WB Panchayat Election 2023

ভোটের মজা ভারী মজা

যে-ই না শহর ছাড়িয়ে পঞ্চায়েত এলাকায় প্রবেশ, অমনি যত বাড়ির দেওয়াল রঙে রঙে রঙিন। কত সব নাম আর ছাপ দেওয়ালে দেওয়ালে।

Advertisement

গৌতম কুমার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৩ ০৪:৪২
Share:

পঞ্চায়েত ভোটের উত্তাপে গত কিছু দিন টগবগ করে ফুটছে গোটা রাজ্য। কিন্তু এই ভোটের অন্য একটি দিক ছড়িয়ে আছে বাংলার গ্রামে গ্রামান্তরে, থানাপুলিশ থেকে অনেক দূরে। সে দিকটা ভারী মজার দিক।

Advertisement

প্রতিটি দলের বুথ স্তরের নেতাকর্মীরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত! কাকে বোঝাতে হবে, কে একটু গোলমাল করছে, কোন লোকটা কিছু না বুঝে অন্যদের কাছে নিজেদের কথা ফাঁস করে দিচ্ছে, এই সব! এ পাড়ায় ও পাড়ায়, হরিমন্দিরে, মনসামন্দিরে, বাঁধের পাড়ে, পিচরাস্তার ধারে চায়ের দোকানে শুধু ভোটের গল্প। কে কোথায় জিততে পারে, কার হাওয়া ভাল, কে পারবে না, কার টাকার জোর বেশি, কে ভাল কে বদমাশ, কার নিশ্চিত জয়, কার থার্ড পজ়িশন। ফিসফিস আলোচনার মাঝে আগন্তুকের মতো ঢুকে পড়লে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে সবাই চুপ হয়ে যাবে, নয়তো প্রসঙ্গ বদলে ফেলবে। বেশি চালাক যে, সে ঠিক বুঝে নেবে কাদের চর হয়ে এসেছে নবাগত!

যে-ই না শহর ছাড়িয়ে পঞ্চায়েত এলাকায় প্রবেশ, অমনি যত বাড়ির দেওয়াল রঙে রঙে রঙিন। কত সব নাম আর ছাপ দেওয়ালে দেওয়ালে। কত মণ্ডল, বাগদি, বাউরি, খাতুন, আনসারি, মাহাতো, মুদিকড়া, মিশ্র, রায়, মুখার্জি, ব্যানার্জিদের নাম। গ্রামসভা, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ। গ্রামসভায় কোথাও কোথাও দু’টি করে নাম। জোড়া ফুল আর পদ্মফুলের মাঝে কাঁটা হয়ে আছে কাস্তে হাতুড়ি তারা, হাত, সিংহ, কোদাল, বেলচা, এমনকি খাম, আম, কুঁড়েঘর, আরও কত কী!

Advertisement

কিছু আনন্দ থাকে আরও গভীরে। সে আনন্দ পেতে হলে গ্রামের নরনারায়ণের হৃদ-মাঝারে ডুব দিতে হবে। এ আনন্দ নির্মল, উজ্জ্বল, মন ভাল করে দেওয়া। গ্রামের পথে পথে এখন সব দল ঘুরছে, দলে হয়তো দশ-কুড়ি জন ছেলে-ছোকরা। তারা হঠাৎ বাড়িতে আসবে। যে ছেলেটা সারা বছর আপনার সঙ্গে কথাও বলেনি, ঘরে এসে টুক করে প্রণাম করে সে কুশল-সংবাদ নেবে। জানতে চাইবে, কেমন আছেন, কাকিমা কোথায়, দাদাকে দেখছি না যে। উত্তর অবশ্য শুনবে না। কারণ ওরা তো ‘শুনতে’ আসেনি, ‘শোনাতে’ এসেছে। ওরা বুঝিয়ে দেবে কোথায় ভোট দিতে হবে। কেমন করে দিতে হবে। ‘সব’ বুঝিয়ে ওরা দলবদ্ধ ভাবে বেরিয়ে যাবে।

এই হল ‘ডোর টু ডোর’ প্রচার। পরের দিন আর এক দল এসে হাজির। এসেই অন্য দলের নিন্দা করে জানাবে তারা কী কী ভাল কাজ করেছে। পকেট থেকে ‘ফলস ব্যালট’ বার করে কোথায় কেমন করে ভোটটা দিতে হবে সব বুঝিয়ে দেবে।

‘ডোর টু ডোর’ ছাড়াও আছে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দলের নেতা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবেন। রাস্তায় যাকে পাবে তার কাছেই দাঁড়াবেন। খুড়ো, খুড়ি, কাকা, কাকিমা, চাচা, চাচি, মাসি, পিসি, দাদা, ভাইটি এই সব উপযুক্ত আদরের সম্বোধনে তারা কাছে এসে দাঁড়াবে। কিছু খেজুরে আলাপ শেষে বলবে মোক্ষম কথাটি। ভিতরে যা-ই ভাবি না কেন, এ সময় মুখে সম্মতি দিতে হবে।

এ ভাবে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে ঘুরতে ঘুরতে কয়েক দিনের মধ্যেই পোড়খাওয়া নেতাকর্মীরা গ্রামের হাওয়া বুঝে যাবেন। ভোটার লিস্ট বার করে গুনে গুনে ঠিক করে ফেলবেন কে কত পাবেন। হার বুঝতে পারলে প্রচার আরও জোর পাবে। আর জয়ের ব্যাপারে ‘কনফার্ম’ হলে ‘লিড’ বাড়ানোর চেষ্টা হবে। শেষ পর্যন্ত শুরু হবে টাকার খেলা। সে খেলায় সরকারি দলের সঙ্গে অন্যেরা পিছিয়ে পড়বে। তাও এখান সেখান থেকে নিয়ে, এমনকি ধারদেনা করে বিরোধীরাও লড়ে যাবেন। তবে টাকার খেলাটা হতে হবে গোপনে, রাতের অন্ধকারে। লোক-জানাজানি হয়ে গেলে সব গোলমাল হয়ে যেতে পারে। শুধু কি টাকা! লুকিয়ে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘরে ঢুকে এ দল ও দল হাতে করে নিয়ে আসতে পারে ৮০/১০০ টাকা দামের শাড়ি, কিংবা খোকার জন্য গেঞ্জি-প্যান্ট বা আরও অন্য কিছু। দরিদ্র মা-বোনেদের এগুলো উপরি পাওনা। তবে হ্যাঁ, এ সব দিতে অতি সাবধানে আসতে হয়। অন্য দলের লোকেরা রাস্তায় পাহারা দিতে পারে। জানতে পারলেই ঝামেলা, এমনকি থানাপুলিশ।

অনেক মজা আর চাপা উত্তেজনা নিয়ে এ এক বাস্তব থ্রিলার। পঞ্চায়েত ভোটের ভিতরে যারা ঢোকেনি, তারা গ্রামের ভোটের আনন্দই পায়নি। তবে এই ভোটে বড় বড় ঘটনা, রাজনীতির নীতি-আদর্শ এ সব নেই। বড় বড় দুর্নীতি এখানে খুব ছোট ছোট বিষয়। কলকাতার নেতারা সে সব না বুঝেই মাইক ফুঁকে যান। একেবারে ছোট স্তরে কে ভাল কে মন্দ, কাকে পাওয়া যায়, কাকে পাওয়া যায় না, এগুলোই এখানে বড় বিষয়। হিংসা দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের এই মজাটা বন্ধ না করে দিলে শেষ পর্যন্ত কিন্তু রাজনীতিরই লাভ ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement