— ফাইল চিত্র
নব্যযুবাদের মধ্যে ‘কামিং আউট পার্টি’র (যে সামাজিক উৎসব উদ্যাপনের মধ্যে দিয়ে নবীনদের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াটি ঘটে) রেওয়াজ বহুকাল বাতিলের খাতায় চলে গিয়েছে। কিন্তু এখনও কোনও কোনও দেশে এমন উদ্যাপন সম্মিলনী আয়োজিত হয়। বলা যেতে পারে, সেই দেশগুলি এক বিশেষ আয় স্তরে পৌঁছলে বা তাদের আর্থিক প্রগতি কোনও বিশেষ মাত্রা স্পর্শ করলে বিশ্বের অন্য দেশগুলির সামনে নজির রাখার জন্যই এমন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৪০০০ আমেরিকান ডলারের আশপাশে পৌঁছলে, ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে একটা সুষম অবস্থা দেখা দিলে এবং ১৯৯০ সালের নিরিখে আন্তর্জাতিক ডলার-মূল্যমান স্পর্শ করলেই (যে পরিসংখ্যান পরবর্তী সময়ে পুনরাবৃত্ত ডলার-মূল্যের চেয়ে বেশি হলে) দেশগুলি সামার অলিম্পিক্সের মতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনে উদ্যোগী হয়।
১৯ শতকের অন্তিম দশকে যখন আধুনিক অলিম্পিক্স আন্দোলনের জন্ম, তখন অপেক্ষাকৃত ধনী পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলি এবং আমেরিকা মাথাপিছু ৪০০০ ডলার আয়ের সীমা স্পর্শ করছিল। গ্রিস ছাড়া (যে হেতু প্রাচীন অলিম্পিক্স সেই দেশেই হত, তাই প্রথম আধুনিক অলিম্পিক্সও সেখানেই আয়োজিত হয়) যে দেশগুলি অলিম্পিক্সের আয়োজন করেছিল, তারা যথাক্রমে ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেন, সুইডেন এবং তৎকালীন জার্মানি (১৯১৬ সালে, মনে রাখা দরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেখানে অলিম্পিক্স বাতিল হয়েছিল)। ইংরেজ
অর্থনীতিবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসনের হিসাব অনুযায়ী, ১৯১৩ সালের নিরিখে সার্বিক ভাবে পশ্চিম ইউরোপের মাথাপিছু আয় ছিল ৩,৪৭৩ আমেরিকান ডলার।
পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার পালা সাঙ্গ হলে অলিম্পিক্স আয়োজনের দায়িত্ব সেই সব দেশগুলিকে দেওয়া হতে থাকে, যারা মাথাপিছু ৪০০০ ডলার বার্ষিক আয়ের চৌকাঠ পেরোতে পেরেছে (যখন অলিম্পিক্স প্রকৃতই আয়োজিত হয়, তখন এই আয়ের মাত্রা খানিক বেশিই ছিল)। ১৯৬৪ সালে জাপান, ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া, ২০০৮–এ চিন এবং ২০১৬ সালে ব্রাজিলে অলিম্পিক্স অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ সালে মেক্সিকো আলোচ্য আয়-রেখা পার করেছিল। ২০৩৬ সালে এ ব্যাপারে ভারতের সম্ভাবনাও প্রবল। সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক ডলারের নিরিখে ভারতের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৯০০০ ডলারেরও বেশি। ১৯৯০ সালের ৪০০০ ডলারের হিসাবের নিরিখে ভারত যথেষ্ট এগিয়েই রয়েছে এবং ২০৩৬ নাগাদ এই পরিসংখ্যান দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে আশা করা যায়।
অলিম্পিক্স আয়োজন মোটেই সস্তায় সারা যায় না। ২০০৮ সালে ৪৪ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার খরচ করে চিন বিশ্বের অন্যান্য দেশকে চমকে দিয়েছিল। কিন্তু তার পরে যে দেশগুলি অলিম্পিক্সের আয়োজন করেছে, তাদের খরচের পরিমাণ তার এক-তৃতীয়াংশ। এই ব্যয়ের বেশির ভাগই খরচ হয় নাগরিক পরিকাঠামোর উন্নয়নে। ২০১০ সালে যখন নয়াদিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমস আয়োজিত হয়, তখন তার সার্বিক ব্যয় ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। যা ক্রীড়া ব্যতিরেকে ওই শহরের অন্য পরিকাঠামোর ৮০ শতাংশেরও বেশি। ১৯৮২ সালের এশিয়াড এবং কমনওয়েলথ গেমসের জন্য পরিকল্পিত বহু কাজই পরে শেষ হয়।
এই সব ক্রীড়াযজ্ঞ যে সব শহরে অনুষ্ঠিত হয়, সেগুলি হয় দেশের রাজধানী, নয়তো সেখানকার বৃহত্তম শহর। এক মাত্র ব্যতিক্রম ১৯০৪ সালে আমেরিকার সেন্ট লুইস। যদি আমদাবাদ ভারতের ক্ষেত্রে অলিম্পিক্স আয়োজনের জন্য পছন্দের শহর হয়ে থাকে (তেমনটিই মনে হচ্ছে), তবে এটিও হবে একটি ব্যতিক্রম। কারণ জনসংখ্যা, আয়তন, মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি), পরিচ্ছন্নতা অথবা নারীসুরক্ষা— কোনও দিক থেকেই আমদাবাদ দেশের প্রথম পাঁচটি শহরের মধ্যে পড়ে না। বাণিজ্য বা শিক্ষাগত ক্ষেত্রে এ শহরের কিছু পরিমাণ পরিচিতি থাকলেও বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে এর তেমন খ্যাতি নেই। তার উপর, এই শহরে ইংরেজি ভাষার চল তুলনামূলক ভাবে কম। শহরবাসী প্রধানত নিরামিষাশী, তার উপর আরও কিছু বাধানিষেধ এখানে রয়েছে।
এই সব বিষয়ের অধিকাংশই বদলাবে না। কিন্তু অলিম্পিক্সের আয়োজক শহর হিসেবে মুখ দেখাতে পারলে কিছু উন্নয়ন সম্ভব হবে। একটি বৃহত্তর এবং উন্নততর বিমানবন্দর গড়ে উঠবে, মেট্রো রেল চলাচলের বিষয়টি পূর্ণতা পাবে, হোটেলের সংখ্যা বাড়বে, আরও বেশি উড়ালপুল তৈরি হবে। সেই সময়ে মুম্বইয়ের সঙ্গে আমদাবাদের বুলেট ট্রেন সংযোগও হয়তো সম্ভব হবে। এই সমস্ত কিছুর খরচের ঠিক কতখানি সেই শহর বা রাজ্য বহন করবে, আর কতখানিই বা কেন্দ্র তার নিজের কাঁধে নেবে? এ সব কথা বাদ দিয়েও যদি ভাবা যায়, তবে এ অনস্বীকার্য যে, ২০০৪-এর অলিম্পিক্সের আয়োজন করে গ্রিস যে ভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং খানিকটা সেই কারণেই চার বছর পরে সে দেশে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়, সেই পরিস্থিতিতে ভারত পড়বে না।
যদি আয়োজক দেশই অলিম্পিক্সে খুব খারাপ ফল করে, তবে তা নেহাতই বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং, আয়োজক দেশের ক্রীড়াবিদরা (পুরুষ-নারী নির্বিশেষে) কি আর একটু বেশি রাষ্ট্রিক সহায়তা পাবেন, যাতে তাঁরা ভাল ফল করতে পারেন? সাধারণত আয়োজক দেশগুলি আগে অলিম্পিক্সে যে সংখ্যক পদক পেয়েছিল, দেশের মাটিতে তার থেকে বেশি সংখ্যক পদক জয় করে। এর পিছনে বিশেষ উদ্যোগ অবশ্যই ক্রিয়াশীল থাকে। ১৯৬৪ সালে মেক্সিকো একটি মাত্র পদক জিতেছিল। কিন্তু ১৯৬৮-তে সে দেশ জয় করে ৯টি পদক। একই ভাবে দক্ষিণ কোরিয়া ১৯ থেকে ৩৩-এ, চিন ৬৩ থেকে ১০০-য় গিয়ে দাঁড়ায়।
১৯৮২ সালে যখন ভারত এশিয়ান গেমস আয়োজন করেছিল, সে বারও এ দেশ উল্লেখযোগ্য রকমের ভাল ফল করে। তার প্রাপ্ত পদকের সংখ্যা ২৮ থেকে ৫৭-য় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই অগ্রগতির ধারা ভারত বজায় রাখতে পারেনি। একই ভাবে, নয়াদিল্লির কমনওয়েলথ গেমসে ভারত ১০১টি পদক জয় করলেও গ্লাসগোয় মাত্র ৬৪টি পদক ঘরে আনে।
পরিশেষে এটাই বলার যে, বিষয়টি যোগ-বিয়োগের নয়। যখন একটি দেশ তার ‘সাবালকত্বে’র প্রমাণ হিসেবে কোনও উদ্যাপন চায়, তার তরফে অলিম্পিক্স আয়োজনই যথাযথ। বিশেষত, হ্যাংঝাউয়ে এ দেশের ক্রীড়াবিদদের সাম্প্রতিক কৃতিত্বের পর এ নিয়ে কোনও অভিযোগ উঠতে পারে বলে মনে হয় না।