—প্রতীকী ছবি। Sourced by the ABP
সম্প্রতি ডারউইনের বিবর্তনবাদ পাঠ্যসূচি থেকে ছেঁটে ফেলার ধুম পড়েছে দেশ জুড়ে। অথচ বিবর্তনের মূল ভিত্তি হল ধারাবাহিকতার পথে উত্তরণ। ডাইনোসর যেমন এক দিনে শেষ হয়নি, তেমনই বাঁদরও এক দিনে মানুষ হয়ে ওঠেনি। প্রাণী-জগতে এমন বিবর্তন যেমন সত্য, তেমনই সমাজজীবনে শিক্ষালাভের বিবিধ পথ এবং প্রকরণেও সেটি সত্য।
ফলে যে দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাত্র পাঁচটি পৃথিবীর প্রথম পাঁচশোর মধ্যে টেনেটুনে ঢুকতে খাবি খায়, সে দেশে ‘আত্মনির্ভর’ শিক্ষার পথ আমেরিকান মডেলের অন্ধ অনুকরণ হতে পারে না। অথচ কার্যক্ষেত্রে তাই ঘটছে। দেশের পড়ুয়াদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির নাম করে জাতীয় শিক্ষানীতিতে শতাব্দী প্রাচীন তিন বছরের ব্রিটিশ মডেলের স্নাতক পাঠের বদলে এ বার দেশ জুড়ে চালু হতে চলেছে চার বছরের আমেরিকান মডেলে স্নাতক এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর পাঠের মডেল।
সন্দেহ নেই, শিক্ষান্তে পড়ুয়াদের শিক্ষার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু দেশে এখন ভয়াবহ বেকারত্বের কারণ লাখ লাখ পাশ করা পড়ুয়ার স্নাতক পাঠের অসারতা নয়। বরং তার যোগ শিল্প বা পরিষেবা ক্ষেত্রে ঘটা আর্থিক বিপর্যয়ের কারণেই।
পাঠের মেয়াদকাল তিন থেকে বেড়ে চার বছর হলে তার প্রভাব পড়ুয়ার জীবনে, সর্বোপরি শিক্ষার গুণমানে কেমন পড়বে, সেটাই বিবেচ্য হয়। কিন্তু শিক্ষায় পথ পরিবর্তনে সমাজের বিভিন্ন মতামতের সম্যক বিশ্লেষণ ছাড়াই চার বছরের এমন স্নাতক পাঠের পরিকল্পনা শেষে এক আধুনিক পোশাকপরিহিত প্রসাধনী ব্যবস্থা হবে কি না, সেই সন্দেহ ঘনিয়ে উঠছে। এ রাজ্যের সরকার প্রাথমিক ভাবে জাতীয় শিক্ষানীতির ‘প্রবল বিরোধী’ অবস্থান নিয়েও শেষ অবধি অবস্থান বদল করে চার বছরের স্নাতক পাঠের পথ অবলম্বন করেছে। রাজ্য সরকারের এই অবস্থান বদলের কারণ হিসাবে ছাত্রদের স্বার্থের কথার উল্লেখ আছে বিজ্ঞপ্তিতে। কেন্দ্রের সরকার যেমন পড়ুয়াদের দক্ষতা বৃদ্ধিকে নীতি পরিবর্তনের ঢাল বানিয়েছে, ঠিক তেমনই রাজ্যের সরকার রাজ্যের পড়ুয়াদের নিজ রাজ্যে সুলভে স্নাতকপাঠের লক্ষ্যে এই চার বছরের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবে সহমত হয়েছে। কিন্তু পড়ুয়ারা পাঠের প্রয়োজনে রাজ্যের মধ্যে থাকবে না বাইরে যাবে, সেটা মূলত নির্ভর করে রাজ্যের শিক্ষার গুণমানের উপর। এখন সেই গুণমান এই আকস্মিক পরিবর্তনে রক্ষা করা সম্ভব কি না, সেটাই প্রশ্ন।
কারণ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সরকারের এমন তড়িঘড়ি ঘোষণায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে লাখ লাখ পড়ুয়ার নাজেহাল হওয়ার অবস্থা হবে। এত কালের চলে আসা তিন বছরের কাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে চারে রূপান্তরিত হতে গেলে প্রথম থেকে চতুর্থ প্রতিটি বর্ষের সিলেবাস এবং বিশদে পাঠ্যসূচির বিপুল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ফলে সিলেবাসের এমন পরিবর্তন প্রকাশ্যে আনতে হবে পড়ুয়াদের বিষয় এবং কলেজ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। চার বছরের এমন পরিবর্তিত নতুন স্নাতকপাঠের সিলেবাসে শিক্ষার মান লঘু হচ্ছে এমনটাও অভিযোগ। কারণ, আগে যেখানে স্নাতক শিক্ষাক্রমের