সংবাদে প্রকাশ, কালীপুজোর পর দশ দিন পেরিয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি চাঁদার জুলুম। ভাতের হোটেলের কাছে দাবি করা হয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। পাঁচ হাজার টাকা পেয়ে অখুশি পুজোকর্তা বাবা ও ছেলে হোটেলে এসে মালিক দম্পতিকে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গিয়েছেন, এমনই অভিযোগ। খাস কলকাতায়। অবশ্য এ নতুন বা অভিনব কিছু নয়। ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, এ রাজ্যের নানা স্থানে অহরহ এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিগৃহীত হয়েছেন বা রুটি-রুজি হারিয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য, বারোয়ারি পুজো, যাকে এখন অনেক ক্ষেত্রে ‘সর্বজনীন’ বলা হচ্ছে, তার আয়োজন এবং সেই উপলক্ষে চাঁদা সংগ্রহের বিষয়টি হঠাৎ বা নতুন আমদানি হয়নি। বারোয়ারি পুজোর পরম্পরা এ দেশে তথা অবিভক্ত বাংলায় বেশ পুরনো। ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় বারো জন বন্ধু (মতান্তরে ব্রাহ্মণ) মিলে যে পুজোর সূচনা করেন, পরবর্তী কালে সেটাই নাকি বারোয়ারি পুজো হিসেবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তবে প্রথম বারোয়ারি পুজোর জন্যে চাঁদা তোলা হয়েছিল শুধু প্রতিবেশীদের থেকে। পরবর্তী কালে জমিদার বা ধনী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের উদ্যোগে এ ধরনের পুজোর আয়োজন হয়েছে, তার জন্য চাঁদাও তোলা হয়েছে।
কিন্তু যেটা নতুন তা হল, আমাদের রাজ্যে যত দিন যাচ্ছে, ততই দুর্গাপুজো-সহ অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। পঞ্জিকার নির্ঘণ্ট অনুযায়ী পুজো যখন, তার বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই উদ্বোধনের ধুম, তাতে নেতা মন্ত্রী থেকে সমাজের নানা ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের সক্রিয় অংশগ্রহণ, এবং বিসর্জনের শোভাযাত্রা বা তথাকথিত কার্নিভাল, এই সমগ্র পর্বটি চার দিনের জায়গায় আট-দশ দিন ধরে চলছে।
অনুষ্ঠান ধর্মীয় কিংবা সামাজিক যে রকমই হোক না, তার মেয়াদ বাড়লে যে সরল পাটিগণিতের হিসাবে খরচও বাড়ে, সে বিষয়ে সংশয়-সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। অবশ্য তাতেও আপত্তির কিছু থাকত না, যদি উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যয়ে এবং জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে এ ধরনের সর্বজনীন উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন।
কিন্তু ঘটনা হল, উৎসবের অনুষ্ঠান কত দিন চলবে, প্যান্ডেল, লাইট, মাইক, জলসার শিল্পী, বিসর্জনের আড়ম্বর, এক কথায় এর প্রতিটি খুঁটিনাটি কী রকম হবে সেই বিষয়ে পুজো কমিটি নিজেরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও এ সবের খরচ জোগাতে বাধ্য করা হয় এমন অনেক মানুষকে, ওই সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যাঁদের কোনও ভূমিকা নেই।
কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে দুর্গাপুজোয় অনুদান প্রদান শুরু হওয়ার সময় আশা করা হয়েছিল, এর পর থেকে চাঁদার জুলুম হয়তো কিছুটা কম হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে এর ঠিক বিপরীত। সরকারি সাহায্য পাওয়ার পরেও পুজোর উদ্যোক্তারা অনিচ্ছুকদের ভীতি প্রদর্শন কিংবা বল প্রয়োগ করে চাঁদা আদায় বন্ধ তো করেনইনি, উপরন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর ব্যাপ্তি এবং প্রাবল্য বেড়েছে। উদ্যোক্তাদের অনেকেরই দাবি, অনুদান প্রদানের মাধ্যমে যে উৎসবকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তার জন্যে দাবিমতো চাঁদা দেওয়াটা নাগরিক কর্তব্য তো বটেই, তা অস্বীকার করাটা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রকেই অসম্মান করা!
