Uttarakhand Disaster

ঋষিগঙ্গার বিপর্যয় পুরনো গুরুতর প্রশ্নটি ফিরিয়ে আনল

প্রকৃতির ক্রিয়া, না মানুষের?

Advertisement

জয়া মিত্র

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:১২
Share:

বিধ্বংসী: হিমবাহ ভেঙে ঋষিগঙ্গার ভয়াল স্রোত, উত্তরাখণ্ড, ৭ ফেব্রুয়ারি। রয়টার্স

ছবি আসছে ল্যাপটপের স্ক্রিন সেভারে— বিশাল পাহাড়। ঘন সবুজ টেবিলের মতো উচ্চভূমি থেকে নামছে বিশাল জলপ্রপাত। ভাল লাগছে না ছবিটা দেখতে। মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে দেখেছি পাহাড়ের দুই উঁচু শিরার মধ্য দিয়ে বয়ে আসা নিচু নদীতে এসে ভেঙে পড়ছে জলের পাহাড়। মোবাইলে তোলা ছবির সঙ্গে শোনা যাচ্ছে আর্ত চিৎকার “দেখো কেয়া আ রহা... দেখো... ভাগো ভাগো...”, যাঁদের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম, বেঁচে আছেন কি তাঁরা? রক্ষা পেয়েছে তাঁদের অনামা গ্রাম? জানি না। যেমন জানা যায়নি সেই চুয়াল্লিশ জন হারিয়ে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর খবর, যারা ২০১৩ সালে মন্দাকিনী নদীর কিনারের গ্রাম থেকে রেজ়াল্ট আনতে স্কুলে গিয়েছিল। উচ্চ হিমালয়ে পাহাড়ে টানেল কেটে তার মধ্যে দিয়ে নদীকে পার করে দেওয়ার এক আশ্চর্য প্রযুক্তি গত কয়েক বছর ধরে প্রচল হয়েছে। এর ফলে নদীর ধারা অনুযায়ী না চলে অনেক সংক্ষিপ্ত পথে ‘সুবিধেজনক’ ভাবে নদীকে কাজে লাগানো যায়। নদী আছেই তো কাজে লাগাবার জন্য। তার নিজস্ব আঁকাবাঁকা গতিপথ, ঢাল তৈরি করে নামা— তার চেয়ে টানেল সংক্ষিপ্ত। জলের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মাটি ধুয়ে এল। নদীর নিজের পথে বয়ে যাওয়ার বদলে সেই মাটি আটকালো টানেলের মুখে। কাদায় ঠেসে গেল টানেলের ভিতরটা। মজুররা কাজ করছিলেন। মজুরেরও নাম থাকে, গ্রাম থাকে। নিজের গ্রামে কাজ না থাকলে তাঁদের পরিবার ফেলে এত দূরে কাজ করতে আসতে হয়। বাঁধ ভাঙলে প্রথম ধাক্কায় তাঁরা ভেসে যান। কিংবা ভাসতেও পারেন না, কাদার স্তূপের মধ্যে পুঁতে পড়ে থাকেন। উদ্ধারকারী দলের এক জন সদস্য সাংবাদিকদের বলছিলেন, “একশো আশি মিটার লম্বা টানেল, সারা রাতে আমরা কেবল চল্লিশ মিটার ঢুকতে পেরেছি।”

