চাষ করতে গেলে প্রথমেই লাগে বীজ। আর সেখান থেকেই মাথা তোলে অনিশ্চয়তার অঙ্কুর। মন্তেশ্বরের নন্তু দাঁ বড় চাষি, গত বর্ষায় ৫২ বিঘেতে ধান চাষ করেছিলেন নামী এক কোম্পানির বীজে। ধরা যাক, কোম্পানির নাম ‘কৃষ্ণা-গোদাবরী’। নভেম্বরে দেখেন, ৮০ শতাংশ ধানের শিষ শূন্য, চাল আসেনি।
বৃষ্টি হয়েছিল ভাল, রোগপোকা লাগেনি, জল-সারে কার্পণ্য করার লোক নন নন্তুবাবু। বুঝলেন, এ বীজের দোষ। ব্লক, জেলা থেকে শুরু করে ছ’জন কৃষি অধিকর্তাকে বিশদ বিবরণ দিয়ে অভিযোগ পাঠালেন। কাজ হল। সহ কৃষি-অধিকর্তা সাহেব নিজে গাড়ি নিয়ে এসে জমিতে ঘুরে দেখে গেলেন। পরামর্শ দিলেন, কোম্পানির সঙ্গে মিটিয়ে নিন। ‘কৃষ্ণা-গোদাবরী’ বিঘে প্রতি হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিল নন্তুবাবুকে, সেই সঙ্গে শীতের ধান চাষের বীজ দিল। তবে প্রবীণ চাষি আরও তৃপ্ত এই জন্য যে, কোম্পানির লোকেরা তাঁর কাছে একান্তে স্বীকার করেছে, দোষটা বীজেরই ছিল। পরাগ মিলনের সময়ে ঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি।
কিন্তু বাকি চাষিরা? মন্তেশ্বর, ভাতার, গলসির বেশ কিছু চাষি সে বছর চালহীন ধানের শিষ দেখে ভেঙে পড়েছিলেন। লকডাউনের জেরে কাজ হারিয়ে তখন বহু মানুষ ফিরেছেন গ্রামে— চাষই ভরসা। শূন্যগর্ভ শিষ তাঁদের বিপন্নতা বাড়িয়েছিল। জেলার এক কৃষি আধিকারিক জানালেন, একটি বিশেষ হাইব্রিড ধানবীজ চাষ করার ফলে এমন ঘটেছিল। যে ক’জন চাষি সরব হয়েছিলেন, তাঁদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে মিটিয়ে নেওয়া হয়েছে বিষয়টা।
“যাঁরা চাপ দিয়ে আদায় করতে পারেন, কেবল সেই চাষিরাই খারাপ বীজের ক্ষতিপূরণ পান,” বললেন পার্থ দাশগুপ্ত। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন অধ্যাপক জানালেন, ভারতে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার বীজের ব্যবসা চলে, কিন্তু বীজের মান মন্দ হলে চাষির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনও আইনি পরিকাঠামো নেই। আমেরিকায় এই ধরনের নালিশের জন্য নির্দিষ্ট আদালত রয়েছে, আলাদা আইনও রয়েছে। এ দেশে ১৯৬৬ সালে তৈরি হয় বীজ আইন, আজ অবধি সেই আইনে কোনও পরিবর্তন আসেনি। ফলে চাষিকে ফৌজদারি আইনের ৪২০ ধারার অধীনে মামলা করতে হবে, না হলে যেতে হবে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে। বীজের জন্যই যে ফসল মার খেয়েছে, আবহাওয়া বা চাষের পদ্ধতির জন্য নয়, তা প্রতিষ্ঠা করা চাষির পক্ষে কঠিন। বিচারকরাও এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। পৃথক আদালত না থাকার এই হল অসুবিধে।
আর আইন না থাকার অসুবিধে হল, ক্রেতা আদালত কেবল বীজের প্যাকেটের দাম ফেরত দিতে বলবে, না কি চাষের সম্পূর্ণ খরচের, অথবা আংশিক খরচের, তার কোনও নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। “আমেরিকার আদালতে দেখা যায়, ফসল ফললে চাষির যা আয় হত, ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয় তার চাইতেও অনেকটা বেশি,” বললেন পার্থবাবু। বীজের জন্য ফসল মার খেলে চাষি কী পাবেন, শেষ অবধি তা নির্ভর করে কোম্পানির সুনাম রক্ষার তাগিদ কতটা, তার উপর।
চাষির স্বার্থরক্ষায় কে কত তৎপর, তার কত না লড়াই হল বাংলার নির্বাচনী প্রচারে। তার সবটাই কে কত অনুদান দিল, তার অঙ্কে। সরকারের যা কাজ, আইনি পরিকাঠামো তৈরি, তা হচ্ছে কই? অথচ বীজই দেখিয়ে দেয়, তার প্রয়োজন কতটা।
প্রথম সমস্যা, বীজের বাজারের অনেকটাই এখনও অসংগঠিত। কৃষি দফতর সূত্রে খবর, পশ্চিমবঙ্গে এখনও ৪০-৫০ শতাংশ চাষি বাড়ির বীজ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, প্যাকেটের বীজ ব্যবহারকারীর সংখ্যা আগের চাইতে অনেক বেশি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। অন্তত ২০ শতাংশ বেশি উৎপাদন হয় প্যাকেটের বীজে। কিন্তু চাষে লাভ এতই কমে আসছে যে, ঘরের পয়সা দিয়ে দামি বীজ কেনার সাধ্য বা আগ্রহ আর নেই অনেক চাষির।
চাষিকে অল্প খরচে ভাল বীজ দেওয়ার একটা উপায় ছিল, ‘বীজ গ্রাম’ তৈরি করা। এই লক্ষ্য স্থির করা হয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে গৃহীত বীজ নীতিতে (২০০২)। পশ্চিমবঙ্গে তার দৃষ্টান্ত গোটরা কৃষি সমবায়। নদিয়াতে চারটি গ্রামের চাষিদের নিয়ে এই সমবায় বীজ তৈরির কাজ শুরু করেছিল ১৯৯৭ সালে। “শুরু করি আমরা ২০ জন চাষি। টার্গেট ছিল ২১ টন ধানবীজ,” বললেন ওই সমবায়ের সঙ্গে যুক্ত রামপ্রসাদ বিশ্বাস। আজ ৪৫০ চাষি কাজ করেন, ১৫০০ টন ধানবীজ উৎপন্ন হয়। তা ছাড়াও সর্ষে, তিল, আলু, নানা ডালের বীজ তৈরি হয়, বিক্রি হয় সারা রাজ্যে। বাজারে ধানের যা দাম, ধানের বীজ তার থেকে ২০-৩০ শতাংশ বেশি দামে চাষির থেকে কিনে নেয় সমবায়। এ ভাবে বীজ উৎপাদন হতে পারত চাষির সমস্যার আদর্শ সমাধান। আক্ষেপ, বর্তমানে ১৫-১৬টার বেশি বীজ উৎপাদক সমবায় নেই। দলীয় রাজনীতি কখনওই পশ্চিমবঙ্গের কৃষি সমবায়কে স্বতন্ত্র, সজীব, বাজারমুখী, চাষিবন্ধু হয়ে উঠতে দেয়নি। সঙ্কীর্ণতা আর দুর্নীতির আখড়া হয়েই রয়ে গিয়েছে। এই হল দ্বিতীয় সমস্যা।
তৃতীয় সমস্যা, প্রাইভেট কোম্পানির বীজের মান। কতটা নির্ভরযোগ্য বীজ, তা বোঝার একটা উপায় সরকারি শংসাপত্র। মুশকিল হল, ‘সার্টিফায়েড বীজ’ বাজারের বড় জোর অর্ধেক। তার বাইরে নানা ধরনের বীজ তৈরি করে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো, নতুন নতুন গুণাবলির দাবি নিয়ে। সেখানে নিয়ম হল, ‘ট্রুথফুলি লেবেলড সিডস’ বাজারে আনা। উৎপাদক কোম্পানি নিজেই জানাবে বীজের গুণাগুণ— কত শতাংশ অঙ্কুরিত হবে, কতটা জিনগত শুদ্ধতা, ইত্যাদি। সরকারি ‘সিড ইনস্পেক্টর’ বীজের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবে তেমন নজরদারি হয় না বললেই চলে। ভারতে বীজের বেসরকারি বাজার পনেরো হাজার কোটি টাকার, কিন্তু মান অনিয়ন্ত্রিত।
নজরদারির শিথিলতার সুযোগে বীজের নানা গুণের উনিশ-বিশ করে তা ‘নতুন বীজ’ বলে বাজারে আনছে কোম্পানিগুলো। ডিলাররা ‘পুশ সেল’ করছে, চাষি আশায় আশায় কিনছেন। বহু বাজারচলতি বীজের ব্র্যান্ড রয়েছে, যেগুলো পরীক্ষা হলে কখনও ‘নতুন প্রজাতি’ হিসেবে সরকারি শংসাপত্র পাবে না, জানালেন এক কৃষি আধিকারিক।
অভাব পরিকাঠামোতেও। হাইব্রিড বীজের সার্টিফিকেশন করার মতো পরিকাঠামো নেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্যে। অথচ, ভুট্টা এবং প্রায় সমস্ত আনাজ আজ হাইব্রিড বীজ থেকে তৈরি হয়। চাষি কেবলমাত্র কোম্পানির সততার উপর নির্ভরশীল।
চাষির প্রতারিত হওয়া আটকানোর উপায়, আইন করে বাজারে প্রাপ্ত সমস্ত বীজের প্রজাতিকে তার গুণাবলির বৃত্তান্ত-সহ নথিভুক্ত করাকে আবশ্যক করা। নথিভুক্ত (রেজিস্ট্রেশন) করাতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে, বীজ উৎপাদক যা দাবি করছেন তা সত্য কি না। এই সংশোধনী প্রস্তাব দীর্ঘ দিন পড়ে রয়েছে সংসদে। তিন বিতর্কিত কৃষি আইন তড়িঘড়ি পাশ হয়ে গেল, বীজ আইন সংশোধিত হল না আজও। (অ)রাজনীতি ঢুকে বসে আছে বীজে। চাষের দাবি না মিটিয়ে চাষির ভোট চায় সব দল।