গোপন প্রেম গোপনেই ছিল কয়েক বছর। আবেগের ঝান্ডাটা মন থেকে বার করে হাতে তোলার হিম্মত হয়নি। মূল ছবি: গেটি ইমেজেস। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অ্যাই, তুই কার সাপোর্টার?
আবাসিক স্কুলের ঘরে সবে একটি রাত কেটেছে বালকের। সকাল সকাল প্রেয়ার হল থেকে ফিরে আসার পর মেশিনগানের গুলির মতো প্রশ্নটা এল। সঙ্গে তিনজোড়া চোখের উৎসুক দৃষ্টি।
এমনিতেই বিশ্রী রকমের অসুস্থ হয়ে সেশন শুরুর কয়েক দিন পরে ভর্তি হতে হয়েছে। তত দিনে অন্যেরা রামকৃষ্ণ মিশনের কঠোর অনুশাসনের সঙ্গে খানিক মানিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছে। বালক সবে এসে তখনও খাবি খাচ্ছে। নতুন জীবন। নতুন রুটিন। চারপাশে নতুন নতুন লোক। তার মধ্যেই আচম্বিতে এমন একটা ‘লিডিং প্রশ্ন’!
অদ্বৈতানন্দ ভবনের দোতলার দু’নম্বর ব্লকের ২.৩ নম্বর ঘরের চতুর্থ আবাসিক সরু চোখে তাকিয়ে তিন রুমমেটকে পাল্টা প্রশ্ন করল— তোমরা?
ইস্টবেঙ্গল!
ইস্টবেঙ্গল!
ইস্টবেঙ্গল!
বালক আজন্ম মোহনবাগান। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত হিন্দু স্কুলে পড়ার সময় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে ফাটাফাটি ঝগড়া হয়েছে। স্কুলের সামনে সিমেন্টের চাতালে রবারের বলে মারকাটারি ফুটবল খেলার সময়ে ঘটি-বাঙালের কলহে কখনও সখনও চড়চাপাটি চলেছে। বাড়িতে মোহনবাগান। পাড়াতেও মোহনবাগান। কিন্তু নতুন স্কুলে এসে ১০ বছরের কচি মগজে সে দ্রুত ভেবে দেখল, জানুয়ারির এই রোঁয়া-ওঠা শীতের সকালে যে তিনটি বুলেট ধেয়ে এসেছে, তার সামনে বুক পেতে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। কোনও ক্লাসে গাড্ডু না-খেলে অন্তত আগামী ছ’বছর নরেন্দ্রপুরে পড়তে এবং থাকতে হবে। তার মধ্যে আসবে-যাবে অজস্র মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ। মোহনবাগান হারলে এই ঘরের তিন রুমমেট তো বটেই, অন্য ক্লাসের দাদাদেরও একটা মার বাইরে পড়বে না। একটা আওয়াজও বৃথা যাবে না। সেই অবিমৃশ্যকারিতার কোনও মানে হয় না। গোপন প্রেম গোপনেই থাকুক।
অতএব বালক দৃপ্তকণ্ঠে বলে দিল— ইস্টবেঙ্গল!
১৯৮০ সাল। বড় ম্যাচে সুব্রত ভট্টাচার্য এবং জামশিদ নাসিরির বল দখলের লড়াই। তখনও কলকাতার ক্লাবে কম অবাঙালি ফুটবলার ছিলেন না। কিন্তু এখন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলে বাঙালি খুঁজতে দূরবিন লাগে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সেই ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত স্কুলজীবনে ইস্টবেঙ্গলই থেকেছি। বড় ম্যাচে লাল-হলুদের জয়ে কপট হইহই করেছি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মোহনবাগানের হারে অবসাদগ্রস্ত হয়েছি। স্কুলের লাইব্রেরিতে গিয়ে খেলার সাময়িকীতে মোহনবাগান সংক্রান্ত খবর গপগপিয়ে গিলেছি। ক্লাস এইট থেকে নিয়মিত মিশন টিমের (ইস্কুল এবং কলেজের সেরা ফুটবলার ছাত্রদের মিলিয়ে টিম। যে টিমে আমাদের সঙ্গে নিয়মিত খেলতেন প্রাক্তন ছাত্র এবং তখন কলকাতার নামী ক্লাবের ফুটবলার প্রদীপ দত্ত। দত্ত’দা। প্রতি রবিবার বাইরের ক্লাবের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ) এক নম্বর গোলকিপার। এই বাঁটকুল চেহারা নিয়েও! কিন্তু কখনও মাথার উপর দিয়ে গোল খাইনি। আউটিংটা ঠিকঠাক ছিল। ওয়ান-টু-ওয়ানে এগিয়ে গিয়ে অ্যাঙ্গল ছোট করে ম্যানেজ দিতাম। আর দূর থেকে শট মারলে স্পট জাম্পে শূন্যে উঠে ফিস্ট করে।
ক্রিকেট খেলতাম সিরিয়াসলি। কিন্তু ফুটবলটা খেলতাম প্রাণ দিয়ে। সপ্তাহান্তে বাস ঠেঙিয়ে হস্টেলবাসী ছেলের সঙ্গে দেখা করতে-আসা বাবা-মা’কে কত কত রবিবার নমো নমো করে ভাগিয়ে দিয়েছি মিশন টিমের ম্যাচ খেলতে নামব বলে! কিন্তু সেই আমি বড় ম্যাচের দিন ঝুম হয়ে থাকতাম। মোহনবাগান জিতলে পেঁচোর মতো মুখ করে থাকতে হত। ইস্টবেঙ্গল জিতলে নিমপাতা খাওয়া মুখেও দাঁত বার করে হইহই করতে হত। স্কুলে কখনও দু’দলের সমর্থকদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ হলে মিশন টিমের তারকা গোলরক্ষককে তার প্রিয় দলের বিরুদ্ধে নামতে হত। কী জ্বালা!
নরেন্দ্রপুর ছেড়ে আসার পর ক্রিকেটে ঝুঁকে পড়ি। ফুটবল খেলা তো দূরস্থান, কলকাতা ফুটবলের খবরও নিয়মিত রাখা হত না। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ নিয়ে কেন জানি না আর তত উৎসাহও ছিল না। তখন ফুটবলার ধরে টিম সাপোর্ট করতাম। যেমন কৃশানু দে। কলকাতা ময়দানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলপ্লেয়ার। চোখ জুড়িয়ে যেত। অতএব কৃশানু যে টিমে খেলবেন, আমি তাদের সমর্থক। যে কারণে তাঁর কেরিয়ারের একেবারে শেষ দিকে এফসিআই (ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া)-কেও সমর্থন করেছি। কৃশানু তখন সেখানেই খেলতেন।
চাকরিসূত্রে দিল্লিতে থাকার সময় এক বার অম্বেডকর স্টেডিয়ামে খেলা (সম্ভবত ডুরান্ড কাপ ফাইনাল) দেখতে গিয়ে ভাইচুং ভুটিয়াকে ব্যাপক ভাল লেগে গেল। তার পর থেকে ভাইচুং যে টিমে, আমি তাদের সমর্থক।
ভাইচুং অবসর নেওয়ার পর আর ওই রকম কোনও প্রেম হয়নি। সম্ভবত সেই আত্মীয়তাটা চলে গিয়েছিল। নাড়ির যোগাযোগটাও ছিল না। তত দিনে হুড়মুড়িয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, বুন্দেশলিগা, লা লিগা ইত্যাদি বিদেশি ফুটবল। পাল্লা দিয়ে তিন প্রধানে হু-হু করে কমছে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা। ফলে কলকাতা ময়দানের ফুটবলের সঙ্গে ‘অ্যাম্বিলিকাল কর্ড’টাই কেটে গিয়েছিল।
সেটা আবার ফিরে এল আইএসএল সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগ সেমিফাইনালের টাইব্রেকারটার সময়। দম ধরে বসে আছি, ফাইনালে উঠবে মোহনবাগান? উঠল। অতঃপর ফাইনাল। বলতে নেই, যথেষ্ট উত্তেজনাকর ফাইনাল। নির্ধারিত সময়। তার পরে অতিরিক্ত সময়। তার পরে টাইব্রেকার। এবং জয়। ট্রফি। প্রথম আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হল মোহনবাগান। ভারতসেরা।
অধিনায়ক প্রীতম কোটাল ছাড়া সে ভাবে আর কোনও ফুটবলারের নাম জানি না। প্রথম এগারোয় আর কোনও বাঙালি আছেন কি না, তা-ও ঠিকঠাক জানতাম না। পরে শুনলাম, আরও একজন আছেন— শুভাশিস বসু। এঁরা ছাড়া পেত্রাতোস, হুগো বুমোস আরও কী কী বিদেশি সব নাম যেন! তাঁরা খুবই ভাল পেশাদার ফুটবলার। আধুনিকও বটে। পাঁড় মোহনবাগান সমর্থকেরা নিশ্চয়ই তাঁদের নাড়িনক্ষত্র জানবেন। কিন্তু নাড়ির যোগাযোগহীন (সম্ভবত খানিক প্রাদেশিকতায় আক্রান্তও) প্রাক্তন মোহন-সমর্থকের তো জানার কথা নয়। অন্তরে কোনও তাগিদও নেই। কিন্তু তবুও ভিতরে ভিতরে একটা তিরতিরে গর্ব হচ্ছিল। মোহনবাগান ভারতসেরা। ভা-র-ত-সে-রা!
মোহনবাগান ভারতসেরার ট্রফি জিতলে গর্ব একটা হয় বটে। কিন্তু হারলে কি বাল্যবয়সের সেই দমচাপা কষ্ট আর অবসাদটা ফিরবে? ছবি: পিটিআই।
সেটা কি সেই আবাসিক স্কুলে ছ’টা বছর ‘মোহনবাগানী’ পরিচয় লুকিয়ে রাখার পাপস্খালন? না কি তার পরে চার চারটে দশক পেরিয়ে এসে এক মধ্যবয়সি বাঙালির মনে জেগে-থাকা আকুল তারকা-বুভুক্ষা? যে ভাবছিল, বাঙালির জীবনে হিরো এত কমে গেল কেন? একটা ৫০ বছরের লোক, যে তার গৌরবগাথা লেখার দিন বহু আগে পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এখনও সে-ই সকলের দাদা! তাকে ঘিরে আবর্তিত হয় রাজ্যের প্রায় সমস্ত এনডোর্সমেন্ট। কারণ, বিপণন করার জন্য তার মতো জনপ্রিয় আর কাউকে পাওয়া যায় না!
সেই মধ্যবয়সি ভাবছিল, সিনেমা-শিল্প-রাজনীতি-খেলাধুলোয় বাঙালির হিরো নেই আর! বলিউডের কথা ভাবতে বসলে বাঙালিকে এখন জোর করে রানি মুখোপাধ্যায় বা কাজলকে টেনে আনতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের আপামর বাঙালি একজন বাঙালিকে দেখে উদ্বেল হচ্ছে— এমন পাঁচটা নাম বলা মুশকিল! সে ভাবছিল, আমরা কি হিরো খুঁজতে ভুলে গেলাম? না কি হিরো চিনতে? আমরা এখন বনি সেনগুপ্তকে ‘হিরো’ বলি। শৌনক সেনকে নয়।
সেই মধ্যবয়সি ভাবছিল, আমরা কি আসলে ভুল ‘স্যাম্পল’ নিয়ে কাজ করছি? নিজেদের আকাঙ্ক্ষাটাই ভুল তৈরি করছি? এর কারণ কি আমাদের সার্বিক অবক্ষয়? আমরা কি আস্তে আস্তে প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছি? বাংলা এবং বাঙালির পিগমিত্ব কি তার শেষ স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছে?
মোহনবাগানের ট্রফিজয়ের আবডালে তার মনে হচ্ছিল, বাঙালির সামনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় বিপদ এটাই যে, বাঙালি গৌরবান্বিত হতে ভুলে যাচ্ছে। তার আর কোনও আত্মপ্রসাদ অবশিষ্ট নেই। আত্মশ্লাঘা নেই। সেই মশমশে ভাবটা চলে গিয়েছে। মনে হচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর অরবিন্দ কেজরীওয়ালের মতো আর কোনও নেতা উঠে এলেন না কেন? সে নিজেকে প্রশ্ন করছিল, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া এখন আর কোনও বাঙালি রাজনীতিক আছেন, যাঁর আগামী পাঁচ-দশ বছরের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়?
অন্তরীক্ষ থেকে সে নিজেই নিজেকে জবাব দিচ্ছিল— নাহ্। নেই।
তার মনে হচ্ছিল, আমরা কোনও একটা ভুল গলিতে ঢুকে পড়ে মধ্যমেধাকেই ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ বলে ভাবতে শুরু করেছি। চারদিকে মধ্যমেধার উৎসব। চাহিদার অভিমুখ ঘুরে গিয়েছে। আমরা নিজেদের সুবিধেমতো অনেক নীচে নামিয়ে দিয়েছি নিজেদের ‘বেঞ্চমার্ক’। ৩০০ ধাপ সিঁড়ির দু’তিনটে ধাপ টেনেটুনে উঠেই মনে করছি, অহো! কী করিলাম! আমাগো মতো আর কেউ নাই।
বালকের দিকে পিছু ফিরে তাকিয়ে মধ্যবয়সি ভাবছিল, এ কি ছেলেবেলার পাপস্খালন হল? না কি মধ্যবয়সের উদ্বেগ? কলকাতার ক্লাব মোহনবাগান ভারতসেরার ট্রফি জিতলে গর্ব একটা হয় বটে। কিন্তু হারলে কি বাল্যবয়সের সেই দমচাপা কষ্ট আর অবসাদটা ফিরবে?
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)