CPM

উন্নয়নের চেষ্টাই শেষ কথা

প্রত্যন্ত জায়গায় মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দেওয়া খুবই প্রয়োজন।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২১ ০৫:০৮
Share:

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এমন বিপুল ভাবে জয়ী হয়ে ফিরল কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রচুর যুক্তি-প্রতিযুক্তি চলছে। সে সব কাটাকুটি হয়ে গেলে পড়ে থাকবে একটিই উপাদান— উন্নয়নের চেষ্টা। শুধু উন্নয়নের হিসেব নয়, উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের চেষ্টা। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই বিষয়টা এমন ভাবে পিছনে চলে যায়, যাতে মনে হয় এ শুধু ফাঁকা বুলি আর সরকারের অপপ্রচার। মানুষ নিঃসন্দেহে তা ভাবে না। তাই গত ভোটের ২১১ আসন বেড়ে আজ ২১৩।

Advertisement

আমার বাড়ির সামনের রাস্তা ভাল, কলে জল সহজেই আসে। আজ কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর যেতে বাসে ঝাঁকুনি লাগে না। ২০১১-র অনেক আগে থেকেই তামিলনাড়ুর গ্রামাঞ্চলেও ভাল রাস্তা ছিল, এখানে ছিল না— এখন প্রত্যন্ত পুরুলিয়ার গ্রামেও ভাল রাস্তা। সরকারি হাসপাতালের চেহারা, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান— এ সব আমার রোজকার কাজে হয়তো তেমন লাগে না, কিন্তু সাধারণ মানুষ তখন আর এখনের ফারাকটা ঠিক বুঝতে পারেন।

নানা নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে জনসেবার প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়ন, দুইয়েরই ব্যবস্থা হচ্ছে। কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প বা সাইকেল দেওয়া, এগুলো ২০১৬ সালে ছিল না। বিহারে নীতীশ কুমারের সরকার বা বিদেশে কোথাও কোনও সরকারের ভাল নীতির আদলে নতুন প্রকল্পের ব্যবস্থা হয়েছে প্রতিনিয়ত। কন্যাশ্রীর জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের পুরস্কার আমার মেয়েদের হয়তো নাড়া দেয় না, কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সে উপকার ভোলে না। কন্যাশ্রী এসে মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়িয়েছে। যথেষ্ট বেড়েছে কি না, আজ যতটা বেড়েছে কাল ততটা বাড়বে কি না, এগুলো পরের কথা। প্রথম কথা হল, মানুষ চেষ্টাটাকে সম্মান করে, মনে রাখে। আর বুঝতে হবে, সব চেষ্টা, মানুষের ভাল করার সমস্ত ইচ্ছের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু ওই ‘দিদি’ই। বাংলার মানুষ মনের দিক থেকে ওঁর সঙ্গে যতখানি যুক্ত, তেমনটা আর কারও সঙ্গে নয়— এই বিশ্বাস অগণিত জনের।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের সাম্প্রতিক ইতিহাস লিখতে গেলে বা‌ংলার ছেলেমেয়েদের কেন কাজের খোঁজে বেঙ্গালুরু যেতে হচ্ছে, কেন পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় আয় ও বৃদ্ধির হার গুজরাতের মতো নয়, অনেক কথা উঠতে থাকে। কারণ, উন্নয়নের গল্পটা এখনও শহর ও শ্রেণি-কেন্দ্রিক। কিন্তু অনেক কথাই আছে, যা বলা হয় না। যেমন তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে পরেই বিআরজি ফান্ড ঠিকমতো ব্যবহার করে, প্রশাসনিক পদক্ষেপের সাহায্যে এবং বিশেষ করে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের সাহায্যে গোটা জঙ্গলমহলকে সন্ত্রাসমুক্ত করা, ভারতের কোথাও যা এখনও পর্যন্ত করা যায়নি। দার্জিলিঙের সমস্যার মোকাবিলা এবং সমাধান, সেও হয়েছে যথাযথ ভাবে। ন্যূনতম দামে যাতে মানুষ ওষুধ পেতে পারেন, সরকারি ভাবে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের সুবিধে যে মানুষরা পেয়েছেন তাঁরা বিলক্ষণ জানেন।

সমস্ত টাকাপয়সা খরচ করে শুধু একটা কলেজ, একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সবচেয়ে নামীদামি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করার কোনও যুক্তি আমি দেখি না। প্রত্যন্ত জায়গায় মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দেওয়া খুবই প্রয়োজন। অনেক খামতি আছে ঠিকই, তবু মফস্সল ও গ্রামের মানুষ এ ব্যাপারটিকে অন্য চোখে দেখেন। মানুষের সমাধানের এ প্রচেষ্টাকে আমরা দূর থেকে টিটকারি দিতে পারি, কিন্তু এই প্রচেষ্টা যে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সাহায্য করছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

২০১৮ সালে নীতি আয়োগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থনৈতিক নানা বিষয়ে আলোচনার সময় বিজেপি-শাসিত বেশ কয়েকটি রাজ্যের উচ্চপদস্থ সচিবদের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ হয়েছিল। তাঁরা সকলেই কলকাতার আমূল রূপান্তর নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এক জন তো এও বললেন, ভারতের চারটি বড় বা প্রধান শহরের মধ্যে কলকাতা সবচেয়ে পরিষ্কার ও সুন্দর। আমরা নিজেরাই কি সে কথা বলি? ‘উন্নয়ন’কে পিছনের বেঞ্চে বসিয়ে রাখার কোনও কারণ আমি দেখি না। তাই হয়তো ২১১ আর ২১৩-র তফাত এত কম। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে ভাল আছেন, তথ্যগত বিশ্লেষণও তা-ই বলে। খাবারদাবার, লেখাপড়া, স্বাস্থ্য আর পছন্দসই কাজের জোগান— এই সব কিছুতেই সব সময়, দেশের সব রাজ্যে কোনও না কোনও ভয়ঙ্কর খামতি থাকে। এ রাজ্যেও খামতি প্রচুর। কিন্তু দিনরাত চেষ্টার শেষ নেই, ফলও পাচ্ছেন মানুষ। সব ছাপিয়ে মানুষের বিপদে মানুষের পাশে থাকাটাকে জনগণ মূল্যবান বলে ভাবেন। এ রাজ্যের মানুষ তাঁদের নেত্রীকে যত দিন কাছের মানুষ বলে ভাববেন, শাসক দলের আসন সংখ্যা ২০০ পেরোতেই থাকবে। মানুষের কথা আর না ভাবলে তখন অন্য রকম ফল হবে।

২০১১ সালের পর এখনও পর্যন্ত যে দু’টি নির্বাচন আমরা দেখলাম, তাতে বাম-কংগ্রেস-বিজেপি আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল বা শক্তিশালী যা-ই হোক, রাজ্যের শাসক দলের আসন সংখ্যার কিছু হেরফের হয়নি। ২৯৪ আসনের বিধানসভায় একক দল ২০০টির বেশি আসন পাচ্ছে। ২০১৬ এবং ২০২১, দুটো নির্বাচনেই কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন ‘সন্ত্রাস’ ও ‘রিগিং’ বন্ধ করতে যারপরনাই সক্রিয় হয়েছে। তাতেও ফলের ফারাক হয়নি। তা হলে জনমতের একটা কিছু তো নিশ্চয়ই অপরিবর্তিত থাকছে, বা মানুষ মনে করছেন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার তাঁদের জন্য ভাল কাজ করছে, দিদির প্রতি আস্থাও অটুট থাকছে। উন্নয়নের প্রচেষ্টা এবং তার কিছু সুফল যে গত দশ বছর ধরে অব্যাহত আছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই জায়গাটায় কোনও পরিবর্তন হয়নি, তাই ফলাফলেও তেমন কোনও পরিবর্তন নেই। ধর্মাধর্ম, নাগরিকত্ব সঙ্কট, পারিবারিক বা পাড়াতুতো দুর্নীতি, ‘সব গোল্লায় গেল’ জাতীয় প্রচার, এই সমস্ত কিছুকে পরাস্ত করতে উন্নয়নের চেষ্টাই আসল কথা। সেটা ভুলে গেলে চলবে না কিছুতেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement