টোকিয়োর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক্স একটা ইতিহাস তৈরি করল। কোভিডের কারণে একটু একটু করে সাবধানি পায়ে এগিয়েছে খেলার জগৎ— সুরক্ষাবলয় নীতি মেনে প্রথমে মরুদেশে দর্শকহীন ক্রিকেটের আসর আইপিএল, সম্প্রতি স্টেডিয়ামে দর্শকসমেত ফরাসি ওপেন, উইম্বলডন, ফুটবলে কোপা আমেরিকা ও ইউরো কাপ টুর্নামেন্ট। এই সবই আশা জাগিয়েছে অলিম্পিক্স কর্মকর্তাদের। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো প্রশাসনিক প্রস্তুতি নিয়েছে, প্রশিক্ষণ শিবির, আখড়া বন্ধ থাকায় প্রশিক্ষকের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়াই নির্জনে নিজেদের তৈরি করেছেন বহু ক্রীড়াবিদ। এ বারের অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ তাই আলাদা করেই বিপুল সম্মানের বিষয়, পদক জিতলে তো কথাই নেই।
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে জিউসের উপাসনাস্থল, গ্রিসের অলিম্পিয়ায় শুরু হওয়া উৎসব অলিম্পিক্স নামে পরিচিতি পায়। হত চার বছর অন্তর, প্রধানত পেনট্যাথলন (দৌড়, কুস্তি, বর্শা ও লোহার থালা নিক্ষেপ, উল্লম্ফন) প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীরা আগে থেকে এসে অনুশীলনের সুযোগ পেতেন, থাকত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। ঘোড়দৌড়, মল্লযুদ্ধ, শক্তি প্রদর্শনের নানা খেলা হত। প্রধান শর্ত, খেলা চলাকালীন অংশগ্রহণকারী দেশ বা অঞ্চলগুলোকে যাবতীয় দ্বেষ-হিংসা ভুলে যেতে হবে। অন্তত ক’দিনের জন্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা। অলিম্পিয়ায় আজও রক্ষিত সেই প্রথম দৌড়ের মাঠ, আছে স্টেডিয়াম, অলিম্পিক-মশাল জ্বালানোর প্রস্তরখণ্ড-সহ বহু স্মৃতিসৌধের খণ্ডহর। রোমান সাম্রাজ্য গ্রিসের দখলে এলে এই খেলার বাড়বৃদ্ধি হয়। চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের শেষে বন্ধও হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৮৯৬ সাল থেকে নবরূপে আথেন্সে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। অলিম্পিক্সের প্রতীকে রয়েছে পাঁচ মহাদেশের প্রতিভূ পাঁচটা বলয়। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক্সের দু’বছর পর শীতকালীন অলিম্পিক্স, প্রতিটিই চার বছর অন্তর। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিন বছর অনুষ্ঠিত হয়নি, এ বারেরটা হচ্ছে অতিমারির জন্যে এক বছর দেরিতে। রাজনৈতিক কারণে দু’বছর কিছু দেশ বয়কট করার মতো প্রতিবাদী ঘটনা ছাড়া নির্বিঘ্নেই হয়েছে সব ক’টা আসর। ১৯৬৪-র পর ২০২০-তে অলিম্পিক্সের স্থান নির্বাচিত হয়েছে টোকিয়ো, পাঁচ মহাদেশের ২০৬টি দেশের ১১ হাজারেরও বেশি খেলোয়াড় ৫০টি বিভাগে ৩৩৯টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করছেন। দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে এ বারের আসরে খেলোয়াড়দের মনোবলের প্রশংসা করতেই হয়।
মূল অলিম্পিক্সের পাশে হয় প্যারালিম্পিক্সও, শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্যে। এর গোড়ার ইতিহাসও শতাব্দীপ্রাচীন। ১৮৮৮-র বার্লিনে বধির মানুষদের স্পোর্টস ক্লাব ছিল, জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর সৈনিক ও জনসাধারণ আহত, শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে যান। ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে এক ডাক্তার ক্ষতিগ্রস্ত মেরুদণ্ডের কিছু মানুষের পুনর্বাসনস্থলে আমোদপ্রমোদের জন্যে খেলাধুলার ব্যবস্থা করেন, প্রতিযোগিতারও। এর পর ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিক্স শুরুর দিন ষোলো জন হুইলচেয়ার-ব্যবহারকারী প্রাক্তন সৈনিক তিরন্দাজি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। আনুষ্ঠানিক প্যারালিম্পিক্সের প্রথম আসর বসে ১৯৬০-এ রোমে, ২৩টি দেশের ৪০০ প্রতিযোগীকে নিয়ে। সেই থেকেই প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিক্সের মতো হতে থাকে প্যারালিম্পিক্সও। এর ষোলো বছর পর শুরু শীতকালীন প্যারালিম্পিক্সের। প্যারালিম্পিক্সের উদ্বোধন ও সমাপ্তি অনুষ্ঠানও হয় জাঁকজমক করে। আসলে সমাজের সব রকম মানুষকে নিয়ে খেলাধুলার জমজমাট আসর পরিচালনাই মুখ্য উদ্দেশ্য। অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিক কমিটির যৌথ উদ্যোগে ১৯৮৮ থেকে গ্রীষ্মকালীন ও ১৯৯২ থেকে শীতকালীন অলিম্পিক্সের পরেই, সেই জায়গাতেই অনুষ্ঠিত হতে থাকে প্যারালিম্পিক্স। ক্রমে বৈচিত্র বাড়ে; দৃষ্টিহীন, সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত মানুষেরাও খেলোয়াড়ি দক্ষতায় বিশ্ববাসীর বাহবা পান। এ বছর টোকিয়োয় ২৪ অগস্ট থেকে হবে ষোড়শ প্যারালিম্পিক্স, ৯৮টা দেশের প্রতিনিধিরা ২২টি খেলায় ৫৪০টি ইভেন্টে অংশ নেবেন। প্যারালিম্পিক্সে ভারত ইতিমধ্যেই বিশেষ স্থান অর্জন করেছে।
আলেকজ়ান্ডারের সৈন্যবাহিনী থেকে দলছুট গ্রিকেরা দিল্লির আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করতেন। তাঁদের বংশধররা আর ফেরেননি। জওহরলাল নেহরু স্বাধীন ভারতে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন কর্নাটকের কুর্গে। কুর্গে সেই গ্রিক বংশধরেরা তাঁদের প্রচলিত সংস্কৃতি বজায় রেখেছেন আজও, যার মধ্যে একটা হল প্রতি চার বছর অন্তর খেলাধুলার আসর বসানো। এটাকে ‘মাইক্রো-অলিম্পিক্স’ বলা যায়। এখানেও উদ্বোধন থেকে সমাপ্তি অনুষ্ঠান হয় নিয়ম মেনে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা পরিবারের দায়িত্ব থাকে পরিচালনার, খরচও সবার একত্র। গণতন্ত্র, বন্ধুতা, সম্প্রীতির ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে অলিম্পিক্স। কোভিডও সেই ঐতিহ্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না।