পরিকল্পনা: বিজেপির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির বৈঠকে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, দিল্লি। ছবি: পিটিআই।
বাবুল সুপ্রিয়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, নিশীথ প্রামাণিক ও জগন্নাথ সরকার। পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি এই চার লোকসভা সাংসদকে প্রার্থী করেছিল। বাবুল ও লকেট হেরে যান। নিশীথ ও জগন্নাথ জিতেছিলেন। অথচ বিধায়ক হিসাবে শপথ নেওয়ার বদলে তাঁরা বিধানসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে সাংসদ হিসাবেই থেকে যান। বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বের তেমনই নির্দেশ ছিল। ফলে ছয় মাসের মধ্যে দুই আসনে ফের উপনির্বাচন করাতে হয়। একই ছবি দেখা গিয়েছিল ত্রিপুরায়। বিজেপি দলের সাংসদ প্রতিমা ভৌমিককে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী করে। প্রতিমা জিতেও বিধায়ক হিসাবে ইস্তফা দেন। উপনির্বাচন করাতে হয়।
বিজেপির এই সাংসদদের বিধানসভা ভোটে লড়ানোর ফলে একই কেন্দ্রে দু’বার ভোট হল। দ্বিগুণ খরচ হল। যদি নিশীথ, জগন্নাথ, প্রতিমারা বিধায়ক থেকে গিয়ে লোকসভার সাংসদ হিসাবে ইস্তফা দিতেন, তা হলে আবার সেখানে উপনির্বাচন করাতে হত। সেখানেও দ্বিতীয় বার ভোট আয়োজনের খরচ করতে হত।
সামনে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপি এখনও সম্পূর্ণ প্রার্থী-তালিকা প্রকাশ করেনি। এরই মধ্যে মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা ভোটে সাত বিজেপি সাংসদকে প্রার্থী করা হয়েছে। দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও রয়েছেন তালিকায়। রাজস্থানে মাঠে নামানো হয়েছে সাত সাংসদকে। ছত্তীসগঢ়ে চার জন। মোট ১৮ জন বিজেপি সাংসদ বিধানসভা ভোটে লড়বেন। পুরো প্রার্থী-তালিকা প্রকাশিত হলে সংখ্যাটা হয়তো আরও বাড়বে। বিজেপি নিজেকে পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে দাবি করে। তা সত্ত্বেও কেন একই ব্যক্তিকে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে লড়াতে হয়, তা বোঝা কঠিন। সে কথা থাকুক। আপাতত ধরে নেওয়া যাক যে, বিজেপির মোট ২০ জন সাংসদ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে লড়লেন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন জিতে এলেন। এই ১০ জন যদি বিধায়ক পদে ইস্তফা দেন, তা হলে ওই ১০টি আসনে উপনির্বাচন করাতে হবে। ফের ভোটের পিছনে খরচ হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর কথা বলছেন। লোকসভা ও সব রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন এক সঙ্গে করিয়ে ভোটের পিছনে বিপুল খরচ কমাতে চাইছেন। গত দশ বছর ধরে তিনি সরব। অথচ তাঁরই দল সাংসদদের বিধানসভা ভোটে প্রার্থী করে একই কেন্দ্রে ভোটের পিছনে দু’বার খরচ ডেকে আনছে। নির্বাচন কমিশনের সেই খরচ আমজনতার থেকে কর আদায়ের টাকা থেকেই মেটাতে হবে।
২০১৪-য় দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ সওয়াল করছেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সঙ্গেই যাতে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট করানো সম্ভব হয়, সে চেষ্টা তিনি করেননি। ২০১৯-এ লোকসভা ভোটে জিতে এসে প্রথমে লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাতেও একই সওয়াল করেন তিনি। যুক্তি দিয়েছিলেন, এতে ভোটের খরচ কমবে। প্রতি বছরই দেশে কোনও না কোনও নির্বাচন থাকে। বার বার নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি প্রযোজ্য হয়। তাতে সরকারি কাজ ব্যাহত হয়। তার পরে বহু বার, বহু মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী এই যুক্তি দিলেও তা রূপায়ণে কাজের কাজ কিছু হয়নি। মাসখানেক আগে আচমকা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি তৈরি হয়েছে। বিরোধী শিবিরে হইচই শুরু হয়েছিল— বিজেপি কি ২০২৪-এ লোকসভা ও সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট এক সঙ্গে করাতে চাইছে? কিছু দিন যেতেই আইন কমিশন স্পষ্ট করেছে, আপাতত ২০২৯-কে লক্ষ্য রেখে তারা কাজ শুরু করেছে।
কেন আরও আগেই এই প্রক্রিয়া শুরু করে ২০২৪-এই লোকসভা ও বিধানসভা ভোট এক সঙ্গে করানোর চেষ্টা হল না?
বিরোধী শিবিরের বরাবরই ভয় ছিল, লোকসভার সঙ্গে বিধানসভা ভোট হলে বিজেপি রাজ্যের ভোটেও নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাবে। ২০১৪-র পর থেকে নরেন্দ্র মোদী নিজের ক্যারিশ্মাকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে বৈতরণি পার করিয়েছেন। এমনিতে বিধানসভা ভোটে রাজ্যের স্থানীয় বিষয় প্রাধান্য পায়। বিরোধীদের আশঙ্কা ছিল, লোকসভার সঙ্গে বিধানসভা ভোট হলে জাতীয় রাজনীতির বিষয় প্রাধান্য পাবে। তাতেও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির লাভ। ফলে লোকসভা, বিধানসভা ভোট এক সঙ্গে হলে কেন্দ্রের সঙ্গে অধিকাংশ রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। এখন অবশ্য এই পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। আগামী বছর লোকসভা ভোটের সঙ্গে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট হলেও বিজেপির রাজনৈতিক লাভ হবে কি না, এই মুহূর্তে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে কর্নাটক, দিল্লি থেকে হিমাচলের বিধানসভা ভোট প্রমাণ করেছে, রাজ্যের ভোটে মোদীর ক্যারিশ্মা কাজ করছে না। তারই ফল হল, ২৮টি রাজ্যের মধ্যে এখন কমতে কমতে ১০টি রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন। এর মধ্যে বড় রাজ্য বলতে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, হরিয়ানা, অসম ও মধ্যপ্রদেশ। মধ্যপ্রদেশে অবশ্য বিজেপি ভোটে হেরে গিয়েও কংগ্রেসের বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়েছিল। ‘কোন আসনে কে প্রার্থী, তা না দেখে আমাকে ভোট দিন’ বলেও মোদী হিমাচলে বিজেপিকে জেতাতে পারেননি। জাতীয় রাজনীতিতে এখনও হয়তো নরেন্দ্র মোদীকে টেক্কা দেওয়ার মতো প্রতিপক্ষের কোনও নেতা নেই। কিন্তু রাজ্যের ভোটে কংগ্রেস বা বিরোধী শিবিরে মোদীর তুলনায় তেমন কোনও বড় নেতা না থাকলেও বিজেপি হেরেছে।
গত লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই ওড়িশার ভোট হয়েছিল। সেখানে আবার দেখা গিয়েছিল, একই ব্যক্তি লোকসভা নির্বাচনের ভোটযন্ত্রে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু বিধানসভায় ভোট দিয়েছেন নবীন পট্টনায়ককে। বিজেপি রাজ্যের ভোটে জাতীয় রাজনীতি, দেশের নিরাপত্তা, সেনার বীরত্বের মতো বিষয় নিয়ে এলেও মানুষ রাজ্যের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে ভোট দিয়েছেন।
লোকসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভা ভোট হলে জাতীয় রাজনীতি বিধানসভা ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে। এটা যেমন ঠিক, তেমনই বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজ্য রাজনীতি লোকসভা ভোটে প্রভাব ফেলবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি বাদ দিলে এখন অধিকাংশ রাজ্যে আঞ্চলিক দলের সরকার। চারটি রাজ্যে কংগ্রেসের একার সরকার রয়েছে। এই রাজ্যওয়ারি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে প্রতিফলিত হলে ত্রিশঙ্কু লোকসভা তৈরির আশঙ্কা থেকে যায়। যার অর্থ অস্থায়ী সরকার। অথবা, কোনও দলই সরকার গঠনের অবস্থায় না থাকা। ফলে ফের নির্বাচন। তাতে লোকসভা, বিধানসভা ভোট এক সঙ্গে করিয়ে খরচ কমানোর মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। সর্বোপরি লোকসভায় বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে সিংহভাগ রাজ্যে ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক লক্ষ্যই পূরণ হবে না।
প্রশ্ন হল, তা হলে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের মাস সাতেক আগে আচমকা সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায় ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নিয়ে মোদী সরকার কমিটি তৈরি করল কেন? ওই সময় মুম্বইয়ে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-র বৈঠক চলছিল। তারই মধ্যে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একাধিক সংবাদপত্রে নতুন করে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। আদানিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসাবে তুলে ধরা হয়। সেই সময়ই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নিয়ে কমিটি ঘোষণা করে দেওয়া হয়। তার পরে গত দেড় মাসে বিজেপি আরও দু’টি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে— এক, দেশের নাম ভারত না ইন্ডিয়া; দুই, মহিলা সংরক্ষণ বিল। রাহুল গান্ধী-সহ বিরোধীদের অভিযোগ, এ সব হল মানুষের নজর ঘোরানোর কৌশল। ভারত বনাম ইন্ডিয়া বিতর্ক যে অনর্থক, তা সংবিধানেই স্পষ্ট। মহিলা সংরক্ষণ ও ‘এক দেশ, এক ভোট’— কোনওটাই ২০২৯-এর আগে হচ্ছে না। তা হলে আচমকা এ সব নিয়ে হইচই বাধানোর কেন দরকার পড়ল? এর জুতসই উত্তর বিজেপি এখনও দিতে পারেনি।