ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে দেশের, রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা। স্কুল-কলেজের দরজা খুলেছে। সেই ব্যস্ত করিডর, মাস্ক ঢাকা মুখে ‘গুড মর্নিং ম্যাম’ জানানোর ভিড়, ঘড়ির কাঁটা ধরে ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টার শব্দ— হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে স্কুল আর কলেজ বাড়িরাও।
এই আপাত স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে থেকে গিয়েছে কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন। তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সম্ভবত পরীক্ষা সংক্রান্ত। পড়াশোনা অফলাইন শুরু হলেও পরীক্ষা কী পদ্ধতিতে হবে— অনলাইন না অফলাইন?
গত বছর পুজোর পর থেকে অনলাইন-অফলাইন মেশানো পড়াশোনা শুরু হয়ে গেলেও সিমেস্টার শেষের পরীক্ষা হয়েছে সম্পূর্ণ অনলাইন পদ্ধতিতে। এ কথা অনস্বীকার্য, এই অনলাইন-অফলাইন পড়া, স্কুল-কলেজ খোলা বা না খোলার ধাঁধার মধ্যে আবার হানা দিয়েছিল করোনা, এবং ঠিক সেই সময় অনলাইন পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তবে সেই সময়ও, ৯ জানুয়ারি অফলাইন নেওয়া হয়েছিল ডব্লিউবি সেট পরীক্ষা। বিভিন্ন কলেজে এই পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়, শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীরা তা পরিচালনা করেন।
এই পর্যায়ের প্রথম সার্থক ও সদর্থক অফলাইন পরীক্ষা দেখা গেল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে। কত নতুন পদক্ষেপ, কত নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এবং কত কত প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া। অনেক ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিতে এসে পৌঁছয়নি, পরীক্ষার হলে চুপ করে বসে থেকেছে, ফাঁকা খাতা জমা দিয়েছে— এ রকম অসংখ্য মনখারাপ করে দেওয়া ঘটনা সামনে এসেছে।
কারণও বিশ্লেষিত হয়েছে নানা ভাবে। দীর্ঘ দিনের স্কুল বন্ধ থাকা, মিড-ডে মিল বন্ধ হয়ে যাওয়া, মিড-ডে মিলের খাদ্য উপকরণ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা নানা কারণে সফল না হওয়া, প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের হাতে বইপত্র পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও, তার ন্যূনতম পাঠগ্রহণের পরিবেশ না থাকা— কারণের তালিকা কিছু কম নয়।
এক অদ্ভুত ধরন দেখা যাচ্ছে— পরীক্ষা শেষের পরে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের চেয়ার, টেবিল, পাখা-সহ বিভিন্ন জিনিসে আঘাত করছে রাগের বশে (‘এই নিঃসঙ্গ, নির্লিপ্ত কৈশোর’, ৩০-৩)। এ রাগ কিসের বহিঃপ্রকাশ, আমাদের অজানা থাকার কথা নয়। শিক্ষক হয়ে, অভিভাবক হয়ে এ রাগের বহিঃপ্রকাশ আমরা কম দেখিনি। কোভিড-পরবর্তী জীবনে বদলে যাওয়া সমীকরণ, উপার্জনকারী অভিভাবকের হঠাৎ মৃত্যু, অনলাইন-অফলাইন পড়াশুনোর দোটানা যদি শহরের ছাত্রছাত্রীদের সমস্যার কয়েকটি উদাহরণ হয়— শহরতলি, গ্রামে নাবালিকা বিবাহ, বাধ্য হয়ে বই-খাতার বদলে উপার্জনের মাধ্যম খুঁজে নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার হলে কী ভাবেই বা এসে পৌঁছবে? যদি কোনও মতে এসে পৌঁছয়ও, কী লিখবে সে উত্তরপত্রে?
তবু এই প্রচেষ্টা অফলাইন পরীক্ষার স্বাভাবিকত্বে ফেরার মাইলফলক হয়ে থাকবে। শুধুমাত্র শিক্ষক-শিক্ষিকারাই জানেন অনলাইন পরীক্ষার নামে তাঁদের কী অদ্ভুত এক মানসিক নিগ্রহের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাঁরা জানেন, ছাত্র বা ছাত্রীটি সম্পূর্ণ অসাধু উপায় অবলম্বন করছে পরীক্ষা দেওয়ার সময়। অথচ, তিনি কিছু করতে পারেন না। যে ছাত্রটি কোনও দিন ক্লাসে আসেনি, কারণ জানতে চাওয়ায় নানা রকম শংসাপত্র হাজির করেছে, তাকেই সর্বোচ্চ নম্বর দিতে বাধ্য থাকেন শিক্ষক। কারণ, তার খাতায় কোনও খুঁত নেই। যে ছাত্রীটি লোকাল ট্রেনে কোভিডের ভয় নিয়েও ক্লাস করতে এসেছে, সে কিন্তু অনেকটা কম নম্বর পায়। কারণ, তার খাতায় কিছু স্বাভাবিক ভুলভ্রান্তি, কাটাকুটি আছে। এ ছাড়া নানা আইনি প্রহসন তো আছেই। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে খাতা আসে। বলা হয় যে, যান্ত্রিক ত্রুটি। এমনকি বেশ কিছু দিন পরে খাতা এলেও মেনে নেওয়া হয় যে, সে খাতা পাঠিয়েছিল, কিন্তু এসে পৌঁছয়নি।
শিক্ষককে মেনে নিতে হয় যে, তিনি তাঁর যোগ্যতর সন্তানের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অসৎ, অসাধু সন্তানকে দিচ্ছেন। ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্ধত্বের দোহাইও তিনি দিতে পারেন না। সম্প্রতি ফেটসু-র অবরোধের উত্তরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের প্রতিবাদ একটু হলেও আশা জাগায়— ধৃতরাষ্ট্রত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার দিন বোধ হয় এল। যে ভাবে মুক্তি পাওয়ার আশা জাগায় অফলাইন মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংগঠন (ফেটসু) সম্প্রতি উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে ঘেরাও করে এই দাবিতে যে, তাদের পরীক্ষা অনলাইনই নিতে হবে, অফলাইন পরীক্ষাতে তারা সম্মত নয়। অবশ্য ফেটসু-র এই অবরোধই একমাত্র নয়, এক মাস আগেই সিবিএসই পরীক্ষার্থীরাও অফলাইন পরীক্ষা বাতিল করে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানায় সমাজমাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপকরা খুব নির্দিষ্ট ভাবে জানিয়েছেন, যদি অনলাইন পরীক্ষায় সম্মত হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তাঁরা এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনও মতেই থাকবেন না।
অতীতের এক দশক আমরা মনে রাখতে বাধ্য হয়েছি অনিয়মিত পরীক্ষা, গণ-টোকাটুকির সময়ের চিহ্নরূপে। আমাদের সন্তান, ছাত্রছাত্রীদের এই কলঙ্কের পুনরাবৃত্তি থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই হবে। সময়ের এ দায় আমরা অস্বীকার করতে পারি না।