—ফাইল চিত্র।
দু’এক বছর আগের কথা। দিল্লির চব্বিশ নম্বর আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরে অনগ্রসর শ্রেণি নিয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। গোটা দেশের প্রদেশ কংগ্রেসের ওবিসি শাখার প্রতিনিধিরা হাজির। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কে এসেছেন? দেখা গেল, ওবিসি সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসাবে যাঁকে পাঠানো হয়েছে, তিনি খাঁটি ব্রাহ্মণ!
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সাংগঠনিক অবস্থা নাহয় একটু বেশিই খারাপ। বাকি রাজ্যেও কি কংগ্রেস অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি ভোটারদের নিয়ে এত দিন বিশেষ মাথা ঘামিয়েছে? না। এ দেশের জনসংখ্যার আনুমানিক অর্ধেক মানুষ বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণি-ভুক্ত। অথচ কংগ্রেস কোনও দিনই এই ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কোনও দিনই তারা ওবিসি-দের দল ছিল না। রাজ্য স্তরে কংগ্রেসের এই মুহূর্তে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ওবিসি নেতা উঠে এসেছেন। যেমন, রাজস্থানের অশোক গহলৌত, কর্নাটকে সিদ্দারামাইয়া, ছত্তীসগঢ়ে ভূপেশ বাঘেল। রাহুল গান্ধী তাই গর্ব করে বলতে পারেন, চার কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মধ্যে তিন জন মুখ্যমন্ত্রীই ওবিসি নেতা। কিন্তু বাস্তব হল, জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের এখনও বড় মাপের ওবিসি নেতা নেই।
বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। মণ্ডল কমিশন সরকারি চাকরি এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিল। বিশ্বনাথ প্রতাপ শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে ওবিসি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে তাঁর সরকার বেশি দিন টেকেনি। কংগ্রেসের পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সরকার সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে, সরকারি চাকরিতে ওবিসি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসি সংরক্ষণের ব্যবস্থাও কংগ্রেসের মনমোহন সিংহের সরকারের আমলে। ২০০৬ সালে। কিন্তু কংগ্রেস কোনও দিনই ওবিসি সংরক্ষণের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। উল্টে ওবিসি রাজনীতির হাত ধরে উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিংহ যাদব, বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমাররা ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক ঝোলায় পুরেছেন। ঠিক সেই কারণেই কংগ্রেস মণ্ডল কমিশনের পরে আর কখনও একার জোরে কেন্দ্রে সরকার গড়তে পারেনি।
গত তিন দশকে বিজেপি শুধু ব্রাহ্মণ-বানিয়াদের দল পরিচিতি থেকে বেরিয়ে ওবিসি-দেরও ছাতার তলায় নিয়ে এসেছে। ২০১৪ সালে কংগ্রেস যখন লোকসভা নির্বাচনের ময়দানে নামছে, সে সময় মনমোহন সরকারে মাত্র এক জন ওবিসি মন্ত্রী ছিলেন। আজ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে ওবিসি। তাঁর মন্ত্রিসভায় ২৭ জন ওবিসি নেতা। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হওয়ার পরে ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে ওবিসি-দের ১৯ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। গত লোকসভা নির্বাচনে, ২০১৯-এ বিজেপি ব্রাহ্মণ-বানিয়া উচ্চবর্ণের ভোট ধরে রেখেও ওবিসি-দের ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। উল্টো দিকে কংগ্রেসের ওবিসি ভোট শতকরা ২৫ থেকে ১৫-য় নেমেছে।
এই পরিস্থিতিতে রাহুল গান্ধী জাতগণনার দাবি তুলেছেন। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সময়ই তিনি প্রথম ‘জিতনি আবাদি, উতনা হক’-এর স্লোগান তুলেছিলেন। অর্থাৎ, যার যত জনসংখ্যা, তার তত অধিকার। রাহুল বলছেন, জাতগণনা হলে সমাজের এক্স-রে রিপোর্ট মিলবে। উচ্চবর্ণ, তফসিলি জাতি, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণি, কার হাতে কত সম্পদ, কারা কতখানি জমির মালিক, সরকারি চাকরিতে কার কত উপস্থিতি, কে কতখানি উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে, সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। জাতপাত নিয়ে এত দিনের নীরবতা ভেঙে কংগ্রেস বিজেপির হিন্দুত্বের মোকাবিলায় দ্বিতীয় মণ্ডল রাজনীতি শুরু করতে চাইছে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে জাতীয় স্তরেও জাতগণনা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন রাহুল।
প্রশ্ন হল, ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল গান্ধী যে সমাজের বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়ে চলার বার্তা দিয়েছিলেন, তিনি নিজেই কি জাতপাতের কথা বলে তাতে জল ঢালতে চলেছেন? কংগ্রেসের চিরাচরিত কৌশল হল, দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, কৃষকদের সমস্যা নিয়ে ভোটের কৌশল তৈরি করা। ২০০৪ সালে ‘কংগ্রেস কা হাত, আম আদমি কে সাথ’ স্লোগান দিয়েই কংগ্রেস ইউপিএ-সরকার গড়ে ক্ষমতায় এসেছিল। রাহুল গান্ধীকে কি এখন নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ যাদবরা নিজেদের সঙ্কীর্ণ জাতপাতের রাজনীতির পথে চালিত করছেন? না কি কংগ্রেসের পুরনো উচ্চবর্ণ ও দলিত ভোটব্যাঙ্ক দলকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বলে রাহুল গান্ধী ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক দিয়ে সেই অভাব পূরণ করতে পারবেন?
প্রশ্নগুলো কঠিন। উত্তরও অজানা। রাহুল গান্ধীর ‘জিতনি আবাদি, উতনা হক’-এর সূত্র মানলে ওবিসি-দের জনসংখ্যায় ভাগ যদি ৫০ শতাংশের বেশি হয়, তা হলে ওবিসি-দের জন্য ৫০ শতাংশের বেশি আসন সংরক্ষণ করতে হবে। তাতে সরকারি চাকরি বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেনারেল ক্যাটেগরির জন্য নির্ধারিত আসন কমবে। বিজেপি সেই কারণেই জাতগণনার পক্ষে নয়। জাতগণনার দাবি তোলা কংগ্রেসের উপরেও তার কোপ পড়তে পারে।
কর্নাটকে ওবিসি নেতা সিদ্দারামাইয়াকে সামনে রেখে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে। ছত্তীসগঢ়ে ভূপেশ বাঘেলের মতো ওবিসি নেতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। রাহুল গান্ধী হয়তো ভাবছেন, জাতগণনার দাবি তুললে হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস লাভবান হবে। বিহারে নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ যাদব, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবরা লাভবান হলেও তাতে সামগ্রিক ভাবে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া লাভবান হবে। রাহুল চাইছেন, বিজেপি যে উচ্চবর্ণ ও ওবিসি-র মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে, তা নষ্ট করে দিতে।
মুশকিল হল, ১৯৯০-তে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হওয়ার ফলে লালু-মুলায়মরা যে ভাবে লাভবান হয়েছিলেন, এখন তাঁদের উত্তরসূরি অখিলেশ-তেজস্বীরা একই ভাবে জাতগণনার সুফল তুলতে পারবেন, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক। কিন্তু হরিয়ানা, পঞ্জাব, দিল্লি, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ বা জম্মু-কাশ্মীরে ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক নির্ণায়ক ভূমিকা নেয় না। সর্বোপরি এখন ওবিসি-দের মধ্যেও যারা সব থেকে বেশি অনগ্রসর বা অতি পিছড়ে বর্গ, তারা ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা পায়নি বলে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। তার ভিত্তিতে উত্তরপ্রদেশে রাজভড়, কুড়মি, বিহারে মুসাহার, কুশাওয়াহা, মাল্লা, দুসধদের আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে। জাতগণনায় যদি দেখা যায়, ওবিসি-দের মধ্যে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধা পায়নি, তা হলে তারা পৃথক সংরক্ষণের দাবি তুলবে। তখন ওবিসি রাজনীতির সমীকরণও বদলে যেতে পারে। রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসকে ‘জিতনি আবাদি, উতনা হক’-এর নীতি মেনে সেই অতি পিছড়ে বর্গের জন্য সংরক্ষণ নিয়েও অবস্থান নিতে হবে।
এ দেশে প্রথম অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন কোলাপুরের শাসক শাহু মহারাজ। আজ থেকে একশো বিশ বছরেরও আগে শাহু মহারাজ তাঁর রাজত্বে চাকরির ৫০ শতাংশ অনগ্রসরদের জন্য সংরক্ষণের ঘোষণা করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জওহরলাল নেহরু ১৯৫৩ সালে অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন তৈরি করিয়েছিলেন। ২,৩৯৯টি সম্প্রদায়কে অনগ্রসর বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু নেহরু সেই রিপোর্ট কার্যকর করেননি। মোরারজি দেশাইয়ের আমলে ১৯৭৯ সালে বি পি মণ্ডল কমিশন তৈরি হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী দু’বার সেই কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু মণ্ডল কমিশন সরকারি চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুপারিশ করলেও তার রিপোর্ট হিমঘরেই পড়ে ছিল। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ যখন মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তখন লোকসভাতেই তার ঘোর বিরোধিতা করেন রাজীব গান্ধী।
সময়ের ফেরে রাজীব গান্ধীর পুত্রই এখন জাতগণনার ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবি তুলছেন। তাতে কংগ্রেসের ক্ষমতায় ফেরার রাস্তা তৈরি হবে কি না, সেই উত্তরও সময়ই দেবে।