এ বছর ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট’-এর প্রতিপাদ্য ‘ডেটা ফর বেটার লাইভস’। তথ্যের মূল্য জীবনের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটন লিখছেন, ১৮৭২-এর বেঙ্গল সেনসাসের পরে ইংরেজ জানতে পারে যে, বঙ্গদেশের জনসংখ্যার ৪৭.৯ শতাংশ মুসলমান। সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে (৬৬.৮), তার পর রাজশাহী (৬১) ও ঢাকা (৫৯.১), সবশেষে বর্ধমান (১২.৮)। উনিশ শতকে ইংরেজের কার্যক্রম কলকাতাকেন্দ্রিক, সেখানে হিন্দু প্রাধান্য। তাই শাসক যখন জানল, নোয়াখালি বা পাবনা জেলায় ৭০ শতাংশ, বগুড়ায় ৮০ শতাংশের বেশি মুসলমান, তখন অবাক হল। ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজ় লিখেছেন, পুরনো রাজধানী মুর্শিদাবাদ, মালদহের চেয়েও ব-দ্বীপের সমভূমিতে বেশি মুসলমানের বাস। তখন মালদহে ৪৬ এবং মুর্শিদাবাদে ৪৫ শতাংশ মুসলমান, বরিশাল ও ময়মনসিংহে প্রায় ৬৫ শতাংশ!
১৮৩৬-এ উইলিয়াম অ্যাডাম বলেন, রাজশাহী পরিদর্শনের আগে কলকাতা থেকে তা হিন্দুপ্রধান জেলা বলেই তাঁর ধারণা জন্মেছিল। ১৯২৭-এ স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিবেদন অনুসারে সেখানে ১০ জন হিন্দু প্রতি ৬ জন মুসলমান। তথ্যানুসন্ধানের পর বিপরীত সিদ্ধান্তে পৌঁছন অ্যাডাম। তাঁর হিসাব, ১০০০ জন মুসলমান প্রতি হিন্দু ৪৫০। আবার জনগণনা জানায়, বাংলায় ১০০০ জন মুসলমান পিছু হিন্দু ২৮২। ইংরেজ শাসকের ছোট বৃত্তে যাঁরা ঘোরাফেরা করতেন তাঁরা জমিদার, তালুকদার, রাজকর্মচারী, ব্যবসায়ী, মহাজন, শিক্ষিত মানুষ। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই হিন্দু। মুসলমানদের বেশির ভাগ চাষি, খেতমজুর, জেলে, তাঁতি, দর্জি, কাঠমিস্ত্রি। শাসক বর্গের সঙ্গে নিচু তলার তেমন যোগাযোগ ছিল না। রাজশাহীর পুঠিয়া, নাটোর, দিঘাপতিয়া জমিদারবংশ— সবাই হিন্দু। তাহিরপুর, চৌগ্রাম, পাকুড়িয়া, দারিকুশি, কর্চমারিয়া, জোয়ারিবিশি, দুবলহাটি ইত্যাদি ছোটখাটো প্রায় সব জমিদার হিন্দু। মুসলমান জমিদার নিতান্ত কম। রিপোর্ট প্রকাশের আগে ইংরেজদের পক্ষে কেন প্রকৃত সংখ্যা বোঝা সম্ভব হয়নি, এ-ও তার কারণ।
এর মধ্যেই লক্ষণীয়, ১৮৭২-এর আগে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেনি। প্রথম হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ১৯০৬-০৭’এ ময়মনসিংহে। এর পর অবিভক্ত বাংলায় ১৯১৮ ও ১৯২৬-এর কলকাতা, ১৯২৬ ও ১৯৩০-এর ঢাকা, ১৯২৬-এর পাবনা, ১৯৩০-এর কিশোরগঞ্জ-সহ দীর্ঘ ইতিহাস। অনেকে মনে করেন, ইংরেজরা জনগণনার তথ্যের ভিত্তিতেই ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলা ভাগ হয়েছিল পূর্ব-পশ্চিমে, হিন্দু-মুসলমান উপস্থিতি ভিত্তি করে। তার জোরেই দাঙ্গা ঘটায় অশুভ শক্তি।
তথ্য কী ভাবে অসৎ পথে ব্যবহৃত হয়ে সমাজের ক্ষতি করতে পারে, ১৮৭২-এর সেনসাস তার উদাহরণ। তাই বলে সমাজের উন্নয়নে এর ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। অনেক মিথ্যা ধারণা ভাঙতে পারে তথ্যভান্ডার। আসল কথা যথাযথ ব্যবহার।
১৯৫১-র সেনসাসে দেখা গেল, সামাজিক উন্নয়নের পরিসংখ্যানে একেবারে পিছিয়ে উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ। শোনা গেল, এমনই নাকি হওয়ার কথা, কেননা সেখানে মুসলমান সংখ্যাগুরু। যদিও পল স্ট্রিটেন, অমর্ত্য সেন, মহবুব উল হক প্রমুখের ভাবনা পড়ে বুঝেছি যে, শুধু আয় নয়, মানুষের সার্বিক উন্নয়নে প্রয়োজন আরও কিছু। অন্য দিকে, ‘ওপেন ডেফেকেশন’ বা খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগের হিসাব পশ্চিমবঙ্গে ৩৮.৬ শতাংশ, বাংলাদেশে ৭ শতাংশ, যদিও তারা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে। মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে এর হার যথাক্রমে ৫৮.৭, ৬৬.৫ ও ৭১.৩ শতাংশ। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা, যেমন রাজশাহী (৯.২), নাটোর (৫.৮), চাঁপাই নবাবগঞ্জ (১২.৭), জয়পুরহাট (২০.১), দিনাজপুর (২৩.৪) জাতীয় হিসাবের নিরিখে খুব পিছিয়ে নেই। সামাজিক উন্নয়নে ধর্মের প্রভাবের ধারণা ঠিক তো নয়ই, বিষম ধরনের ভুল। এর প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ।
এমনকি সংখ্যালঘু উপসর্গ দিয়েও বিষয়টাকে বোঝা সহজ নয়। বাংলাদেশে প্রকাশ্য মলত্যাগের সাধারণ হার ১.২ শতাংশ (২০১৭-১৮), এ-দিকে সে দেশের হিন্দুদের মধ্যে ৫.১। আবার এ-পারে সেই হার ২৪.৬ শতাংশ (২০১৫-১৬), মুসলমানদের মধ্যে ২৩.২। বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের পরিষেবার ক্ষেত্রে অন্তত চার প্রকার অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের হার ৪৭ শতাংশ, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৫৪.৬। পশ্চিমবঙ্গে এই হার ৭৬.৪, এ রাজ্যের মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৬৭.৬। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৭৩.৭ শতাংশ, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৫৮। পশ্চিমবঙ্গে তা ৪৭.৯ শতাংশ, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৫১.৪।
তাই, আমাদের রাজ্যে কিছু জেলার পিছিয়ে থাকার কারণ ধৰ্ম বা সংখ্যালঘু উপসর্গ, এমন মোটেই বলা যায় না। কারণটা খুঁজে বার করতে হবে, তবেই হবে উন্নয়ন। ধরে নিচ্ছি, ২০২১ জনগণনা প্রকাশিত হবে। আশা রাখছি, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের কথা ঠিক প্রমাণ করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটাবে তথ্যভান্ডার।