Advertisement

কেন হয় হিমালয়ের ওই অত উপরে এই সব বাঁধ? কার স্বার্থে? কী মূল্য দিতে হয় তার? কে দেয়? এক একটা বীভৎস বিপর্যয় অদ্ভুত সব বাস্তবতার আড়াল খুলে নেয়। এখন সংবাদসূত্রে জানা যাচ্ছে, জোশীমঠ থেকে বিশ-ত্রিশ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট গ্রাম রইনি, যেখানে উদ্ধারকারী দলের হেড কোয়ার্টার, সে গ্রাম প্রায় দু’বছর আগে উত্তরাখণ্ড হাই কোর্টে আপিল করেছিল, যেন তাদের গ্রামের অত কাছে ঋষিগঙ্গার উপর ওই বাঁধের প্রজেক্ট না হয়। তবে যে ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী এ ধরনের প্রজেক্ট হওয়ার আগে এলাকার জনশুনানি আর ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) রিপোর্ট করতেই হবে বলে শোনা যায়? এখন স্থানীয় লোকেরা বলছেন, সকালে ডিনামাইট ব্লাস্টিং-এর পর ওই হিমবাহের ধস শুরু হয়। সত্যি হতে পারে, না-ও পারে। কিন্তু দু’টি কথাই সাধারণ ভাবে সত্যি। ডিনামাইট ফাটানোও হয় রাস্তা তৈরি বা পাহাড় ফাটানোর জন্য। ব্লাস্টিং-এর পর হিমালয়ের যে কোনও এলাকায় বিশাল ধস নামতেই পারে। সে রকম ঘটনা বহু বার ঘটেছে।

ধরে নিলাম কোনও বিস্ফোরণ ঘটানো হয়নি সে দিন। কিন্তু ওখানকার স্থানীয় মানুষরা, যাঁরা বংশানুক্রমে ওই সব জায়গায় বাস করার দরুন পাহাড়ের প্রকৃতির নিয়মকানুন অনেক বেশি জানেন, তাঁরা এক বাক্যে বলেছেন, ‘চৌড়ি সড়ক’ (পাকা রাস্তা) গ্লেসিয়াল এলাকায় ঢুকে পড়ছে, এটা খুব ভয়ের ব্যাপার। জঙ্গল কাটা তো হচ্ছেই, কিন্তু “বরফিলি ইলাকা নাজুক হোতা হ্যায়, উসকে সাথ ছেড়ছাড় নহি করনা হি অচ্ছা হ্যায়।” গ্লেসিয়ারের এলাকা অতি সংবেদনশীল। সেখানে হস্তক্ষেপ না করাই ভাল। এই ধরনের একটি বিপর্যয়ই যথেষ্ট ভয়ঙ্কর, কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে কোনও কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। একটি কাজ দিয়ে বিপর্যয় সামলাবার চেষ্টার ফলাফলও প্রায়ই সুদূরপ্রসারী হয়। রবিবার ঋষিগঙ্গার জল নামতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল— এক, টিহরি থেকে জল বেরোনো বন্ধ করা হয়। দুই, শ্রীনগরের কাছে অলকানন্দার বাঁধের রিজ়ার্ভার খালি করা হয়, নেমে আসা জলের ঝড় আটকানোর চেষ্টায়।

Advertisement

কিন্তু, কী করা সম্ভব অলকানন্দার নিম্নধারায় যখন সেই রিজ়ার্ভার-মুক্ত জল হঠাৎ বিপুল বেগে নামতে শুরু করে? ২০১৩ সালের ধ্বংসক্ষত এখনও পুরো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। জল নামবে হরিদ্বার, যেখানে কুম্ভমেলা চলছিল। সকলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিরাপদ জায়গায় সরার। গত কয়েক বছরে যাঁরা হরিদ্বার হৃষীকেশ গিয়েছেন, তাঁরা জানেন যে একটা শতরঞ্চি পাতার জায়গাও অবশিষ্ট নেই ধর্মব্যবসায়িক নগরায়ণে বিপর্যস্ত ওই গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ দু’টিতে। কোনও দিন জানা যাবে না, সত্যি কী হল ওই সব জায়গায় থাকা মানুষদের ভাগ্যে!

২০০৮ সাল থেকে গঙ্গা ও তার উপনদীগুলির পার্বত্য ধারায় বাঁধ না দেওয়ার আবেদন নিয়ে যখন প্রত্যেক সাংসদের হাতে এলাকাটির বিপদভয়ের সাক্ষ্যচিত্র পৌঁছে দিচ্ছিলেন ‘সেভ গঙ্গা’ অভিযানের গঙ্গাসন্তানরা, সেই সব প্রস্তাবিত বাঁধের মধ্যে এই বিষ্ণুগড় বাঁধের কথাও ছিল। কী করে ভোলা যাবে, সরকারের কাছে ওই একই দাবি জানিয়ে একের পর এক অনশনে প্রাণ দিলেন নিগমানন্দ, আগরওয়ালের মতো সন্ন্যাসী। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন আত্মবোধানন্দ স্বামী। দেশের কোনও বিষয়েই যদি সংশ্লিষ্ট সাধারণ মানুষের দাবিকে গুরুত্ব না দেন ক্ষমতাসীনরা, কী ভাবে চলে গণতন্ত্র?

বাঁধের অবৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আজ আমেরিকা ইউরোপে দেখা যায় না, কেবল ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এর দেশগুলিই এখনও তা নির্মাণ করে চলেছে। সেচের নামে যা শুরু হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণই বিফল। সমস্ত সেচ হয় পাম্পে ভূজল তুলে। জলবিদ্যুৎ? আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাত নদীবিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠক্কর তাঁর পত্রিকা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ড্যামস রিভারস অ্যান্ড পিপল-এ ২০১৯ সালে জানাচ্ছিলেন, “সব দিক বিচার করে দেখা যাচ্ছে যে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এখন আর আর্থিক ভাবেও সুবিধেজনক নয়। যে কোনও নির্মিত কিংবা নির্মীয়মাণ বাঁধ থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের দাম পড়বে ইউনিট প্রতি কমপক্ষে ৬-৭ টাকা, যখন সৌর কিংবা বাতাস থেকে পাওয়া বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি তিন টাকা বা তার কম। এবং এই বিকল্প শক্তি কোনও মতেই সামাজিক ও প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির মতো গভীর ক্ষতিকারক নয়।” চূড়ান্ত বিপজ্জনক এই প্রকাণ্ড নির্মাণগুলিতে তা হলে কার লাভ? কাদের লাভ?

এখন বিপদের দায় প্রকৃতির ‘খেয়ালখুশি’র উপর ঠেলে দেওয়ার চেষ্টায় নানা জায়গা থেকে ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। রবিবারই উদ্ধারসেনা টিমের এক কর্তা টিভি ক্যামেরায় অসহায় ভাবে বলছিলেন, আমাদের ত্রুটি আমরা শোধরাতে পারিনি। যেমন বিপুল বৃষ্টির সময়ে কেদারের উপরে চোরাবারি তালের কথা খেয়াল রাখা হয়নি, ঠিক তেমনই ঋষিগঙ্গার জলপ্রবাহ কেন কমে গেল, উপরে কোনও ‘তাল’ তৈরি হয়েছে কি না— খেয়াল করা হয়নি।

একটা কথা মনে হল। এই যে কোনও জায়গায় হঠাৎ ‘মেঘভাঙা’ বৃষ্টিপাত, কোথাও প্রকাণ্ড হিমবাহ ধসে পড়া, হাজার হাজার ছোটবড় জলধারার মধ্যে যে কোনওটার মুখ বন্ধ হয়ে হ্রদ বা তাল তৈরি হওয়া অথবা তালের মুখ ভেঙে আচমকা স্থানিক জলোচ্ছ্বাস— হিমালয়ের সুবিশাল গহন এলাকার মধ্যে এগুলি নিত্য ঘটনা। এ রকমই চলেছে চিরকাল। বিপদ এই মাত্রায় পৌঁছয়নি, যত ক্ষণ মানুষের হস্তক্ষেপ মাত্রাছাড়া হয়ে সেই প্রকৃতির সেই দুর্জ্ঞেয় নিজস্ব এলাকার মধ্যে না ঢুকেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement