—ফাইল চিত্র।
একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম টেলিভিশনে, দিনকয়েক আগে। এক অশীতিপর বৃদ্ধা প্রায় নুয়ে পড়া শরীরকে শক্ত করে ছাদ থেকে আকাশে জাতীয় পতাকা তুলে ধরছেন। সদ্য হাড় ভাঙা সত্ত্বেও গত বার এ ভাবেই পতাকা উড়িয়েছিলেন এবং জিতেছিলেন, এই ঘোষণায় ছোটরা উল্লাসে হাততালি দিয়ে উঠল। বৃদ্ধার তোবড়ানো গাল অসামান্য হাসিতে উজ্জ্বল। তার পরেই ভারত আর পাকিস্তানের দু’জন ক্রিকেটারের আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ছবি। সঙ্গে লেখা, ‘সেরা শত্রুতা’। এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের বিরদ্ধে খেলবে, তারই বিজ্ঞাপন।
একটা ক্রিকেট ম্যাচের সঙ্গে ‘শত্রুতা’ শব্দটার ব্যবহার কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? শত্রুতা থাকতেই পারে দুটো দেশ পরিচালনার রাজনীতির মধ্যে, সীমান্ত সংঘাতে, পারস্পরিক চুক্তি লঙ্ঘনের মধ্যে, বা অন্য আরও কোনও বিষয়ে। কিন্তু খেলার মাঠ কি তার অঙ্গীভূত হতে পারে বা হওয়া উচিত? তা কি খেলার মূল ধর্মেরই পরিপন্থী নয়? ক্রিকেট মাঠে পাকিস্তানকে হারালে ভারতীয়রা যতটা খুশি হয়, নিউ জ়িল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কা বা ইংল্যান্ডকে হারালে কি তার চেয়ে কম খুশি হওয়ার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে? বরং কেউ বলতেই পারেন, যে ইংল্যান্ড ১৯০ বছর ধরে আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল, যারা মহামূল্যবান কোহিনুর-সহ ভারতের অজস্র ধনসম্পদ লুট করেছে, ধ্বংস করেছে ভারতের অর্থনীতিকে, যারা এক দিন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেও ভাগ করে যাওয়া দুটো দেশেই অস্ত্রের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কূটনীতিকে ব্যবহার করেছে সাফল্যের সঙ্গে— খেলার মাঠে যদি আদৌ শত্রুতার অবকাশ থাকে, তবে তা তো থাকা উচিত ইংল্যান্ডের সঙ্গে। কিন্তু ইংল্যান্ডের সঙ্গে খেলার আগে বা জেতার পরে এমন বিজ্ঞাপন তো দেখা যায় না কখনও।
তা হলে কি এই বিজ্ঞাপনটা শুধু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বা ভারতের জাতীয় পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়, এই দুটো বিষয়কে সামনে রেখে আরও গভীর কোনও অর্থ বা বোধ গড়ে তোলার জন্য নির্মিত? যখন এক আধাসেনা কর্মী ট্রেনের কামরায় বেছে বেছে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের যাত্রীদের গুলি করে খুন করে আর ঠান্ডা মাথায় দেশের দুই রাজনৈতিক নেতার নামে জয়ধ্বনি দেয়, যখন দেশের বৃহত্তম জনসংখ্যার রাজ্যের কোনও এক স্কুলে শিক্ষিকার নির্দেশে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের এক সহপাঠী ছাত্রকে ক্লাসের অপর ছাত্রছাত্রীরা পর পর এসে চড় মেরে যায়, তখন এটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না যে, ঘৃণার চাষ একটা উদগ্র মাত্রা অর্জন করেছে। এই ঘৃণার ব্যাপ্তি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবৃত্তের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ব্যক্তিচৈতন্যকে প্রভাবিত করে। হয়তো সে জন্যই পুলওয়ামা হয়, বিজ্ঞানের জয়কে শিবশক্তি গ্রাস করে নেয়, অরুণাচল চিনের মানচিত্রে ঢুকে গেলেও নিরুত্তেজ থাকা যায়।
ক’দিন আগেই জ্যাভেলিন থ্রো-তে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেন নীরজ চোপড়া। রুপো জিতলেন পাকিস্তানের আরশাদ নাদিম। খেলাশেষে নাদিম প্রকাশ্যেই নীরজকে তাঁর রোল মডেল বলেছেন, ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ছবি তোলার সময় নাদিম যখন নিজের দেশের জাতীয় পতাকা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন নীরজ তাঁকে ডেকে নিয়েছেন, এবং নাদিমও হাসি মুখে ভারতের জাতীয় পতাকার নীচে দাঁড়িয়েই নীরজের পাশে ছবি তুলেছেন (ছবিতে)। অর্থাৎ, প্রতিদ্বন্দ্বীর দেশ পাকিস্তান হলেও যে শত্রুতা ব্যতিরেকেই খেলা চলতে পারে, তার উদাহরণ চোখের সামনেই রয়েছে। প্রশ্ন হল, ঘৃণার বাজারে যে এই ভালবাসার দোকানও খোলা আছে, সে খবর প্রকাশ করবে কে? এক সাংবাদিক নীরজের মা-কে প্রশ্ন করেছিলেন, পাকিস্তানি খেলোয়াড়কে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে আপনার ছেলে, আপনার কেমন লাগছে? সাংবাদিক হয়তো ভেবেছিলেন জয়ের উচ্ছ্বাসকে ছাপিয়ে উঠবে বিদ্বেষ, আনন্দকে গ্রাস করে নেবে ঘৃণা, হটকেকের মতো লোকের মুখে মুখে ঘুরবে তাঁর রিপোর্টের শৈলী। নীরজের মা সরোজ দেবীর উত্তরটা এত দিনে অনেকেই জেনে গিয়েছেন, তবু আরও এক বার বলা যাক— তিনি বললেন, প্রতিযোগিতা হয়েছে দু’জন অ্যাথলিটের মধ্যে। হরিয়ানা বা ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে না। প্রতিযোগিতা যখন হয় কেউ জেতে আর কেউ হারে। দুটোই খেলার অঙ্গ। আর খেলা তো ভালবাসার বিস্তার ঘটায়। নীরজ জেতায় খুশি হয়েছি ঠিক, কিন্তু ওর প্রতিদ্বন্দ্বী জিতলেও অখুশি হতাম না।
সরোজ দেবীর এই কথাগুলোর পাশে ওই বিজ্ঞাপনটাকে রাখতে গিয়ে অস্বস্তি হয়। স্পোর্টসম্যান স্পিরিট শব্দটা কি হারিয়ে যাবে খেলার জগৎ থেকে? সহজাত ভালবাসা দিয়ে ফুটবল মাঠের নব্বই মিনিট বা ক্রিকেট মাঠের পঞ্চাশ বা কুড়ি ওভারকে দেখতে পারব না আমরা? সেই সময়টুকুও চিহ্নিত হয়ে যাবে শত্রুতার অঙ্কে? তাতে কার ভাল হবে? খেলার, যোগদানকারী খেলোয়াড়দের, দেশের না বহমান ঘৃণার লাভাস্রোতের?