সীমানার দু’পারে ধর্ম-অতিক্রমী মানবতাবাদীরাই আজ সংখ্যালঘু
Humanism

যে যেখানে মার খায়

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর সহ্যসীমা পেরিয়েছে। তবে কিনা, ইতিহাসের পা-তোলা পা-ফেলা লক্ষ করলে বোঝা যায় এই ঘটনা ছিল অনিবার্য।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৫১
Share:

যে  যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া। প্রিয় এই গানের পঙ্‌ক্তিটি যতখানি সত্য, ঠিক ততখানিই সত্য— যে যেখানে লড়তে পারে না, মার খায়, মরে যায়, সেও আমাদেরই মরা। আমাদেরই মার খাওয়া। আমাদেরই পিছু হটা।

Advertisement

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর সহ্যসীমা পেরিয়েছে। তবে কিনা, ইতিহাসের পা-তোলা পা-ফেলা লক্ষ করলে বোঝা যায় এই ঘটনা ছিল অনিবার্য। গত অগস্টে সে দেশে যে আন্দোলন চলছিল, তার মধ্যে ইসলামি মৌলবাদী নেতাদের দাপট যাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন না, মনে করছিলেন এই গণ-অভ্যুত্থান রচনা করছে প্রগতির রাজনীতি ও স্বাধীনতার ইতিহাস, এত দিনে তাঁরা নিশ্চয়ই নিজেদের কাছে স্বীকার করছেন যে, রাজনীতি এবং ইতিহাস, দুটোই তাঁরা কম বুঝছিলেন তখন।

বুঝছিলেন না যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দু’টি মুখই ছিল চরম বাস্তব। একটি ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী অসহিষ্ণুতার মুখ। অন্যটি ধর্মীয় রাজনীতির উন্মাদনাকে কোনও না কোনও ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার মুখ। হাসিনা আমলেও বহু সময় বাংলাদেশের হিন্দুরা বিপন্ন বোধ করেছেন, উদারপন্থী মুসলমান নাগরিকরা হতাশ, ত্রস্ত, লজ্জিত, অপমানিত বোধ করেছেন সরকারের সঙ্গে উগ্রবাদীদের নানা সংযোগে আর আপসে। কিন্তু সব মিলিয়ে, অতি-উগ্রতার কোমরে একটা শক্ত রশি পরানো ছিল তখন। মনে পড়ে, হাসিনা সেই সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ করায় এখানে অনেকেই রেগে আগুন হচ্ছিলেন, তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না যে অনলাইন মাধ্যমে কী দ্রুত গতিতে ভয়ঙ্কর আগুন ছড়াচ্ছে ইসলামি মৌলবাদ। আর এখন? এখন অবাধ রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে আর একটি নতুন মৌলবাদ-অধ্যুষিত দেশ তৈরির সাফল্যে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ হাসছে গগনবিদারক অট্টহাসি। অগস্টের পর থেকে তো কেবল হিন্দুরা নন, আক্রান্ত নির্যাতিত নিহত হচ্ছেন বৌদ্ধরা, সুফিরা, সুস্থচিন্তার মুসলমানরা। ধর্মীয় সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর ঊর্ধ্বে উঠে আজীবন সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির মুক্তিচর্চায় যুক্ত থেকেছেন যাঁরা, তাঁরা সবাই আজ ‘সংখ্যালঘু’ এই বাংলাদেশে।

Advertisement

ঠিক যেমন, এই রামজন্মভূমি আদর্শে অভিষিক্ত, বাবরি মসজিদ ধ্বংসস্তূপের উপর রামমন্দির অলঙ্কৃত, মুসলমান প্রহারে নিবেদিত ভারতবর্ষে আজ আমরা অনেকেই এখন সংখ্যালঘু। আজ ৬ ডিসেম্বর: বাবরি মসজিদ ঘটনার বত্রিশ বছর ‘উদ্‌যাপন’, আরএসএস-এর শতাব্দীপূর্তির আবহে। যে ভারতীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার জন্য সক্রিয় হতে একের পর এক উদ্বিগ্ন বার্তা পাঠাচ্ছে, সেই রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেই কিন্তু বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির হয়েছে, আরও মসজিদ ভাঙার আশায় কাশীর জ্ঞানবাপী বা অজমের শরিফ-এ চলছে মাটির তলায় মন্দিরের খোঁজ, সম্ভলের মতো জায়গায় মসজিদ-মন্দির উত্তাপে ঘটছে উত্তপ্ত সংঘাত, মুসলমান-নিধন।

গোটা বিশ্ব জানে, বাংলাদেশের এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা কী ভয়ঙ্কর, বিদেশ থেকে উদ্বেগবার্তা ভেসে আসছে। উদ্বেগে হয়তো এ বিপদ আর আটকানো যাবে না। ঠিক যেমন, ভারতীয় সাম্প্রদায়িক তরঙ্গ আটকানো যায়নি ভর্ৎসনা বা সতর্কবার্তায়, বরং তার এক রকম স্বাভাবিকীকরণ হয়ে গিয়েছে বলে অজমের বা সম্ভল নিয়ে আজ আন্তর্জাতিক স্তরে আর উচ্চবাচ্যও হয় না। তাই, ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা যারা ধর্ম-অতিক্রমী নীতি আর রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরতে চাই— হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, এই ‘আমরা’ই আজ ভারতে পাকিস্তানে বাংলাদেশে— সংখ্যালঘু।

এই ‘আমরা’-র সঙ্গে ‘সেকুলার’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা জুড়ব না। কেননা, এই মনুষ্যত্ব নামক নীতির সঙ্গে আসলে ধর্মে-বিশ্বাস বা ধর্মে-অবিশ্বাসের বিন্দুমাত্র যোগ নেই। বহু মানুষ আপন আপন ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান, ভক্তিমান থেকেও অন্য মানুষের দিকে যখন তাকান— কোনও ধর্মচিহ্ন দেখেন না, বরং সুখেদুঃখে গড়া এক-একটা গোটা মানুষকেই দেখেন। নিজের ধর্মকে মানার অর্থ বলতে তাঁরা অন্যের ধর্মবোধে আঘাত করা বা ধর্মস্থানের উপর চড়াও হওয়া বোঝেন না, ঘৃণা ও হিংসা ছড়িয়ে ক্ষমতার ভাগ চান না। এই ‘আমরা’ যদি সংখ্যালঘু হই, কে বা কারা সংখ্যাগুরু, বুঝতে অসুবিধে হয় না।

কাঁটাতারের এ দিকে-ও দিকে বহমান তপ্ত লাভাস্রোত— ধর্মরাজনীতির উন্মাদনা কিন্তু এই উপমহাদেশে অনিবার্য ছিল। বিশ্বের আর কত দেশেই বা কাঁটাতার বসেছিল ধর্মের উপর ভিত্তি করে? নতুন নির্মীয়মাণ দেশে কোন জেলায় কোন ধর্মের কত লোক, তা গুনে গুনে কোন দিকে তাকে ঠেলা হবে, এমন স্থির হয়েছিল আর কত জায়গায়? প্রোটেস্ট্যান্টধর্মী উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ক্যাথলিকধর্মী রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড ছাড়া খুব বেশি উদাহরণ মনে আসছে না। এই হল ‘ওরিজিনাল সিন’, মূলগত পাপ। এক বার ধর্মীয় যুক্তিতে তৈরি দেশ তৈরি হওয়ার পর রাষ্ট্রের চরিত্রটা, জ্ঞানত বা অজ্ঞানত, পাল্টে যেতে বাধ্য। সে দিক থেকে দেখলে, ১৯৪৭-এ কেবল পাকিস্তানই ধর্মের উপর ভর করে তৈরি হয়নি, ভারতও হয়েছিল। এক দিকে ‘অখণ্ড ভারত’-এর আদর্শ, অন্য দিকে ‘ভারতীয় ফেডারেশন’-এর দীর্ঘলালিত ভাবনা ফেলে দিয়ে, মহাত্মা গান্ধীর মত সম্পূর্ণ অমান্য করে দেশ ভাগ করে যে ‘ভারত’ তৈরি হয়েছিল, সেই ‘সেকুলার’ দেশকে তাই প্রথম থেকেই একটা নড়বড়ে যুক্তির উপর দাঁড়াতে হয়েছিল। এই ভাবে ধর্মের যুক্তিতে তৈরি দেশে যে অন্য ধর্মাবলম্বীরা থেকে গেলেন, সেই ‘সংখ্যালঘু’রা প্রথম থেকেই রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিতে একটা বিশেষ স্থান নিলেন। শুনতে অপ্রিয় হলেও কথাটা সত্যি— ব্রিটিশ আমলের তুলনায় ১৯৪৭-পরবর্তী আমলে আরও অনেক বেশি বাস্তব অথবা সম্ভাব্য বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়া হল এই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের— পাকিস্তানে তো বটেই, ভারতেও।

এখানে আর একটা কথা না বললেই নয়। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ আর রাজনৈতিক ইসলাম, দুটোই ভয়ানক। কিন্তু দ্বিতীয়টা যেহেতু ‘গ্লোবাল ফেনোমেনন’, বিশ্ব-ব্যাপৃত কর্মসূচি নিয়ে তা চলে। পূর্ব পাকিস্তান যখন বাংলাদেশ হল, তখন এই ইসলামি বিশ্ব-অ্যাজেন্ডাকে পিছু হটিয়ে দিতে পেরেছিল ভাষা-সংস্কৃতি ভিত্তিক রাজনীতি— সে ছিল এক বিপুল গুরুত্বপূর্ণ জয়। সে দিক থেকে, ১৯৪৭-এর দেশভাগ যে সাম্প্রদায়িক আদর্শের জয়শঙ্খ বাজিয়েছিল, ১৯৭১ সালে তার এই (সাময়িক) পরাজয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি, ধর্ম-অতিক্রমী মানবতাবাদীদের দৃষ্টিতে এই ঘটনা অনেক বেশি গুরুতর। কিন্তু, ওই জয় যে সাময়িক বা আংশিক ছিল, তাও বোঝা গিয়েছিল প্রায় জন্মলগ্নেই, জোরদার ইসলামি হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেল একাত্তরের অনেক সংগ্রামীকে, মুজিব ও তাঁর পরিবারকে। ১৯৭৫ সালের মুজিব-হত্যা আরও এক বার ১৯৪৭-এর দেশভাগ যুক্তিরই সমর্থন।

তার পর থেকে সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে জেরবার হতে হতে এগিয়েছে বাংলাদেশ— যার অভ্রান্ত প্রকাশ ঘটেছে ভারতবিরোধিতা বনাম ভারতসমর্থনের ধারাবাহিক সংঘাতে, কিংবা মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতা বনাম মুক্তিযুদ্ধ-উদ্‌যাপনের দুই বিরুদ্ধ স্রোতের ধাক্কায়। আজকে সে দেশে ভারতবিরোধিতার ছবি সমস্ত দুনিয়ার সামনে প্রকট। তবে গত কয়েক দশক ধরেই ইসলামি অন্ধতা সেখানে পরিস্ফুট হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে। ২০১৫-১৬ সাল থেকে তা অবিরত, অব্যাহত। একের পর এক ব্লগার হত্যা, বা হোলি আর্টিজ়ান বেকারি সন্ত্রাস তার প্রমাণ। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না, ২০২৪-এর সময়টা এগিয়ে আসছে দ্রুত পায়ে। গত অগস্টে ছাত্র আন্দোলন হিসেবে যা শুরু হল, কেন এত দ্রুত তা মৌলবাদী ঝড়ে পৌঁছে গেল, সেও বোঝা কঠিন নয়। ওয়টস্যাপ, মেসেঞ্জার, ইউটিউব, টেলিগ্রাম-এর মতো অ্যাপ মৌলবাদী চক্রে ইতিমধ্যে ভীষণ সক্রিয়। এই সাইবার মৌলবাদের লক্ষ্যও যুবসমাজ, বাহনও যুবসমাজ। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন-এর সাহায্য নিয়ে বিদেশি ইসলামি গোষ্ঠীগুলি প্রাত্যহিক প্রোপাগান্ডায় ব্যস্ত। আপাত উদ্দেশ্য ভারতকে দু’দিক থেকে ইসলামি রাষ্ট্র দিয়ে ঘেরা, যাতে আন্তর্জাতিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সব রকম চাপই রাখা যায় দৃঢ়তর। ফলে অন্যান্য কিছু অ-ইসলামি বিশ্বশক্তিও ভারতবিরোধী ইসলামি কার্যক্রমে পরমাগ্রহী।

অর্থাৎ, সীমান্তের এ পারে-ও পারে, সব উগ্রতা, অসহিষ্ণুতা আজ আবার নতুন শক্তিতে ফিরে এসেছে। পাল্টা উগ্রতা আর পাল্টা অসহিষ্ণুতা দিয়ে যাঁরা একে ঠেকানোর কথা ভাবছেন, জানবেন, তাঁদের যুক্তিতে চললে আবারও টুকরো টুকরো, আবারও রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হতে হবে। সাড়ে সাত দশক পর যদি এই উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে কোনও বোধ, বুদ্ধি, যুক্তি, প্রযুক্তি অর্জিত হয়ে থাকে, তা হলে ভিন্ন কোনও পথ চাই। এবং— কী সেই পথ, তা খুঁজতে হয়তো আসতে হবে সেই অন্য ‘সংখ্যালঘু’দের কাছেই— যাঁরা প্রথমত ও শেষত ধর্ম-দাপটতন্ত্র পরিহার করে চলতে চান। যাঁরা জানেন, সীমানার এ ধারে-ও ধারে, যে যেখানে মার খায়, আমাদেরই মরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement