—প্রতীকী ছবি।
অ্যামাজন, মেটা, মাইক্রোসফ্ট, অ্যালফাবেট, অ্যাপল বা ‘মামা’-র মতো তথ্যপ্রযুক্তি জগতের ক্ষমতাবান সংস্থার (যারা মূলত ‘বিগ টেক’ নামে পরিচিত) বিরুদ্ধে লড়াই কোনও নতুন বিষয় নয়। কিন্তু এখন সেই লড়াই এক বিশেষ ক্ষণে পৌঁছেছে বলে মনে হয়। আমেরিকায় অ্যামাজ়ন এবং অ্যালফাবেটের বিরুদ্ধে সম্ভবত দু’টি যুগান্তকারী মামলা চলেছে।
১৯৯৮ সালে মাইক্রোসফ্টের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার পর এত বড় ঘটনা দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে ইউরোপে তিনটি ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপর বিপুল অর্থের জরিমানা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি একটি ‘বৈপ্লবিক’ আইন পাশ করানো হয়েছে এবং এই সপ্তাহেই আর একটি আইন পাশ হয়েছে, যার দ্বারা এই সব সংস্থার তৈরি যন্ত্রে গ্রাহকদের পছন্দ অনুযায়ী অ্যাপ বেছে নেওয়ার ও যন্ত্রগুলিতে আগে থেকে ভরে দেওয়া সফ্টঅয়্যার ডিলিট করার অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে গুগল পে বা অ্যাপল ওয়ালেট আরও বেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতার একচেটিয়া অপব্যবহার, গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্যে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে সংস্থাগুলির উপরে চাপানো জরিমানার পরিমাণ তাদের বাৎসরিক লেনদেনের ১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। চলতি বছরের গ্রীষ্মে ব্রিটেনেও প্রায় একই ধরনের একটি আইন পাশ হয়েছে।
আমেরিকার কংগ্রেসে ‘মামা’ (মেটা, অ্যাপল, মাইক্রোসফ্ট, অ্যামাজন এবং অ্যালফাবেট-কে একত্রে এই নামেই ডাকা হয়)-র সক্রিয় প্রভাবীরা নতুন আইন পাশের বিষয়টিকে আটকে রাখতে পেরেছেন। কিন্তু সে দেশের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস এবং ফেডেরাল ট্রেড কমিশন তাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ধাঁচের মামলা করে সরকারের তরফে ট্রাস্ট-বিরোধী (একচেটিয়া কারবার) আইন প্রণয়নের পরিধিকে বাড়াতে চাইছে। এই প্রচেষ্টা ভোক্তাদের সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যের তুলনায় অবশ্যই সুদূর-প্রসারিত। এই সব পদক্ষেপ কার্যত অভিযুক্তদের প্রতিদ্বন্দ্বী বাণিজ্য সংস্থাগুলির স্বার্থও রক্ষা করে। ইতিমধ্যে ভারতে কম্পিটিশন কমিশন গুগলের বিরুদ্ধে দু’টি মামলায় মোট ২,২৮০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। এবং একটি তৃতীয় মামলার কথাও শোনা যাচ্ছে।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সম্পন্ন উদ্যোগপতিদের পক্ষেও ইন্টারনেটকে একটা নিয়ন্ত্রণহীন, সব পেয়েছির দেশ হিসেবে মনে করে নতুন প্রযুক্তি, ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত এবং অভিনব বাণিজ্য মডেল কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল যুগের উপযোগী ভোক্তা-চাহিদা নির্মাণ ও পূরণ করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বাক্স্বাধীনতা যেমন বিষোদ্গারে পরিণতি পেয়েছে, সমাজমাধ্যম জাতীয় রাজনীতিকে যে ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং যে ভাবে বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপর চিনের প্রভাব আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে, তা দেখে মনে হয় বর্তমান পরিস্থিতি অনিবার্য ভাবে বদলাবে। বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার মধ্যে ভোক্তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যবহার (বা অপব্যবহার)-এর মতো গোপনীয়তা ভঙ্গের বিষয়টিও রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অন্য সংস্থার কাছে এই সব তথ্য বিক্রির অভিযোগও। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, অ্যামাজনের সার্চ রেজাল্টে উঠে আসা প্রথম ১৬ থেকে ২০টি পণ্যই বিজ্ঞাপন। এ সবের বাইরে তাদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ তো রয়েছেই।
এই হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থাই কিন্তু তাদের জনসংযোগ আর ক্ষমতা ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করে। এই কাজে তারা তাদের আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে এস অ্যান্ড পি ৫০০ (স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুয়োর’স ৫০০, আমেরিকার শেয়ার বাজারের একটি সূচক। যার দ্বারা বাজারের তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলির মধ্যে বৃহত্তম ৫০০টি শেয়ারের দরের ওঠানামা নির্ধারিত হয়)-কে অতিক্রম করে লক্ষ কোটি ডলারের মুনাফা করে। সেই মুনাফার পরিমাণ এতটাই যে, বিপুল অঙ্কের জরিমানাও তাদের গায়ে লাগে না। ‘মামা’-র লভ্যাংশ এস অ্যান্ড পি ৫০০-র গড়ের ১০ শতাংশেরও দ্বিগুণ। ক্ষমতার এ হেন অপব্যবহার থেকেই কিন্তু এই বিপুল লভ্যাংশের স্রোত সৃষ্টি হচ্ছে এবং তার পরিমাণও ক্রমে বেড়ে চলেছে।
মোবাইল ফোনে আগে থেকেই গুগলের মতো সংস্থার তরফে সফ্টঅয়্যার বসিয়ে রাখার (এ জন্য অ্যাপলকে বিপুল অঙ্কের ডলার তারা দিয়ে থাকে) মতো বাণিজ্য কৌশল এই মুহূর্তে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক নিষিদ্ধ করে ‘ওয়াল্ড গার্ডেন’ তৈরি, সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের হয় নিশ্চিহ্ন করে বা তাদের কিনে নিয়ে (যে ভাবে মেটা ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ করেছে) এবং নতুন প্রকাশনার সঙ্গে বিজ্ঞাপনের টাকা নিয়ে অন্যায্য সব কাণ্ডও সমালোচকদের নজরে এসেছে। ২০২১-এ অস্ট্রেলিয়া একটি নতুন আইন দ্বারা প্রকাশনা সংস্থাগুলির তরফে অর্থপ্রদানের স্তরকে নির্দিষ্ট করে দেয়। একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা তো অস্ট্রেলিয়া দেশটিকেই ধামাচাপা দিতে উদ্যোগী হয়। পর অবশ্য ব্যাপারটা মিটেছে। কিন্তু এখনও বিষয়টা সেই স্তরে পৌঁছয়নি, যেখানে নীতি নিয়ন্ত্রকরা সংস্থাগুলিকে ছত্রভঙ্গ করতে উদ্যোগী হবেন (১৯৮৪ সালে এটি অ্যান্ড টি-র ক্ষেত্রে তেমনই ঘটেছিল)। কিন্তু প্রয়োজনে তেমন পদক্ষেপও যে করা হতে পারে, সেই মর্মে আইনপ্রণেতারা সাবধানবাণী শুনিয়ে রেখেছেন।
এই আঘাতের বিরুদ্ধে সংস্থাগুলিও প্রবল প্রতিরোধ ও আগ্রাসী ধাঁচে কলকাঠি নাড়ার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও সত্য যে, তারা বিরোধী নীতিগুলির সাপেক্ষে বিভিন্ন এলাকায় তাদের বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনও আনছে। মেটা অ্যাপ-কেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন দিয়ে কিশোর বয়স্কদের পাকড়াও করার নীতি বদলেছে। গুগল তার বিজ্ঞাপন বাণিজ্যে ব্যবহৃত তথ্যের ভাঁড়ারকে আরও বেশি মাত্রায় উন্মুক্ত রেখেছে। টিকটক তার ব্যবহারকারীদের ‘নন-পারসোনালাইজ়্ড ফিড’ বেছে নেওয়ার সুবিধা দিচ্ছে। হয়তো এই পদক্ষেপগুলি যথেষ্ট নয়। তার নিজের প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজস্ব পণ্য বিক্রির ব্যাপারেই অ্যামাজন বাধার সম্মুখীন হতে পারে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ‘থার্ড পার্টি সেলার’দের সঙ্গে তার স্বার্থসংঘাত বাধতে পারে। সামগ্রিক ‘সার্চ এনকোয়্যারি’র ৯০ শতাংশ অ্যাকাউন্ট গুগল বাজেয়াপ্ত করতে পারে। অ্যাপল তার অ্যাপ স্টোরে প্রবেশ সংক্রান্ত নীতি বদলাতেই পারে। এই সমস্ত ভাবনাচিন্তা তখনই করা হচ্ছে, যখন দেখা যাচ্ছে যে, ২০২২-এ তথ্যপ্রযুক্তির বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলি শেয়ারবাজারে ভাল রকমের ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছে। চলতি বছরে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চলছে। ‘মামা’ সংস্থাগুলির মধ্যে চারটি বড় রকমের কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা করেছে। ‘বিগ টেক’দের সঙ্গে যুদ্ধ একটি মাত্র রণাঙ্গনে আর আটকে নেই। এই যুদ্ধের অভিমুখ এখন একাধিক।