি?

Advertisement

অথচ, এ রকম অবস্থা আগে ছিল না। অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছিল, কিন্তু এ রকম হাঁড়ির হাল হয়নি। প্রথমত, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার দিকটি ভীষণ করুণ অবস্থায় আছে। বেশির ভাগ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক অপ্রতুল। নিয়োগ নেই। ছাত্রছাত্রীরা প্রায় কিছুই না শিখে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। যারা পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হল, তারাও অনায়াসে অষ্টম পার হয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে। পাশ-ফেল নেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। নবম শ্রেণিতে সাইকেল পাচ্ছে এবং তার পর পড়া ছেড়ে দিচ্ছে। অনেকেই নিয়মিত স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। শুধু নামটুকু নথিভুক্ত করে রাখে সরকারপ্রদত্ত সাইকেল, কন্যাশ্রী ইত্যাদি সুবিধার জন্য। সরকারি আধিকারিকরা এখন শুধু চিন্তিত সরকারি উপঢৌকনগুলি ঠিক ঠিক বিতরণ করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে। শিক্ষার চেয়ে আনুষঙ্গিক জনতোষক বিষয়গুলি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। শিক্ষা পরিদর্শকরা দীর্ঘ দিন শিক্ষাদানের মান যাচাইয়ের জন্য বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন না।

গোদের উপর বিষফোড়ার মতো যুক্ত হয়েছে নিয়োগ দুর্নীতি। শিক্ষকরাও দায়হীন নন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিক্ষকরাও এই চলমান সমাজের অংশ। তাঁরা কেউ কক্ষচ্যুত নক্ষত্র নন। আগের তুলনায় তাঁদের কাজ এখন অনেক কঠিন। কারণ হিসাবে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলিতে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মান বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে। শিক্ষকদের দায় আছে ঠিকই, কিন্তু সর্বাপেক্ষা বেশি দায়ী সরকারি নীতি।

আমাদের এই বঙ্গে স্কুলশিক্ষা এক অদ্ভুত মোড়ে দাঁড়িয়ে। শহরাঞ্চলে সরকার-পোষিত স্কুলগুলির অন্তর্জলিযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। এই যাত্রা ঠেকাতে গেলে শিক্ষকদের বলির পাঁঠা করলে চলবে না। দিল্লির সরকারি স্কুলগুলির উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। ভাল উদাহরণ অনুসরণ করা হোক। কিন্তু শিক্ষকদের অসম্মান করলে এক দিন তা বুমেরাং হয়ে সমাজের বুকে ফিরে আসবেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement