কোভিড অতিমারিতে সারা পৃথিবীর অভিজ্ঞতা খতিয়ে দেখলে একটি ধারণা উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। আর্থিক ভাবে এবং সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ, যাঁরা আশৈশব খুব একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করার অবকাশ পাননি, প্রতিকূল পরিবেশে সংগ্রাম করেছেন, আয়েশ করে দিন কাটানোর সুযোগ পাননি, তাঁরা কোভিডের সঙ্গে অনেক সক্ষম ভাবে যুঝতে পেরেছেন। অবশ্যই এটা কোনও গাণিতিক উপপাদ্য বা বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় প্রমাণিত সত্য নয়, তবে এ ধরনের মানুষদের ভাইরাসের সঙ্গে লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা যে বেশি, অনেক স্বাস্থ্যবিদই সেটা মনে করছেন। কিছু সমীক্ষার ফলও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যদি পৃথিবীটাকে মোটের উপর দুটো ভাগে ভাগ করা যায়, যার এক দিকে বড়লোক দেশ, অন্য দিকে গরিব, তা হলে দেখা যাবে বড়লোক দেশে মৃত্যুর হার গরিব দেশগুলোর তুলনায় অনেক অনেক বেশি। গরিব দেশের পরিসংখ্যান সংগ্রহে অনেক গরমিল আছে, কিন্তু সেটা হিসাবের মধ্যে নিলেও ওই ফারাক খুব একটা কমবে না।
একটা কথা সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায়। অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে বিলাসবহুল জীবনযাপন, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে দীর্ঘকালের অনভিজ্ঞতা, খোলা বাতাসে রোদ্দুরে সময় না কাটানো, সব কিছুই উচ্চবিত্তদের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করেছে। এই কাগজের পাতায় একটি নিবন্ধে (‘সুবিধে আছে, ঝুঁকিও কম নয়’, ১৩ মে, ২০২০) এ সম্পর্কে কিছু আগাম আলোচনা করা হয়েছিল। জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৮) তথ্য অনুসারে দেখা যায় যে, কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে ভারতবর্ষে প্রতি বছর বহু মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত ব্যাধিতে ভোগেন, কিন্তু মৃত্যুর হার সেখানে বেশ কম। অচেনা আগন্তুক ভাইরাসকে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে নেচার পত্রিকায় অনেক দিন আগেই আলোচনা হয়েছে, কয়েকটি জায়গার মধ্যে আমেরিকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ দেশেও গ্রামাঞ্চলে এই অতিমারির প্রকোপ শহরগুলোর মতো নয়। দুইয়ে দুইয়ে চারই হয়, এমন বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে করা শক্ত। কিন্তু এ দেশে সরকারি তথ্য নিয়ে যথার্থ সমালোচনা সত্ত্বেও মেনে নিতেই হবে, অতিমারিতে মৃত্যুর হার ২ শতাংশের উপরে নয়। বিত্তশালী দেশগুলির মৃত্যুহারের চেয়ে যা অনেকটাই কম।
কতকগুলো বিক্ষিপ্ত ঘটনা চোখে পড়েছে। বারাণসীর রামকৃষ্ণ মিশনে একটি বৃদ্ধাবাস আছে। সেই চত্বরে একটি ছোট হাসপাতালে প্রচুর কোভিড আক্রান্তের চিকিৎসা হয়েছে। মৃত্যুর হার বেশ কম। অবাক হতে হয়, বৃদ্ধাবাসের তেমন কোনও ক্ষতিই হয়নি। আক্রান্ত ও তজ্জনিত মৃত্যুর হার শূন্য। এর সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উজাড় হয়ে যাওয়া বৃদ্ধাবাসের তুলনা প্রাসঙ্গিক। কেউ কেউ বলছেন, মিশন চত্বরে খোলামেলা রৌদ্রোজ্জ্বল প্রাঙ্গণের অস্তিত্ব এবং উত্তরপ্রদেশের দরিদ্র জনগণের লড়াইয়ের ক্ষমতার জোর উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়।
অল্প অসুখে মুঠো মুঠো ওষুধ খাওয়ার অভ্যেস কি সচ্ছলদের দুর্বল করেছে? ওষুধ কেনার পয়সা না থাকা কি অনেক ক্ষেত্রে শাপে বর হয়েছে? এ সব প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। গুগল ডাক্তারের গুণ ও দোষ দুই-ই বিদ্যমান। তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়, নানান ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের হাত ধরে মানুষ অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু পকেটে পয়সা থাকলেই চাট্টি ওষুধ কেনার প্রবণতা মানুষের অন্তরমহলকে কতটা বিষাক্ত ও দুর্বল করেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয় না। প্রামাণ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে, ওষুধ কোম্পানিগুলো নতুন ওষুধ বিক্রির তাগিদে সেই কোম্পানিরই পুরনো ওষুধ কত খারাপ, সে সব নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয়, বিশেষ করে পুরনো ওষুধের পেটেন্ট অধিকার শেষ হওয়ার সময়ে, যাতে প্রতিযোগী সস্তায় ওষুধের বাজার ধরতে না পারে। উনিশ-বিশ উপকার হচ্ছে এমন নতুন ওষুধ পুরনোর চেয়ে অনেক বেশি দামে, ‘এটা অনেক ভাল’ হিসাবে বাজারে আসে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়তো অনেক ভয়াবহ, তেমন ওষুধও নির্দ্বিধায় মানুষকে খাইয়ে দেওয়া হয়। আর মাছ-মাংসের সঙ্গে চাট্টি অ্যান্টিবায়োটিক কেনা তো শহুরে বিত্তশালীদের বহু দিনের অভ্যেস।
বারাণসীতে এক সন্ন্যাসী মহারাজ বলেছিলেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাইরে যাঁরা কাজকর্ম করছেন তাঁদের মধ্যে কোভিডের প্রকোপ কম। এটা তাঁদের প্রায়-অবৈতনিক ছোট হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা। ডাক্তারবাবুরা এখানে বার বার বলেছেন উন্মুক্ত খোলামেলা পরিবেশে সময় কাটানোর উপকারিতার কথা। মনে পড়ে কলেজে পড়ার সময় দীর্ঘকাল লোডশেডিংয়ে গলদ্ঘর্ম হয়ে পড়াশোনার কথা। সেই সঙ্গে ফ্যান চলুক না চলুক নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশের কথা। গরম কালে এসি মেশিন না চললে হাঁসফাঁস করার অভ্যাস আমাদের অনেকের কী ভীষণ ক্ষতি করেছে এবং করছে, তার হিসাব এক দিন নিশ্চয়ই বেরোবে। লাগামছাড়া বহুতল নির্মাণে সম্মতি সব জায়গায় সূর্যকে আড়াল করছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দৌড়ে বেড়ানোর কোনও জায়গা নেই।
প্রকৃতির চরম অবমাননা পরিবেশ এবং সেই সঙ্গে মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনকে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সে কথা আমরা পরিবেশবিদদের কাছে অনেক ভাবে জানতে পেরেছি। আমাদের গায়ে হাত না পড়লে আমরা বুঝি না আসলে আমরা আক্রান্ত। বস্তুত পথে যাঁরা মুখোশ পরার ব্যাপারে ব্যক্তিগত বিজ্ঞানের জ্ঞানে সিঞ্চিত হয়ে খানিকটা নির্লিপ্ত, তাঁরা মনে করেন, ও মরবে তাতে আমার কী! এতটাই সভ্য মানুষের সমাজ সচেতনতা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের প্রথম এবং মৌলিক সম্পর্ক তার শরীরের মাধ্যমে। সেই শরীরটাকেই প্রকৃতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার সমস্যা আমাদের দুর্বল করে চলেছে।
শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আর্থিক অবস্থার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নিশ্চয়ই আরও অনেক গবেষণা হবে। কিন্তু নিঃসন্দেহে সেই আলোচনায় খানিকটা উৎসাহ দেবে এ বারের অভিজ্ঞতা। কোভিডের ভয়ে ভীত মানুষ এই শহরে বাড়ির বাইরের কাজ করাতে অনেকের সাহায্য নিয়েছেন। যাঁদের শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁরা বাইরে না বেরিয়ে যদি যাঁদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাঁরা বাইরের কাজ করেন— ভাইরাস তেমন কাবু করতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তাই এক দিকে বিত্তশালী এবং অন্য দিকে বাড়তি রোজগারের প্রয়োজন এমন মানুষ— দুইয়ের মধ্যে লেনদেনের এই সম্পর্কের ফলে কোভিডের ব্যাপ্তি খানিকটা কমতে পারে।
এখন, একটা মজার ব্যাপার হল, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে এই বাণিজ্য বড়লোক দেশে অর্থাৎ যে দেশে শ্রমের মজুরি বেশি সেখানে হওয়া শক্ত। যেমন বহুতল বাড়িতে যাঁরা গার্ডের কাজ করেন তাঁরা সারা দিন খোলামেলা জায়গায় কাজ করে থাকেন। এঁদের করোনাভাইরাস যে আক্রান্ত করেনি তা নয়, কিন্তু হয়তো অনেকেরই বড় বিপদ হয়নি।
অর্থনীতি, মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যে নতুন ধরনের গবেষণার সুযোগ তৈরি করে দিল কোভিড অভিজ্ঞতা।