সিলেবাসে মূল বিষয়ের গুরুত্ব ছিল প্রায় ৭২% এখন সেটাই কমে দাঁড়াচ্ছে ৪১%-এ। প্রথম দু’টি বর্ষে ‘সুখে থাকার উপায়’, ‘যোগ ব্যায়াম’, ‘বৈদিক গণিত’, ‘ভারতীয় জ্ঞানতত্ত্ব’ থেকে শুরু করে বহু বিচিত্র বিষয়ের পাঠ আবশ্যিক করা হয়েছে নতুন পাঠক্রমে। আর এ সবের ধাক্কায় হারিয়ে গেছে স্নাতকের মূল বিষয়গুলির গুরুত্ব। ইতিমধ্যে আবার রাজ্য সরকার জানিয়ে দিয়েছে যে, চার বছরের এমন নতুন পাঠ পরিবর্তনের জন্য নাকি তাদের অভিন্ন ভর্তির পোর্টাল চালু করা যাবে না এ বছর।ফলে সরকার যদি সময়ের অভাবে প্রযুক্তি-নির্ভর কেন্দ্রীয় ভাবে ভর্তির অনলাইন পোর্টাল চালু করতে অপারগ হয় তবে কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার কলেজে কলেজে কোন জাদুবলে এমন নতুন পাঠের ভর্তি সুসম্পন্ন হবে বোঝা মুশকিল। ফলে আশঙ্কা আরও জোরালো হচ্ছে যে, কলেজে কলেজে এমন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ন্যূনতম প্রস্তুতিতে এই ভর্তি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ভাবে সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা নিয়েও।
রাজ্যের সরকারের দাবি অনুযায়ী, সুলভে রাজ্যে উন্নত শিক্ষা দানের লক্ষ্যেই যদি চার বছরের এমন স্নাতকপাঠের ব্যবস্থা হয়, তবে কোর্সের এই মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত ৩৩% বাড়তি পরিকাঠামো ব্যয়ের জোগান দেবে কে? এখনও পর্যন্ত দেশ কিংবা রাজ্যের কোনও সরকারই এই বাড়তি খরচের দায় নিতে চায়নি। শিক্ষানীতিতে দেশের জিডিপি-র ৬% বরাদ্দের কথা বলা হলেও সরকারি বরাদ্দ মাত্র ২.৯%। উচ্চশিক্ষায় ২০১৩-১৪ সালে দেশের বরাদ্দ জিডিপি-র ০.৬৩% থেকে কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ০.৩৭%-এ। আবার রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের বর্তমান পরিকাঠামোকে ব্যবহার করে কিংবা নিজস্ব আয়ের পরিকল্পনার ভিত্তিতে এই নতুন কোর্স চালু রাখবে। ফলে, দুই সরকারের বরাদ্দ শূন্য হলে কোর্সের মেয়াদ বাড়ানোর বাড়তি খরচ তোলার জন্য পড়ুয়াদের থেকে বাড়তি ফি আদায় ছাড়া বিকল্প আর কি রইল? কার্যত এই চার বছরের গেরোয় পড়ে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাতেও শিক্ষার বাণিজ্যের আশঙ্কা বেড়ে চলেছে।
চার বছরের এই ফি বৃদ্ধির পথে সরাসরি হাঁটতে না চাইলে এখনই ক্লাসঘরের ‘চক ডাস্টার’-এর মডেল ছেড়ে আবার সেই অতিমারির ‘অনলাইন’ পাঠের মডেল আংশিক প্রয়োগ করার নিদান দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষানীতিতে! কারণ, এটা অজানা নয় যে দেশ জুড়ে উচ্চশিক্ষায় এখন ৩৮% শিক্ষক পদ শূন্য। এ রাজ্যেও গত কয়েক বছরে রাজ্য-রাজ্যপাল বিবাদে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বন্ধ।
ফলে এমন ভয়াবহ শিক্ষকের ঘাটতি মেটাতে যদি অতিমারির সেই ‘অনলাইন’ ব্যবস্থা পুনরায় ফিরে আসে, ‘হাইব্রিড’ মডেলে তখন সবচেয়ে বেশি লঘু হবে পঠনপাঠনের মান। পাশাপাশি এমন ব্যবস্থায় কিন্তু অর্থাভাবে সমাজের মেধাবী এবং প্রান্তিক অংশের পড়ুয়ারা ছিটকে যেতে পারে স্নাতকপাঠের সীমানা থেকে।
উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়া কেবল বাধ্যতার কারণে চার বছরের পাঠে সম্মতি দিয়ে শিক্ষার মানের বড় আপস ঘটিয়ে রাজ্যের পড়ুয়াদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়।