আর একটা ভাবার বিষয় হল, উৎসবের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ শুধুমাত্র চাঁদার জুলুমের মধ্যেই সীমিত না থাকা। দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে অন্যান্য পুজো এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতা মহানগরে তো বটেই, শহরতলিতেও প্রকাশ্য রাজপথ দখল করে যত্রতত্র যে সব প্যান্ডেল তৈরি করা হয়, সেগুলির জন্যে উৎসবের আগে এবং পরে একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমনও দেখা যাচ্ছে যে, দুর্গোৎসব সম্পন্ন হওয়ার পরেও রাস্তাজোড়া প্যান্ডেল হোর্ডিং ব্যানার ইত্যাদি সরিয়ে নিতে দেরি বা গড়িমসি করা হচ্ছে।
আবার অনেক উদ্যোক্তাই দুর্গাপুজোর বিরাট প্যান্ডেলটি লক্ষ্মীপুজো, এমনকি কালীপুজো পর্যন্তও রেখে দিচ্ছেন।
অধিকাংশ পুজো কমিটির সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মী তথা প্রভাবশালী মানুষদের প্রত্যক্ষ যোগ থাকায় এক দিকে যেমন চরম অসুবিধার মধ্যে দিন যাপন করতে হলেও সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদ করতে সাহস করেন না, অন্য দিকে ওই একই কারণে পুজোর প্যান্ডেল ও জমে-ওঠা আবর্জনা দ্রুত অপসারণের ব্যাপারে প্রশাসনকেও তেমন তৎপর হতে দেখা যায় না।
পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিজের মত ও বিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিটি মানুষেরই ধর্মাচরণের অধিকার সংবিধান-স্বীকৃত। এতে জাতপাত, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অংশগ্রহণ করতেই পারেন। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, যাঁরা সেটির শরিক নন, তাঁদের চাঁদা দিতে বাধ্য করা কিংবা তাঁদের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা নিশ্চয়ই অনৈতিক এবং অনভিপ্রেত। এমনকি এই উৎসবে অংশগ্রহণ করলেও পুজোর আড়ম্বর এবং সম্ভাব্য ব্যয়ভার নির্ধারণে যাঁদের কোনও ভূমিকা থাকে না, তাঁরা কোন পুজোয় কত চাঁদা দেবেন কিংবা আদৌ দেবেন কি না সেটা স্থির করার স্বাধীনতা, এবং প্রতিবন্ধকতাহীন প্রাত্যহিক জীবন-জীবিকাও তাঁদের ন্যায্য অধিকার। সংখ্যালঘু হলেও এই নাগরিকদের এই সব অধিকার রক্ষার দায় কিন্তু রাষ্ট্রেরই।
বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের দপ্তর-এর ‘আমার মন’ অংশে লিখেছিলেন, “পূজা কর, ক্ষতি নাই, কিন্তু আমাকে গোটাকতক কথা বুঝাইয়া দাও। তোমার বাহ্য সম্পদে কয় জন অভদ্র ভদ্র হইয়াছে? কয় জন অশিষ্ট শিষ্ট হইয়াছে? কয় জন অধার্ম্মিক ধার্ম্মিক হইয়াছে? কয়জন অপবিত্র পবিত্র হইয়াছে? এক জনও না? যদি নাই হইয়া থাকে, তবে তোমার এই ছাই আমরা চাহি না— আমি হুকুম দিতেছি, এ ছাই ভারতবর্ষ হইতে উঠাইয়া দাও।”
আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে পুজোর বাহুল্যের যৌক্তিকতা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের এই মত কি আজও প্রাসঙ্গিক নয়? যদি পুজো বাদ দিয়ে শুধু উৎসবের কথাও ধরা হয় এবং সেটি ‘সর্বজনীন’ বলে দাবি করা হয়, তা হলেও সকলকে আনন্দ দেওয়ার মধ্যেই তার সার্থকতা। কারও চোখের জলে যাতে সে উৎসব বিষাদে পরিণত না হয়, তা দেখার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়, সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও।